“পোড়া কপাল আমার! নাতবউ যে বয়সে আমাকেও হার মানাইল। ” এই কথাটা হৈমন্তীকে নিয়ে বলেছিলেন অপুর দূর সম্পর্কের কোনো-এক দিদিমা। অপুকে নিয়ে বলার কিছু নাই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লিখা হৈমন্তী গল্পের নায়ক। আমি অপু টপু কেউ না।
আমি আবিদ চৌধুরী।তবু বলা যায় প্রায় এই রকম একটা কথাই আমার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে বললেন আমার সম্পর্কের এক খালা।নিজের স্ত্রীর বয়স নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন একজন এটা দেখতে কারো ভালো লাগবে না।শুধু স্ত্রীর নয় যে কারো বয়স নিয়েই কথা বলা ঠিক না কারণো বয়স মানুষের জন্য শুধু একটা সংখ্যা মাত্র।
মায়ের রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার কানে কথাটা আসল।আমি একবার ভাবলাম উনাকে বলি আপনার সমস্যা কি তাতে?আমি বুড়া বিয়ে করি নাকি বাচ্চা কাউকে করি তাতে আপনার সমস্যা কি ?আমি কিছু বললাম না ।কারণ উনার সমস্যা কি সেটা আমি জানি।তিনি কি উদ্দেশ্যে এসব বলে যাচ্ছেন তা কারোরই বুঝতে বাকি নাই।এটা মোটামুটি ওপেন সিক্রেট।প্রায় সাত আট বছর আমার মায়ের পিছনে ঘুরে উনি উনার মেয়েকে আমার জন্য প্রায় ঠিকই করে ফেলেছিলেন।আমার বাবা মারা যাওয়ার পরপরই উনি আমার মায়ের কছে বায়না ধরেছেন।কিন্তু বাবা থাকতে কখনো বলতে সাহস পাননি।কেন পাননি সেটা আমি জানি।আমার বাবার চরিত্র নষ্ট করতে চেয়েছিলেন তিনি।কিন্তু তিনি পারেন নি।তবুও তিনি পিছু ছাড়েন নি।তিনি এখন আমার পিছনে লেগেছেন।আমার সদ্য বিয়ে করে আনা বউকে নিয়ে যা তা বলছেন। আমি কোনভাবেই উনার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হই নি কখনো কিংবা আমার বউ হিসেবে চিন্তা করতেও পারি না।কারণ বাবা আমাকে তার থেকে দূরে থাকতে বলে গিয়েছেন।
তবু উনি প্রায় নিজে থেকেই ঠিক করে ফেলেছিলেন আমার আর নিশির বিয়ে।নিশি হচ্ছে তার কন্যা।তিনি এটা করতে পেরেছিলেন কারণ আমার মা কোন কিছুই জানতেন না ।নিজের স্বামীর চরিত্র নষ্ট করতে চাওয়া একজনকে কেউ বেয়াইন বানাবে না।যদিও উনার মেয়ে সুন্দরী এবং গুণবতী।মা প্রথম প্রথম রাজি না হলেও আমার বিয়ে করার সময় আসলে তিনি এক প্রকার কথা দিয়ে দেন উনার সম্পর্কের বোনকে।কিন্তু আমি বিয়ে করি আমার চেয়ে দুই বছরের বয়সে বড় একজনকে ।বয়সের হিসেবে দুই বছর খুব বড় কিছু না ।তবে আমার মত দেখতে বাচ্চাছেলের জন্য মিহিরিমাকে একটু বয়সীই মনে হয়।আর মেয়েদের বয়স খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে বলে আমার মনে হয়।এর একটা কারণ থাকতে পারে।জগত সংসারের ভয়ংকর ভয়ংকর রূপ দেখতে দেখতে একটা মেয়ে বেড়ে উঠে।ক্লান্তি ,অসহায়ত্ব তার দ্রুত বয়স বাড়িয়ে দেয়।মেডিকেল সায়েন্স অন্য কিছু বলতে পারে।বলুক ,আমি আমার কথা বললাম।
কাকতালীয় ভাবে মিহরিমা আর আমার জন্মদিন একদিন আগে পরে।তবে সে আমার চেয়ে দুই বছরের বড় । ওহ বলা হয় নি ।মিহরিমা আমার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর নাম। পুরোনাম, মিহরিমা নূর ।বাংলা করলে দাঁড়ায় চন্দ্র আর সূর্যের আলো ।মিহরিমা সুলতান নামে অটোমান সাম্রাজের একজন শাহজাদী ছিলেন।তাঁর বাবা সুলতান সুলেমানের সাথে তিনি উসমানি খেলাফত ঘুরতেন।একদম ভ্রমণ বিলাসী শাহজাদী। আমার ধারণা আমার স্ত্রীও কোন শাহজাদী ।কিন্তু সুলতান সুলেমানের মত কোন সাম্রাজ্য কিংবা তাঁর মত কাউকে দেখি নি তার বাবার মধ্যে।এমন কেউ হলে হয়ত আমাদের বিয়েটা এরকম হত না।
মিহরিমার সাথে আমার পরিচয় আমাদের বিয়ের ঠিক ১ বছর আগে । একদিন ভার্সিটির গেটে দাঁড়িয়ে আছি আমি ।হঠাত দেখি একটি মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে । আমি তেমন তাকালাম না।মেয়েটি আমার কাছে আসতেই বলল, আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে ?
আমি বললাম, কি বিষয়ে ?
মেয়েটি বলল যেকোন বিষয়ে ।ধরুন -সমাজ ,ধর্ম ,ইতিহাস, রাজনীতি ,অর্থনীতি যেকোন বিষয় ।
আমি বললাম ,তাহলে শুরু করা যাক।
মিহরিমা আমার সামনে এমন ভাবে হাসি দিলো আমি তাকে না করতে পারলাম না।আর নিজ থেকে এসে আমার সাথে কথা বলতে চাইছে না করি কিভাবে!এই শহরে তো আমি কাউকে এত সুন্দর করে কথা বলতে দেখিনি!আমি তাও বললাম, আমি তো আপনাকে চিনি না।
মিহরিমা বলল চিনেন না চিনবেন ।
তারপর হাত দিয়ে দূরে দেখাল ।ওই যে মানুষের মত একজনকে দেখছেন ? তিনি আমার খুব পরিচিত ।এতই পরিচিত যে বলতে হবে উনি আমার রক্ত সম্পর্কীয় ।আমি এখন তাকে চিনি না ।আপনি আমাকে অপরিচিত ভাবছেন আর আমি আমার অতি পরিচিত মানুষই চিনতে পারছি না ।
আমি বললাম ,আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ।
মিহরিমা একটা জোর করা হাসি দিয়ে বলল, আমি মিহরিমা ,মিহরিমা নূর । শুধু মিহরিমা বললে হবে না । বলতে হবে মিহরিমা নূর।মিহরিমা মানে জানেন ?
আমি বললাম, জানি না ।
সে একটা হাসি দিয়ে বলল, ১০০ জনের মধ্যে ৯৯ জনই পারে না ।শুধু আমিই জানি ।আর আমার বাবা জানেন ।মিহরিমা মানে চন্দ্র ও সূর্য।শুধু মিহরিমা ডাকলে আমার নাম দাঁড়ায় চন্দ্র ও সূর্য।কেমন বিশ্রী লাগে না । এজন্য পুরা নাম ধরেই ডাকা লাগবে।মিহরিমা নূর, মানে চন্দ্র ও সূর্যের আলো । আমি শুধু আলোটাই ।চন্দ্রের কলংক আমার মধ্যে থাকবে না এটা বাবাকে দেয়া আমার একমাত্র প্রতিজ্ঞা।বাবাকে দেয়া প্রতিজ্ঞা মেয়েরা ভাঙতে পারে না।
মেয়েটা সেদিন একাই বকবক করে গিয়েছিল ।আমাকে কিছুই বলতে দেয় নি।আমি ও কেন জানি শুনছিলাম মনোযোগ দিয়ে ।আর ভাবছি একজন মানুষের নাম এত সুন্দর হয় কি করে ? মিহরিমা নূর।আহ ! কি অসম্ভব সুন্দর একটা নাম। সুলতান সুলেমানের কন্যার বিয়ে হয়েছিল রুস্তম পাশা নামের একজনের সাথে ।রুস্তম পাশা ছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী একজন উজির।মিহরিমার সাথে দেখা হওয়ার পর সেদিন রাতে আস্ত একটা রাজপ্রাসাদ স্বপ্নে দেখি ।যেখানে আমি নিজেকে একজন রাজপুত্র হিসেবে আবিষ্কার করি । রাজপ্রাসাদে বিয়ের তোড়জোর চলছে।রাজপুত্রের বিয়ে ।পাত্রী হিসেবে দেখা যাচ্ছে আজকেই পরিচিত হওয়া মিহরিমা নূরকে।কি সুন্দর তার চাহনি!
তবে এখানেও একজন ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করছে ।ওই যে আমার ওই দূর সম্পর্কের খালা। তিনি তাঁর কন্যাকে রাজ পরিবারের একমাত্র উত্তরসূরীর কাছে বিবাহ দিতে চাইছেন ।রাজা সব কিছু জেনে গেলেন।কেন জানি ঘুমের মধ্যেই আমি বাবাকে মিস করা শুরু করলাম।এরপর রাজা তাকে আর তার মেয়েকে বন্দী করলেন কারণ রাজপুত্র কোনভাবেই এই বিয়ে করবে না ।রাজপুত্র বিয়ে করবে অটোমান সাম্রাজ্যের রাজকন্যা মিহরিমাকে ।তবে ঢাকা থেকে অটোমান সাম্রাজ্যে যেতে হলে অনেক সময় লেগে যাবে।রাজা হুকুম দিলেন অনেক গুলো বিমান প্রস্তুত করতে ।তিনি হুকুম করে বলছেন,রাজ প্রাসাদ থেকে রাজপুত্র বিশাল বর যাত্রীর বহর নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর যাবেন প্রথমে এরপর সেখান থেকে সোজা ইস্তাম্বুল ।ইস্তাম্বুল যাওয়ার পথেই আমার ঘুমটা ভেঙে যায়।
হঠাত ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আমি নিজেকে আবিষ্কার করি হলের খাটে।ঘুম তো ভাঙে নি পুরো রাজ বিয়েটাই নষ্ট হয়ে গেল।কই গেলো আমার মিহরিমা! কই গেলো আমার বাবার রাজত্ব !
পরদিন আবার ভার্সিটিতে ওর সাথে আমার দেখা হলো ।আমাকে ডাক দিয়ে বলল, এই যে এদিকে আসুন ।আমি কাছে গেলাম ।এরপর বলল,কালকে শুধু আমিই বকবক করে গেছি ।আসলে মনটা ভালো ছিল না ।অনেকদিন পর বাবাকে দেখলাম তো । আমি বললাম বাবাকে দেখলে তো মন ভালো হওয়ার কথা ।
মিহরিমা বলল,হ্যাঁ, বেশি মন ভালো হলে মাঝে মধ্যে বিরক্ত লাগে।আর সে বিরক্তি কাটাতে বকবক করা লাগে আমার ।যাকে সামনে পাই বকবক করে যাই ।কিন্তু এই প্রথম কাউকে দেখলাম এত মনোযোগ দিয়ে আমার বকবক শুনছিল।আপনি একটা কথাও বলেন নি কেন ? আপনি জানেন আমি কতক্ষণ একটানা বকবক করে গিয়েছি ।
আমি বললাম,ঘন্টা খানেকের মত ।
বাহ হিসাব তো ঠিকই রাখেন ।মিহরিমা বলল।
আমি বললাম, সেটা না আমি মোটামুটি ধারণা করে বলেছি ।আর সময় সম্পর্কে আমার ধারণা ভুল হয় না ।
মিহরিমা বলল,বাব্বা! একদম ভাবওয়ালা কথা বার্তা দেখি।
আমি বললাম, মজা করলাম ।
সে আমার সম্পর্কে জানতে চাইল ।আমি বললাম আমার নাম আবিদ চৌধুরী। ইকোনমিক্স সেকেন্ড ইয়ার।হলে থাকি ।আপনি ? মিহরিমা হাসতে হাসতে বলল, জুনিয়র! হা হা হা ।এজন্যই আপুর ভয়ে চুপ ছিলে ? হা হা হা।
এরপর বলল সে বোটানি তে পড়ে। এবার ফাইনাল দিবে । কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যেতে চাইল।
আমি বললাম, আপনার নাম্বারটা দেয়া যাবে ?
মিহরিমা বলল, হ্যাঁ ছোটভাই দেয়া যাবে ।আমার মেজাজ গেল খারাপ হয়ে ।আমার সাম্রাজ্যের রাণী আমাকে বলছে ছোটভাই ।পৃথিবীর ইতিহাসে এমন রাণী পাওয়া যাবে না যে তাঁর স্বামীকে ছোটভাই বলে সম্বোধন করেছে।
চলবে.........
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১১:৪৬