কোন এক নিশাচর কোণে কবিতাঘর- অস্পষ্ট গন্তব্যরেখা, সঙ্গহীন দুর্মর যাত্রা। যার আষ্টেপৃষ্ঠে অদ্ভুত অলংক্রিয়া- শব্দের, দ্যোতনার । এরা ঘুমায় না, শুধু এঁকে যায়- নিঃসৃত চরণ। অক্ষর অক্ষরে বয়ে বেড়ায় জীবন- আঙ্গিকে, অনাঙ্গিকে । তুমি একটু কড়া নাড়লে কেউ একজন দরজা খুলে দেবে।সন্মুখে দৃষ্টি এড়ালে তুমি পতিত হবে নিমগ্নে, ভেবো না এ কোন দূর্ঘটনা, এটাই ঘটনা, যা ঘটে- দৃষ্টি এড়ানো যার পরাণ রীতি । তাই বলে তুমি কবিতাঘরে পৌঁছে গেছো- এমনটাও ভেবো না ! তোমার ধারণা পাল্টাতে হবে, নিজেকে আরো অস্তিত্বহীন ভাবতে হবে, মুখোশধারী হতে হবে, মিশে যাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা দেখাতে হবে।
তুমি কী দেখো চারপাশে ? ইচ্ছে করলে তোমার দু'চোখের গতি একটু কমিয়ে নিতে পারো । তোমার মস্তিস্কের ঠিক উপরে একটু টোকা দিলেই গতিতে আসবে আলতো স্থিতি, স্থবিরতা। তুমি একটু মনোযোগী হলেই দেখবে অজস্র ঘর জানালা খুলে তোমাকে দেখছে । ওরা এমনি, শুধু তাকিয়ে থাকে, অলসতা নেই, নির্লজ্জ। আরেকটু খেয়ালি হলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে।
কোন ঘরে হাসির আওয়াজ, কোন ঘরে ক্রন্দন, কোন ঘরে আবেগ, বিস্বাদ, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, কল্পনা । তুমি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়বে । কোন ঘরে ফিসফিস আলাপন,স্পর্শিয়া শিহরণ, কোমল উষ্ণতা, হলদিয়া সন্ধ্যার কাঁপন, রাত্রির আঁধারি সুবাস। একটি আধ্যাত্বিক আসক্তির ঘূর্ণন । নীরবতার খেয়ালি উচ্ছ্বাস, কল্পিত আল্পনা । নিরবচ্ছিন্ন আলো আঁধারির লুকোচুরি, হৃদয়ের আপেক্ষিক তত্বের ব্যাখ্যাতীত আকাঙ্ক্ষা, আগ্রাসী আবেগের উত্তাল ঢেউ। যৌবন নেশা, বাঁধাহীন মনন ইচ্ছে, বেহিসেবী ঘুড়ি, হৃদয়ের লেনাদেনার বাহারি রঙ, রঙ্গ । অদেহের বেখবর পালাবদল, পাগলাটে, উন্মাদ !
কিছু ঘরে দেখবে ন্যায় প্রতিষ্ঠা, নীতি- আদর্শ দীক্ষা , সুপ্রতীব রাষ্ট্র, সচেতন জনগণ, দেশাত্ববোধের গান, অধিকার চর্চা। নিপাতিত স্বৈরাচার, স্বাধীনতার তিব্র চিৎকার , সুষ্ঠ রাজনীতি, বলিয়ান দল, মিছিল, রাজপথ, রক্তাক্ত শ্লোগান, অবিসংবাদিত নেতা, নেতৃত্ব। কিছু ঘরে দেখবে বিশ্বাসী শপথ, বিজয় হুংকার, রূপকার, স্বপ্ন যোদ্ধা । দেশের তরে হৃদয়ে সুগঠিত মানচিত্র, মানবতার দীপশিখা, স্বর্ণালি ভোর, আলোকজ্জল মানুষের ঘনঘটা, সামাজিক দায়িত্ব কর্তব্য অধিকারের সূক্ষ্ম হিসেব নিকেশ। রঙিন পরিবার- শ্রদ্ধাবোধ, স্নেহ, ভালবাসার অপরিসীম পরিধি, আত্মীয় অনাত্মীয়ের সম্পর্কের সাহসী বেড়াজাল। ভবিষ্যত গড়ার দূরদর্শী রূপরেখা, কঠিন শপথ- দেশ মাতৃকা হারবে না কখনো !
এমন অন্য কোন ঘরে দেখবে, প্রকৃতির সুশাসন, দূর্যোগের আবাস, জল থইথই, আকাশে রঙচটা বিজলী, বিহঙ্গের ডানা ঝাপটানো কলরব, পাতা মরমর শব্দ, মেঘের শিল্পী হয়ে ঊঠার গল্প, বৃষ্টির ঝুম ঝুম আছড়ে পড়া । আরো দেখবে কোমল রৌদ্রস্নাত দুপুর, স্নিগ্ধতায় ভরপুর ফুলরাজ্য, মৌমাছি মধু কাতরতা, ফল ফলাদির টসটসে স্বাদ, কানায় কানায় ফসলে সাজানো ক্ষেত, কৃষাণের রৌদ্র পোড়া দেহে ক্লান্তি, মৃত্তিকার উর্বর ঘ্রাণ। প্রকৃতির সাথে প্রেমের রূপকথা, অবিচ্ছেদ্য !
তোমার দৃষ্টি হয়তো ক্লান্ত, একটু চোখ বন্ধ করো- এখন তোমার দৃষ্টির প্রখরতা উপলব্ধি করো । সকল ক্লান্তিকে সাহসে রূপান্তর করো, আরো কিছু দূর পতিত হতে হবে তোমাকে। শীতল ঝরনায় নিজেকে মেলে ধরো, লোমকূপে শ্লোগান জাগাও, কিছু অধরাকে মেনে নাও। ধীরে ধীরে নিজেকে সঁপে দাও অযাচিত কোন গল্পে, আগুন্তুক রাজ্যে । অতঃপর চোখ খুলো। এখানে আরো কিছু ঘর আছে, তোমাকে উপলব্দি করতে হবে, চিত্তকে কঠোর করতে হবে। তাদের স্বাগত জানানোর হিম্মত প্রদর্শন করতে হবে ।
এই অবশিষ্ট, বিবর্জিত ঘরে চেয়ে দেখো- কোন ঘরে লালসায় আবৃত সাম্রাজ্য , স্বার্থন্বেসী বিহঙ্গের তেজী ঠোকর, অনুভূতিহীন খুন, যন্ত্রণায় সজানো ভূমি। কোন ঘরে সম্পর্কের তেজস্বী চাওয়া-পাওয়া, বিচ্ছেদের ঢালাও আয়োজন,ক্ষমা পরিত্যাজ্য সম্পর্ক , ধৈর্য্য পরিত্যাক্ত নির্ণেয়। কোন ঘরে অহেতুক আকর্ষণ, বিষাক্ত আকাঙ্ক্ষা, অসম প্রেম ,কামনার স্বতসিদ্ধ দৃষ্টি, প্রবৃত্তির উত্তাল ঢেউ, অপ্রাপ্তির অভিনয়, আত্মহননের জলসা। কোন ঘরে হত্যা, ষড়যন্ত্র, রেষারেষি, বেইমানী, চুরি, ডাকাতি, হুমকি, ধামকি, গুম, দখল, প্রভাব, কুপ্রভাব, হিংস্রতার সর্বনাশী খেলা । তুমি হইও না এতো অস্থির, এখানে আসলে সবাইকে ধৈর্য্যের শেষ দরজায় দাঁড়াতে হয়, তুমি এমনি ওয়াদা করে এসেছো। একি ! তোমার চোখে জল, ভয়ে তুমি কাঁদছো, নাকি নিষ্ঠুর দৃশ্যে তুমি থমকে গেছো! আর ভেবো না, এখন তুমি চেয়ে দেখো, কতশত নতুন ঘর গড়ে উঠছে, কারো দরজা, কারো জানালা, কারো চৌকাঠ, কারো খিড়কী.... । এই ঘর কবিদের আসন্ন অনুষঙ্গ, এখানে হয়তো তুমি আছো, হয়তো তোমার মত অনেক আছে....। নিতান্তই কবিদের হৃদয়ের শঙ্কিত হালচাল!
তুমি কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছো । তুমি কী পারো অনুভব করতে সমস্ত হৃদয়ে, এর গভীরতা, এর বিশালতা ? হয়তো তুমি পারো না, হয়তো তোমার হৃদয়ে কিঞ্চিৎ শূন্যতা রয়েছে । চারপাশ থমথমে, মনোরম কৌশলী আবহ । মূলত এটা কবিতাঘর ! তোমার জিজ্ঞাসু চক্ষু নিশ্চয় জানতে চায় উনি কে ? ঠিক মাঝখানে বসে আছে, অবয়বে বিভ্রান্তি খেলা করে, গম্ভীর। খবরদার, উনাকে কবি বলে সম্বোধন করে ফেলো না যেন ! তুমি নিকটে যাও, তোমার বৃত্তান্ত দাও ।
সে ধীরে ধীরে কাছে গেলো, আর বললো, 'আমি একজন কবিতানুরাগী, কবিতাঘর দেখার জন্য ব্যাকুল ছিলাম, আজ স্বপ্ন পূরণ হলো।' বিভ্রান্ত অবয়ব বললো, ' তোমার হৃদয় লেখা হয়ে গেছে, দেহ নিয়ে আমাদের কোন কাজ নেই, তুমি এখন আসতে পারো ।' প্রতিউত্তরে সে কিছুটা বিরক্ত হলো এবং ধীরলয়ে প্রস্থাণ করলো ।
অবশেষে, বিভ্রান্ত অবয়ব বিড়বিড় করে বললো, ব্লাডি আগুন্তুক !
[এই লেখাটি গুণী ব্লগার 'সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই' ভাইকে বিশেষ উৎসর্গ করলাম এবং কবিতানুরাগীদের জন্য ছোট্ট উৎসর্গ । উনার 'কবিতাঘর' কবিতার বর্ণনাত্বক একটা কবিতা লিখবো বলেছিলাম । সেই ভাবনা থেকে এই লেখার উৎপত্তি ।]
ছবি বন্ধু- গুগল ইমেজ ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ৮:৩৪