রাত ঠিক বারোটায় আমি মিহরিমাকে ফোন দিব বলে ঠিক করলাম ।একদম মধ্যরাত।এই সময়ে মানব মন কিছুটা শান্ত থাকে।তখন শান্ত গলায় চুপিচুপি কথা বলা যাবে প্রিয় মানুষটার সাথে। এরপর গড়ে উঠবে একটা প্রেমের সম্পর্ক।কিছুদিন আগেও মাত্র কয়েক পয়সা মিনিটে মধ্যরাতে কথা বলা যেত।সেই সময় কত শত প্রেম হয়েছে এই বাংলায় সেটা এই প্রজন্মের কাউকে বুঝানো যাবে না। এই প্রজন্মকে বুঝাতে গেলে বলবে "ব্রো! পয়সা খরচ করে কথা বললেও কি আপনি তাকে দেখতে পেতেন ?আর আমরা তো সারারাত ভিডিও চ্যাট করি তাও মন ভরে না ।" এদের কে বুঝাবে কাউকে না দেখে যে অনুভূতিটা পাওয়া যায় সেটা দেখে পাওয়া যায় না। আমার মতে এর চেয়ে ভালো ছিল চিঠির যুগ। চিঠির যুগ থাকলে আমি মিহরিমাকে একটা চিঠি লিখতাম।চিঠিটা এরকম হতে পারত।চিঠির শুরুটা হবে খুব সুন্দর একটা সম্বোধন দিয়ে।একদম সাহিত্যিক সম্বোধন।
প্রীতিনীলয়াসু,
পত্রের প্রথমে অনেকগুলো বকুল ফুলের শুভেচ্ছা নিও।কেমন আছো ?তোমাকে দেখে মনে হয়েছে তুমি ভালো নেই। তোমাকে আমার খুব অদ্ভুত মেয়ে মনে হয়েছে।তবে সত্যিটা কি জানো?
প্রকৃতি অদ্ভুত পছন্দ করে আর অদ্ভুত কিছুকে সব সময় অন্যভাবে আগলে রাখে। এটা প্রকৃতির বিশেষ একটা কোটা।তুমি এই বিশেষ কোটার আওতাভুক্ত।আমার কাছে মনে হয় তোমাকে আগলে রাখার জন্য উপরওয়ালা আমাকে পাঠিয়েছেন ।প্রশ্ন করতে পারো কিভাবে? আমি তোমার চোখ দেখেই বুঝে গিয়েছি ।মানুষের চোখের ভাষা আর শুধু একজন মানুষই পড়তে পারে।এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে কম কথা বলা ভাষা।আমার মনে হয় তোমার এটাকে মেনে নেয়া উচিত।নইলে দেখবে আমি ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেছি।।এত ঝামেলার কি দরকার ? স্বীকৃতি দিয়ে দিলেই হয়।
ইতি,
তোমার চোখের ভাষা পড়তে পারা একমাত্র মানুষ।
ব্র্যাকেটে মানুষের জায়গায় প্রেমিক লিখতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু কোথা থেকে জানি একটা বাঁধা আসছে।আচ্ছা মানুষ আর প্রেমিকের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে ?
চিঠির প্রাপক মুরুব্বী টাইপ কেউ হলে তাকে লিখতে হয় শ্রদ্ধাভাজনেষু,তারপর -পত্রের প্রথমে আমার সালাম নিবেন।আশা করি ভালো আছেন।এই টাইপ কথাবার্তা।কারণ মিহরিমা আমার সিনিয়র।বড় আপু।শ্রদ্ধাভাজনেষু লিখে দিব নাকি!ধুর চিঠি ভালো লাগছে না।যেখানের যা চাহিদা সেখানে তা দিয়েই পূরণ করতে হয়।চিঠির যুগে চিঠি ,কম পয়সার কলরেটের সময় সেটা আর এই যুগের চ্যাট কিংবা ভিডিও কলের যুগে চ্যাট কিংবা ভিডিও কল।যুগের চাহিদা বলে একটা কথা আছে। রবীন্দ্রনাথরা কাগজে কলমে লিখত,তারও আগে মানুষ লিখত গাছের পাতায় কিংবা পাথরে আর আমি এখন লিখছি কম্পিউটারের কী বোর্ডে। রবীন্দ্রনাথকে যেমন কীবোর্ডে লিখতে দেখলে বিশ্রী লাগবে তেমনি আমাকেও পাথরের উপর লিখতে দেখলে মানুষ হাসবে।
আমি মিহরিমার নাম্বার ডায়াল করে তাকে কল দিলাম।আমার পরিচয় দেয়ার পর মিহরিমার প্রথম কথা, কি জুনিয়র ? কি খবর ?আমি কোন কথা না বলেই ফোনটা কেটে দিলাম। এরপর ফোন অফ করে দিলাম।সামান্য দুই ক্লাসের ক্লাসের বড়, সেজন্য সে আমাকে জুনিয়র জুনিয়র করতে পারেন না।পৃথিবীতে আমিই প্রথম প্রসপেক্টিভ জুনিয়র প্রেমিক না। আর আল্লাহ্ সমগ্র মানবকূলকে এক সাথে সৃষ্টি করেছেন তার পর যার যখন সময় সেভাবে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন।সে হিসেবে আমরা সমান সমান।ফোন অফ করে আমি ঘুমাতে যাই ।যদিও সারারাত আমি ঘুমাতে পারি নি।প্রথমবার প্রেমে পড়লে মানুষ ঘুমাতে পারে না ।এর পিছনে অনেক হরমোনাল হিসাব নিকাশ আছে।সেসব হিসাব নিকাশে না গিয়ে আমি বিরস মনে আমাদের দুইজনের হিসাব নিকাশ করছি।এক সাথে হেঁটে চলার হিসাব।এক সাথে গল্প বলার হিসাব। এক সাথে একটা জীবন কাটিয়ে দেয়ার হিসাব।
সে রাতে আর ফোন অন করি নি আমি।সারারাত এত কিছু ভাবতে গিয়ে ফোন অন করার সময় কই ? কার জন্য ফোন অন করব?কেন করব?পরদিন সকালে ফোন অন করলাম আমি। ফোন অন করতেই মেসেজ আসল। "তুই কালকে সকালে আমার সাথে ক্যাফেটেরিয়ার সামনে দেখা করবি ।ঠিক এগারোটায় ।" এটা কি হলো! একেবারে তুইতে চলে গেল সে?আমি মোটামুটি ভয় পেয়ে গেলাম।আর যাই হোক সে আমার সিনিয়র। আমি যে প্রেমে মাতাল সেটা উনি হয়তো বুঝে গেছেন অথবা ফোন কেটে দিয়ে অফ করে দেয়াকে তিনি বেয়াদবি হিসেবে নিয়েছেন ।আমার সব রাগ অভিমান মুহূর্তেই ভয়ে রূপ নিলো।খুব কাছের মানুষের সাথে রাগ অভিমান করা যায় ।মিহরিমা আমার এমন কেউ না যে আমি রাগ অভিমান দেখাব।মাত্র একদিনের পরিচয় আমাদের।একদিন সুন্দর করে কথা আর এক রাতের সুলতানী স্বপ্ন আমার সব উলট পালট করে দিয়েছে ।ঝামেলাটা করেছে আমার সুলতানী স্বপ্ন।না হয় তেমন কিছু আমি চিন্তা করার সাহস পেতাম না।ধুর, নিশিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেই এত ঝামেলায় যেতে হতো না আর।আচ্ছা নিশির মায়ের সাথে বাবার কি হয়েছিল? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।বাবা আমাকে শুধু বলেছেন তার চরিত্র নষ্ট করতে চেয়েছিলেন,খারাপ মহিলা।আমার মা কিছুই জানেন না। আমি কি নিশির মাকে জিজ্ঞেস করব এই বিষয়ে?
আমি ১১ টা বাজার আধা ঘন্টা আগেই ক্যাফেটেরিয়ার সামনে হাজির।ডেটিং করতে আসলে আধাঘন্টা পরে আসলেও চলত।এতে করে প্রেমিকা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সুযোগ পাবে।এই সময়ে সে কিছু রোমান্টিক দৃশ্য চিন্তা করার সুযোগ পাবে কিংবা আশে পাশের পরিবেশ দেখে আঁচ করার সময় পাবে আজকের প্রেমের আবহাওয়া কেমন। প্রকৃতির আবহাওয়ার খবর দিতে আবহাওয়া অধিদপ্তর থাকে কিন্তু প্রেমের আবহাওয়ার খবর কেউ দেয় না।এটা নিজেকে বুঝে নিতে হয়।আর এটা মেয়েরা ভালো বুঝতে পারে।এজন্য ছেলেরা ইচ্ছে করে পরে এসে তাদের আবহাওয়া বুঝার সুযোগ করে দেয় ।কিন্তু এখন আমার বিচার হবে । এখন আমাকেই আগে আগে আসতে হবে।ডিসিপ্লিন এর জন্য জেল খানায় শাস্তি মওকুপ করা হয় ।কেউ ভালো ডিসিপ্লিন দেখালে তার শাস্তি কিছুটা কমানো হয়।আধা ঘন্টা আগে আসাতে আমাকে হয়তো মাফ করে দেয়া হতে পারে।কিংবা আমার শাস্তি কিছুটা কম হবে।যাক আমার মাথা থেকে প্রেম টেম সবে উবে গেল।এখন আমি ওয়ারেন্ট ভুক্ত আসামী।একটু পর আমার বিচার করবেন জনাবা মিহরিমা নূর।
ভার্সিটির গেটে ঢুকতেই আমি মিহরিমার দেখা পেয়ে গেলাম। ক্যাফেটেরিয়া পর্যন্ত যাওয়া লাগল না। কারণ আমি আধাঘন্টা আগে এসেছি। আধাঘন্টায়ই আদালত ক্যাফেটেরিয়ায় স্থানান্তরিত হওয়া সম্ভব।আমাকে দেখে সে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।সঙ্গে কেউ নাই।যাক ভালোই হলো। ভার্সিটিতে কোন মেয়ের সাথে কোন ঘটনা ঘটলে সে একটা বিশাল আদালত বসায়।তখন অনেক বন্ধু এসে বিচার করে যায়।যাক আমার বিচার একা একাই হবে।কে জানে! ক্যাফেটেরিয়ায় হয়তো সবাই অপেক্ষা করছে।
কাল রাতে ফোন কেটে দিলে কেন? মিহরিমা বলল।
ভুল নাম্বারে কল দিয়েছিলাম তাই, আমি বললাম।
মিহরিমা বলল, ভুল নাম্বার?আমার নাম্বার তো ঠিকই আছে।
আমি বললাম, দেখ, আমি তোমার জুনিয়র ঠিক আছে। কিন্তু বারবার এটা মনে করিয়ে দিতে হবে না। আমি সেটা জানি।এটা আমার খুব বিরক্ত লাগে।
তো ? আমি কি তোমাকে বলব কি জানু,বেবি কেমন আছো?? মিহরিমা একটু রাগত স্বরে বলল।
রাগলেও কোথায় যেন একটু ঘাটতি আছে।মেয়েদের রাগ,অভিমান, হাসি এসব নকল হলে খুব সহজেই ধরা পড়ে যায়।ধরা পড়ে না শুধু কান্না ।এরা খুব সুন্দর করে মিথ্যা কান্না কাঁদতে পারে। এটা যে কারো বুঝার সাধ্য নাই।
আমি রাগকে পাত্তা না দিয়ে বললাম , জানু ,বেবি ডাকার সময় হলে ডাকবে।
আচ্ছা তাই নাকি! তা কবে হবে সময় ? মিহরিমা বলল।
আমি বললাম,যেকোন সময়।এখনো হতে পারে।
মিহরিমা বলল,রিকশায় ঘুরবে?
আমি বললাম ,চলো।
এরপর সে এক রিকশাওয়ালাকে বলল সারাদিন ঘুরব ।কত নিবেন ? রিকশাওয়ালা বলল, আপা, আপনার যা মন চায় দিয়েন।মিহরিমা আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল, উঠো।
রিকশায় উঠার পর প্রেমিক প্রেমিকারা সধারণত রিকশার হুড তুলে দেয়।রিকশাওয়ালা হুড উঠাতে গেলে মিহরিমা বলল, উঠানো লাগবে না ।তারপর বলল, খোলা আকাশের নীচে কথা বলে মজা আছে কথাগুলো স্বস্তি পায়।শ্বাস নিতে পারে ঠিক মত অক্সিজেন পায় প্রচুর ।
আমি বললাম, তাহলে যারা হুড তুলে সারাক্ষণ কাটায় তাদের কথাগুলো অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় না কেন?
মিহরিমা বলল,তাদের কাছে অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকে।একটা মাস্ক দুজন মানুষের মুখে লাগানো থাকে।
আমি বললাম, সেটা আবার কি !
মিহরিমা বলল,প্রেম।
*চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১২:১৭