ডিলিউথ বিমানঘাঁটিতে অনধিকার প্রবেশকারী
কিউবান ক্ষেপনাস্ত্র সংকটকালে, ১৯৬২ সালের ২৫ অক্টোবর, মিনিসোটার ডিলিউথের একটি বিমানঘাঁটিতে একজন গার্ড হটাৎ লক্ষ্য করে যে অবৈধ ভাবে কেউ একজন সীমানা প্রাচীর বেয়ে উঠতেছে। গার্ড ঐ ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে গুলি করে এবং বিপদসংকেত দেয়। এতে করে ঐ এলাকার সব বিমান ঘাঁটিতেই বিপদসংকেত বেজে ওঠে। যাই হোক, উইচকনসেনের ভোক ফিল্ড বিমানঘাঁটিতে বিপদসংকেত সিস্টেমে ত্রুটি ছিল। ছোট-খাট বিপদ সংকেতের পরিবর্তে এটা নিউক্লিয়ার-অস্ত্র সজ্জিত এফ-১০৬এ ডেল্টা ডার্ট ইন্টারসেপ্টরদেরকে DEFCON 3 সংকেত দিয়ে আকাশে ওড়ার নির্দেশ দেয়! যেহেতু DEFCON 3 সংকেতে কোন অনুশীলনের সুযোগ নেই তাই পাইলটরা মনে করে যে সোভিয়েত ইউনিওনের সাথে নিউক্লিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বিমান উড়বে এই মূহুর্তে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে তাড়াহুড়ো করে বিমানের দিকে একটি গাড়ি ছুটে আসে এবং বিমান থামানোর জন্য সংকেত প্রদান করে! পরবর্তিতে দেখা যায়, যেটি অবৈধভাবে প্রাচীর বেয়ে উঠতেছিল সেটি আসলে একটা ভালুক!
ডিলিউথ বিমানঘাঁটির বিমান উড়ার প্রস্ততি
থুলি বিমানঘাঁটি পতন
"হার্ড হেড" মিশনের অংশ হিসাবে ১৯৬৮ সালের ২১ জানুয়ারী একটি বি-৫২ বোমারু বিমান ৪ টি হাইড্রোজেন বোম নিয়ে গ্রীনল্যান্ডের নিকট বাফিন উপসাগরের উপর দিয়ে উড়ছিল। জায়গাটি আসলে একটি বিমানঘাঁটি যেটি ঠিক সোভিয়েত এয়ার স্পেসের সীমানা লাগোয়া যেখান থেকে প্রয়োজনে খুব দ্রুত শত্রু পক্ষকে আঘাত করা যায় বা প্রতিশোধমূলক পাল্টা আক্রমন করা যায়। যাই হোক, হটাৎ করে এই ফ্লাইটে আগুন ধরে যায়! বৈমানিকদের ৬ জন বের হয়ে যেতে পারলেও একজন মারা গিয়েছিল। প্লেন টুকরো টুকরো হয়ে সাগরের বরফের উপর পড়লো এবং নিউক্লিয়ার বোমের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক দ্রব্যাদি বিস্তীর্ণ সাগরের উপরে ছড়িয়ে গেল আর তার সাথে সাথে তেজস্ক্রিয় পদার্থও। ভাগ্য ভালো সেখানে কোন পারমানবিক বিস্ফোরণ হয়েছিল না কারণ বোমাগুলো অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত ছিল না। পরবর্তিতে বড় ধরণের পরিষ্কার অভিযান চালানো হয় এবং ৬৭০০ ঘনমিটার দূষিত বরফ এবং তুষার যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়।
নরওয়ের গবেষনা রকটে
১৯৯৫ সালের ২৫ জানুয়ারী, নরওয়ের একদল বিজ্ঞানী Black Brandt XII নামের একটি গবেষণা-রকেট নিক্ষেপ করেন। রাশিয়ান রাডার ষ্টেশনগুলো এটাকে নর্থ কেপ থেকে নিক্ষিপ্ত Trident missile হিসাবে সনাক্ত করে। এবং এক প্রকার বিশ্বাস করা হয় যে, এই মিসাইল মস্কোর কমান্ড ও কন্ট্রোল সিস্টেমকে ধংস করার জন্য ছোড়া হয়েছে। রাডারের সতর্কবার্তা সাথে সাথে রাশিয়ান হাই কমান্ডকে জানানো হয়। এবং অতি দ্রুত রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং সামরিক বাহিনীর প্রধানদের মধ্যে ভিডিও কনফারেন্স হয় (কেউ কি কল্পনা করতে পারেন কি রকম হতে পারে সেই কথোপকথ!!)। আট মিনিট পরে, রাশিয়ান বিশেষ কম্পিউটার হিসাবে করে বের করে যে মিসাইলগুলো প্রকৃতপক্ষে নরওয়ের সাগরে বিস্ফোরিত হবে; এটার টার্গেট রাশিয়া না। যাক বাবা এবারের মতো বাঁচা গেল। পরবর্তীতে রাশিয়ান নিউক্লিয়ার এক্সপার্টরা বলেছিল যে এই ধরণের নিউক্লিয়ার মিসাইলের পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে নিউক্লিয়ার মিসাইল নিক্ষেপ করা হবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নিতে ১০ মিনিট সময় থাকে। তার মানে, প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েল্থসিনের মাত্র ২ মিনিট সময় ছিল! পথ ছিলো দুটো, হয় নিজেদের নিউক্লিয়ার মিসাইল ছোড়া এবং বিশ্বব্যাপি যুদ্ধ শুরু করা, নতুবা নিজেরা চুপচাপ ধংস হয়ে যাওয়া।
নরওয়ের রকেট
কর্নেল পেট্রোভ: মহান ব্যক্তি
১৯৮৩ সালের ২৬ সেপ্টেমবর মধ্যরাত, বেলারুশের গেন্টসাভিচি শহরের সেরপোকভ ১৫ বান্কারে কর্তব্যপালনে ছিলেন কর্নেল স্ট্যানিসলভ পেট্রোভ। হটাৎ করে বান্কারের কম্পিউটার থেকে সতর্ক সংকেত: ওকো ওয়ার্নিং স্যাটেলাইট মধ্য-পশ্চিম আমেরিকা থেকে নিক্ষিপ্ত ৫ টি মিনিউটম্যান-II ICBM (আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র) ডিটেক্ট করেছে। এই সংকেত রাশিয়ান হাই কমান্ডকে জানানোর অর্থ-ই হলো নিউক্লিয়ার যুদ্ধ অনিবার্য। যাই হোক, পেট্রোভ সোভিয়েত নিয়ম-কানুন কে অমান্য করলেন এবং হাই কমান্ড কে কোনরুপ সংকেত দেওয়া থেকে বিরত থাকলেন। পরবর্তীতে, তিনি বলেছিলেন আমেরিকা যদি ঐ সময় প্রথমে ক্ষেপনাস্ত্র মেরে সোভিয়েতকে ধংস করতে চায়বে তাহলে কেন মাত্র ৫ টি মিসাইল, কেন কয়েক হাজার মিসাইল একসাথে নয়; ৫ টি মিসাইল খুব বেশি ধংস করতে পারবে না। যাই হোক, পরে জানা যায় যে, স্যাটেলাইটের ইন-ফ্রারেড সেন্সরে ত্রুটি ছিল।
কর্নেল পেট্রোভ
এইবার সেই: কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস মুকাবিলা
১৯৬২ সালের ১৪-ই অক্টোবর সকালে একটি আমেরিকান U-2 প্লেন (সৈনাপত্য-সংক্রান্ত প্রাথমিক নিরীক্ষণে ব্যবহৃত) কিউবার কমিউনিস্ট আইল্যান্ডের উপর দিয়ে উড়ার সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক মাঝারি পাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র SS-4 নিক্ষেপের জন্য নির্মিত কয়েকটি জায়গা আবিষ্কার করলো। এই আবিষ্কারের সাথেই সাথেই শুরু হয়ে যায় সারা পৃথিবীকে ভয়ে ভয়াতুর করে তোলা কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস। আমেরিকানদের নাকের ডগায় মিসাইল নিক্ষেপের ব্যবস্থা দেখে স্বভাবতই তারা খুশি হতে পারলো না; সম্তব্য হুমকি মোকাবেলায় তারা বেশ কয়েকটি উপায়ও ভাবলো যেমন কিছই না করা, ক্ষেপনাস্ত্র ধংসের জন্য এয়ারস্ট্রাইক করা, পুরো দমে সামরিক হামলা করা। অবশেষে, তারা আইল্যান্ডটিকে অবরোধ করে রাখলো, যাতে করে আর কোন মিসাইল কিউবাতে না প্রবেশ করতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এটাকে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। প্রথমবার এবং বিশ্বইতিহাসের এই একমাত্রবার, মার্কিন বিমান বাহিনীকে DEFCON 2 (লাল রং) তে প্রস্তত রাখা হয়। অবরোধ চলাকালীন, অক্টোবর ২৭ তারিখ, সেখানে থাকা একটি আমেরিকান Destroyer সোভিয়েত সাবমেরিন বি-৫৯ কে উদঘাটন করে। সাবমেরিনটিকে উপরিভাগে নিয়ে আসার জন্য আমেরিকান Destroyer থেকে ডেপথ চার্জ (সাবমেরিন ধংস করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে জোর করে পানির উপরিভাগে নিয়ে আসা হয়) প্রয়োগ করা হয়।
রাশিয়ান সাবমেরিন (ছবি: ইন্টারনেট)
অবস্থা ভয়াবহ এবং আর কোন উপায় না দেখে সাবমেরিন ক্যাপ্টেন ভ্যালেন্টিন সোভেটস্কি পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ১৫ কিলোটনের নিউক্লয়ার বোমায় সজ্জিত টর্পেডো ফায়ারিং এর জন্য প্রস্তত করার নির্দেশ দেয়। উল্লেখ্য যে, সাবমেরিন থেকে নিউক্লিয়ার-টর্পেডো ফায়ারের জন্য মস্কো থেকে কোন অনুমতির প্রয়োজন ছিল না। কিন্ত, টর্পেডো ছোড়তে হলে সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন সহ রাজনৈতিক কর্মকর্তা এবং সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ভাজিলি আর্কাইপভ এই তিনজনের অনুমতির প্রয়োজন ছিল। ক্যাপ্টেন এবং রাজনৈতিক কর্মকর্তা টর্পেডো ছোড়ার পক্ষে থাকলেও বিপক্ষে থাকলো ভাজিলি আর্কাইপভ। এবং ভাজিলি আর্কাইপভ ক্যাপ্টেনকে ম্যানেজ করে সাবমেরিনকে উপরে নিয়ে আসেন এবং মস্কোর উপর সবকিছু ছেড়ে দেন। সেই সাথে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নিউক্লিয়ার যু্দ্ধটি, সে সাথে বেঁচে যায় এই পৃথিবীটিও। সালাম তোমাকে ভাজিলি আর্কাইপভ । আজ তোমার জন্মদিন, তোমাকে জানাই শ্রদ্ধা।
ভাজিলি আর্কাইপভ।
ভাজিলি আর্কাইপভের আরো কয়েকটি তথ্য:
জন্ম: ১৯২৬ (মস্কো)
মৃত্য: ১৯৯৯
পেশা: নেভাল অফিসার, সর্বশেষ র্যাংক: ভাইস এডমিরাল
যুদ্ধ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস
পুরষ্কার: অর্ডার অব দ্যা রেড ব্যানার , অর্ডার অব দ্যা রেড ষ্টার
-উপর নির্মিত ছবি: ক্রিমসন টাইড
একটি ভিডিও
ক্রিমসন টাইডে তুলে ধরা সেই সংকটুময় মুহৃত:
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৪৪