• মার্কস পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই একটা অন্তর্নিহিত সঙ্কটের দিক চিহ্নিত করেছিলেন – অতি উৎপাদনের সঙ্কট।
• এই সঙ্কট থেকে পুঁজিবাদ নানা প্রক্রিয়ায় পরিত্রাণ পেতে চেয়েছে –কখনো যুদ্ধ, কখনো নতুন নতুন বাজার দখল, প্রযুক্তির বিকাশ এসব এর মধ্যে রয়েছে।
• উৎপাদন নির্ভর অর্থনীতি ক্রমশ সরে গেছে অন্যদিকে। একে বলা হয় ফায়ার অ্যান্ড আইস ইকনমি। ফিনান্স, ইন্সুরেন্স, রিয়েল এস্টেট এবং ইনফরমেশন, কমিউনিকেশন, এন্টারটেনমেন্ট –এগুলিই অর্থনীতির বড় ভিত্তি হয়ে উঠেছে। অর্থনীতিতে ফাটকা ব্যবস্থা বড় হয়ে উঠেছে, শেয়ার ও অন্যান্য ঋণপত্র, ডেরিভেটিভ [অর্থাৎ ঋণপত্রের নানা মিশ্রিত প্যাকেজ, যার নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই, যা অন্য কিছু থেকে ডিরাইভ করা হয়, অর্থাৎ যা অন্য কিছু থেকে রসদ সংগ্রহ করে] – ইত্যাদি গুরূত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
• সাম্প্রতিককালে প্রথমে আমেরিকায় ও পরে ইউরোপে যে আর্থিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে তাতে বড় ভূমিকা থেকেছে একটা ফাটকা বুদবুদের বিস্ফোরণের, যা হাউজিং বাবল বিস্ফোরণ নামে খ্যাত। সরকারগুলো ঘড়বাড়ির বাজারকে করছাড় ইত্যাদি দিয়ে ফুলিয়ে তুলেছে, ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা আছে কিনা তা না দেখেই ঋণ দেওয়া হয়েছে। ঝুঁকি বেড়েছে, বেড়ে যাওয়া ঝুঁকিকে মিলিয়ে তারা ডেরিভেটিভে পরিণত করেছে। ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা সীমার বাইরে যাওয়ার পর যাবতীয় ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ একসাথে অনাদায়ী হয়ে পড়েছে, ব্যাঙ্কগুলোর পতনের সাথে সাথে সামগ্রিক অর্থনীতি সঙ্কটে পড়েছে।
• ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারী ঋণ অত্যন্ত বেড়ে যাওয়াটাকেই সাম্প্রতিক ইউরো জোন ক্রাইসিস বলা হচ্ছে। জিডিপির তুলনায় এটা এত বেড়ে গেছে যে তা অপরিশোধ্য জায়গায় চলে গেছে। জিডিপির তুলনায় গ্রীসের ঋণ ১৪০ শতাংশ, আইসল্যাণ্ডে ১২৩ শতাংশ, ইতালিতে ১১৯ শতাংশ, আয়ারল্যান্ডে ৯৫ শতাংশ, পোর্তুগালে ৯৩ শতাংশ, জার্মানি ও ফ্রান্সে ৮৩ শতাংশ করে, স্পেনে ৬০ শতাংশ।
• এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের অর্থনীতি এই বিশ্ব ব্যবস্থায় অঙ্গাঙ্গী যুক্ত হওয়ায় এক দেশের সঙ্কট অন্য দেশে সহজে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন -২০১১ তে ফরাসী ব্যাঙ্ক থেকে ইতালীয় গ্রাহকরা ৩৬৬ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিলে ও তারপর সেই ঋণ শোধ দিতে না পারলে ফরাসী অর্থনীতি সরাসরি সঙ্কটগ্রস্থ হয়।
• বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ঝুঁকি নিয়ে যে সঙ্কট ডেকে এনেছে তা থেকে মুক্তি দিতে সরকার বেল আউট প্যাকেজ ঘোষণা করে। বিপুল বেল আউট প্যাকেজের ফলে বাজেট ঘাটতি দেখা যায়। ২০০৭ এ ই ইউ দেশগুলির যে গড় বাজেট ঘাটতি ছিল ০.৬ শতাংশ, তা আর্থিক সঙ্কটের পর দাঁড়ায় ৭ শতাংশ তে। গড় সরকারী ঋণ জিডিপির ৬৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮৪ শতাংশ হয়।
• আর্থিক সঙ্কটের প্রেক্ষিতে ইউরোপের শাসক দলগুলি ব্যয় সঙ্কোচের নীতি নেয়। এর দুটি দিক – ১) মানুষের ওপর সরকারের বেশি বেশি কর চাপানো, ২) বিভিন্ন সরকারী ব্যয়বরাদ্দ কমানো, ভরতুকি কমানো বা বন্ধ করা।
• এর ভিত্তিতে ব্যাপক সামাজিক প্রতিক্রিয়া হয়, ব্যয়বরাদ্দ হ্রাসের কারণে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিভিন্ন নির্বাচনে এর প্রভাব পড়ে। ফ্রান্সে ফাঁসোয়া ওলাঁদ ক্ষমতায় আসেন ধনীদের ওপর ব্যাপক কর বসানো, সেই টাকায় ৬০,০০০ শিক্ষক নিয়োগ করা, অল্প আয়ের মানুষদের জন্য বিদ্যুতের ব্যয়ে ভরতুকি দেবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। যে জার্মানী ও তার প্রেসিডেন্ট মার্কেল ব্যয়সঙ্কোচের প্রবক্তা সেখানেও দুটি প্রদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ব্য্যসঙ্কোচের বিরোধিতার ভিত্তিতে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং গ্রীন পার্টি বিজয়ী হয়েছে। গ্রীসের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর পরাজিত হলেও সিরিজা এবং বামেদের বিপুল সমর্থনভিত্তি লাভ সেখানে একটা বড় ঘটনা। ই ইউ থেকে বেরিয়ে গেলে গ্রীস বেতন পেনসন দিতে পারবে না এই ভয়ঙ্কর আর্থিক অবস্থার কারণে, এই ভয় দেখিয়ে বুর্জোয়া মিডিয়া শাসক নিউ ডেমোক্রেসি ও প্যাসক জোটকে বিজয়ী হতে সাহায্য করে। কিন্তু বামপন্থীদের বিপুল সাফল্য সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। এই ঘটনাগুলির সঙ্গে আমেরিকার সাম্প্রতিক আর্থিক সঙ্কট পরবর্তী ঘটনার তফাৎ মূলত রাজনৈতিক। আমেরিকার আর্থিক সঙ্কট শাসক শ্রেণির মধ্যেকার ক্ষমতা বদলের মধ্যে দিয়েই পলিটিক্যাল বেল আউট করতে পেরেছে, বুশের জায়গায় এসেছেন ওবামা। কিন্তু ইউরোপে বামপন্থীদের জয় বা বিপুল সমর্থন শাসক শ্রেণির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসার ইঙ্গিৎ। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের শক্তি ছিল শাসকের নিজেদের মধ্যেই ক্ষমতা বদলের মধ্যে দিয়ে শাসন চালিয়ে যাবার নিশ্চিন্ত পদ্ধতি। সেই নিশ্চিন্ততা এবার কিছুটা হলেও সঙ্কটের মুখে। বামপন্থী, সমাজতান্ত্রিকরা অনেকদিন পর আবার বুর্জোয়াদের চ্যালেঞ্জ জানাতে পারছে। আগামী দিনের পরিস্থিতি বদলের দিকে আমাদের সাগ্রহ অপেক্ষা থাকবে।