জ্ঞান সৃষ্টিকর্তার দান। জ্ঞানী চিরদিন বেঁচে থাকে না। তার মানে কি জ্ঞানীর প্রস্থানের পরই তার আলো থেকে বঞ্চিত বিশ্ব। না, এমনটি হয়নি হবারও নয়। বিশ্বখ্যাত জ্ঞানীদের আলো মানব সভ্যতায় যুগের পর যুগ বিতরণ করে চলেছে একজন। না, তিনি কোনো ব্যক্তি নন। প্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরি। অসীম জ্ঞানের আঁধার।পৃথিবীর সবচেয়ে নিরব জায়গাগুলোর অন্যতম লাইব্রেরি। কিন্তু এ নিরব জায়গাগুলোই অসংখ্য সরব চিন্তা, তত্ত্ব ও তথ্যের আশ্রয়। থাকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশনা। আর থাকে এখন পর্যন্ত মানবজাতির হেঁটে যাওয়া পায়ের ছাপ। সব যুগেই লাইব্রেরি ছিল জ্ঞানপিপাসু মানুষের আশ্রয়স্থল। প্রয়োজনটা প্রায় অভিন্ন থাকলেও সময়ের পালাবদলে লাইব্রেরির গঠনে আসছে অনেক পরিবর্তন। এখন একেকটা লাইব্রেরি যেন একেকটা শিল্পকর্ম, নান্দনিকতার অনন্য উদাহরণ। পৃথিবীর এমন কয়েক’টি অসাধারণ লাইব্রেরির সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি
১. স্টুটগার্ট সিটি লাইব্রেরি - জার্মানির স্টুটগার্টে এ লাইব্রেরি অবস্থিত। বইয়ের তাকগুলো ওপরের পাঁচটি মেঝেতে অবস্থিত। সিঁড়িগুলো এমনভাবে বানানো হয়েছে যেন মনে হয় একেকটা ফানেল। কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক আলোর সমন্বয়ে এমন সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে যেন সতেজতা বিরাজ করে আশেপাশে! সাধারণের মাঝে অনন্য এ লাইব্রেরিটি। বাহিরের দিক থেকে দেখলে মনে হবে বিশাল একটি কিউব/ঘনাকৃতির স্থাপনা। স্বচ্ছ ছাদ দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকতে পারে। রাতের বেলা লাইব্রেরিটির এমন আলোকসজ্জা করা হয়, মনে হয় যেন একটি রুবিকস কিউব।
২. সিয়াটল পাবলিক লাইব্রেরি - যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন সিটির সিয়াটলে ২০০৪ সালে উদ্বোধন হওয়া এ লাইব্রেরিটি একটি অত্যাধুনিক লাইব্রেরি। লাইব্রেরিটির ডাচ স্থপতি রেম কোলহাস বলেন, একবিংশ শতাব্দীর লাইব্রেরি শুধু অনেকগুলো বইয়ের তাক হবে না বরং হবে একটা তথ্য ভাণ্ডার, যেখানে নতুন-পুরাতন সব ধরনের তথ্য পাওয়া যাবে। পাঠকক্ষগুলোকে সিলিকন ভ্যালির অফিস কক্ষের মত মনে হবে! পুরো বিল্ডিংটাই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ। সেখানে বই অনুসন্ধান থেকে শুরু করে হাতের কাছে বই চলে আসা সবগুলোই হয় প্রযুক্তির সহায়তায়। আছে বিশ্রামাগার, বাচ্চাদের থাকার জায়গাসহ আরো অনেক নাগরিক সুবিধা।
৩. সেইন্ট ফ্লোরিয়ান মঠ - ৮১৯ সাল থেকেই অনেকগুলো মঠ লাইব্রেরির কাজে ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু অস্ট্রিয়ার বর্তমানের এ অনন্য স্থাপনাটি ১৮ শতকে তৈরি হয়। লাইব্রেরির ভেতরের কাঠামোটা ‘বারোক’ স্থাপত্য রীতিতে তৈরি। সিলিং আছে অসাধারণ ফ্রেসকো পেইন্টিং যেটাকে দেখলে মনে হবে মেঘ থেকে কোনো রূপকথার জগতের প্রাণীরা কক্ষটির পাঠকদের দেখছে!
৪. ট্রিনিটি কলেজ ওল্ড লাইব্রেরি - আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে এ লাইব্রেরিটিতে। ১৫৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এ লাইব্রেরির বইয়ের সংগ্রহ বেড়েই যাচ্ছে। ১৮ শতকের প্রথম দিকে আইরিশ স্থপতি থমাস বার্গ এ নতুন স্থাপনাটির কাজ শুরু করেন। দেশের একটি পুরোনো লাইব্রেরি হিসেবে এটি এখন পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। এটি ডাবলিনে অবস্থিত।
৫. বিব্লিওথেকা - খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে প্রতিষ্ঠিত এ লাইব্রেরিটি তৃতীয় শতকে ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হওয়ার আগে ছিল বিশ্বের একটি প্রাচীনতম ও গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। ২০০২ সালে তৈরি শেষ হওয়া নতুন বিব্লিওথেকা, আলেকজান্দ্রিয়ার লক্ষ্যও হলো জ্ঞানচর্চার নতুন কেন্দ্রবিন্দু হওয়া। প্রাচীন স্থাপত্যের সঙ্গে আধুনিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার সমন্বয়ে এ লাইব্রেরিটি হয়ে উঠছে জ্ঞানপিপাসু মানুষদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। মুসলিম বিশ্ব সভ্যতার আঁধার খ্যাত মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় এটির অবস্থান।
৬. ক্লেমেনতিনামচেক রিপাবলিকের ন্যাশনাল লাইব্রেরি - এর প্রধান স্থাপনা এ ক্লেমেনতিনাম। এটি অনেকগুলো ঐতিহাসিক ভবনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সবচেয়ে প্রাচীনতম ভবনটি ১১ শতকের।
৭. ইউনিভার্সিটি অব এবারদিন নিউ লাইব্রেরি - ইংরেজি ভাষার সবচেয়ে প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি হল দ্যা ইউনিভার্সিটি অব এবারদিন। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৪৯৫ সালে। কিন্তু এর নতুন লাইব্রেরিটির কাজ গত বছর শেষ হয়। ডেনমার্কের স্থপতি স্মিট হ্যামার লাসেন এমনভাবে এটি নির্মাণ করেন যেন মনে হয় এটি অতীতের কোনো এক যুগে আটকে রয়েছে। অবশ্য অত্যাধুনিক সব সুবিধার কোনো কমতি নেই সেখানে! বাহির থেকে একটা বাক্সের মত মনে হলেও ভেতরটা একবারে আলাদা। আটতলা এ লাইব্রেরিটির সিঁড়িগুলো বাঁকানো এবং ভিতরে রয়েছে যথেষ্ঠ প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম আলো বাতাসের ব্যবস্থা। এখানে প্রায় ১২০০ পাঠক আলাদা আলাদাভাবে পড়তে পারে। এবারদিন স্কটল্যান্ডকে বিশ্বে আলাদাভাবে পরিচিত করে তুলেছে।
৮. জর্জ পিবডি লাইব্রেরি - বাল্টিমোরের স্থপতি এডমান্ড জি. লিন্ড এটি শেষ করেন ১৮৭৮ সালে। এ লাইব্রেরিটিকে উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে সুন্দরতম লাইব্রেরির একটি হিসেবে সন্মান করা হয়। লাইব্রেরির ভেতরের অংশটি পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ৬১ ফুট উপরের ছাদ দিয়ে আসা সূর্যের আলোতেই আপনি পড়ে ফেলতে পারবেন। সাদা-কালো মার্বেলের ফ্লোরটিকে সূর্যের আলো অসাধারণ আলোয় আলোকিত করে রাখে।
৯. মোশাসিনো আর্ট ইউনিভার্সিটি মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরি - প্রত্যেক লাইব্রেরিতেই চেয়ার টেবিলের সঙ্গে আরেকটি প্রধান অনুসঙ্গ হলো বইয়ের তাক। জাপানি স্থপতি সু ফুজিমোতু পুরো লাইব্রেরিটাকেই বানিয়ে ফেলেছেন তাকের মত করে। প্রত্যেকটা দেয়াল যেন একেকটা তাক। যদিও প্রত্যেকটা তাকে বই নেই কিন্তু এটা যেন উত্তরাধুনিক স্থাপনার একটি অনন্য নিদর্শন। যান্ত্রিক সভ্যতার পথ প্রদর্শক জাপানের টোকিও-তে এটির অবস্থান।
১০. হোসে ভাসকনসেলোস লাইব্রেরি - একটি বিশাল দুর্গাকৃতির এ লাইব্রেরিটির চতুর্দিকে আছে ১২৫,০০০ বর্গফুটের একটি বাগান। মেক্সিকোতে শিক্ষার হার বাড়ানোর স্বপ্ন থেকে এ লাইব্রেরিটির নকশা করেন স্থপতি আলবার্তো কালাচ। এ লাইব্রেরিটিতে ১.৫ মিলিয়ন বই রাখার জায়গা রয়েছে।
উৎসঃ আরটিএনএন