গহীনে কান পেতে শব্দ শোনার অভ্যাসটা আমার আর গেল না। সব কিছু ছেড়ে আসার পরও আমি কোন কিছু ছাড়তে পারি নি ।আজ অর্পিতার বিয়ে ।এদিনটি দেখার জন্যই আমি এতদিন বেঁচে ছিলাম।আজকে আমি নিশ্চিন্তে মরে যেতে পারব ।অর্পিতাকে আমি বলেছিলাম তার বিয়ের প্রথম ছবিটা যাতে আমি পাই । অর্পিতা বিয়ের সাথে সাথেই আমাকে ছবিটা পাঠাল ।
বিয়ের মোটামুটি আনুষ্ঠানিকতা সেরেই অর্পিতা আমাকে ছবিটা পাঠিয়েছে আমি জানি।মেয়েটা আমাকে না জানিয়ে গত এক বছর কিছুই করেনি । আজকেও করবে না আমি জানতাম।আমি জানি সে আমাকে ছবিটা পাঠাবেই ।আমাকে বলতে মুহিবকে ।সে যখন আমাকে ছবিটা পাঠায় তখনও জানে যে আমি মুহিব ইসলাম ।এখনো তাই জানে ।মুহিব ইসলাম কখনো মিনার আহমেদ হয়ে তার সামনে যেতে পারবে না ।কিংবা মিনার আহমেদ কখনো যাবে না।মিনার আহমদে জানে “ অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার ধরিয়া রাখার মত বিড়ম্বনা আর হয় না
মুহিব ইসলাম তার গত এক মাসের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ।যদিও তাদের মধ্যে কখনো দেখা হয় নি ।এই ইন্টারনেটের যুগে দেখা হওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ না। অর্পিতার কাছ থেকে মিনার আহমেদের বিদায় নেয়ার পর এই মুহিবই অর্পিতার সুখ দুঃখের বন্ধু ।এক বছরেই মুহিব হয়ে ওঠে অর্পিতার অন্যতম কাছের বন্ধু ।আমি ছাড়া অর্পিতার আর তেমন কোন বন্ধু ছিল না ।চারটি বছর আমাকে সে সময় দিয়েছে।আমি দেই নাই কি ?এই সময়ে অর্পিতা কারো সাথে খেতে গিয়েছে কিনা আমি জানি না। সম্ভবত যায় নি ।গেলে সে মুহিব ইসলাম নাম ধারী আমাকে কখনো জিজ্ঞেস করত না সব কিছু ।আমি এখন শুধু তার অনলাইনে আসার অপেক্ষা করি । কখনো সে আসে, কখনো আসে না ।
আমি চলে যাওয়ার পর আমাকেই আমার অভাব পূরণ করতে হলো। আমি বিশ্বাস করি কোন নির্দিষ্ট মানুষের অভাব শুধু ওই মানুষটাই পূরণ করতে পারে ।ধরা যাক একজন মানুষের খুব প্রিয় মানুষ মারা গেল । এখন তাকে তো কবর থেকে তুলে এনে আবার জীবিত করা যাবে না । এখন হয় কি তার সাথে স্বপ্নে দেখা হয় সে মানুষটার । এই ব্যাবস্থাটা উপরওয়ালা করে দেন। এই স্বপ্নের অল্প কিছু সময় সে মানুষটাকে খুঁজে পায় কিছু সময়ের জন্য ।এরপর ঘুম ভেঙে যায় । মানুষটা ভাবে ঘুম কেন ভেঙে যায় ?অনন্তকাল কি স্বপ্ন দেখা যায় না ? অনন্তকাল কি ঘুমানো যায় না ? মানে কি ! সে কি নিজেও তখন পরপারের বাসিন্দা হতে চায় ! হুম সেটাই হয় সম্ভবত ।তবু এরপর নতুন দিন শুরু হয় ।নতুন সময় ।সব ভুলে আবার বেঁচে থাকা হয় ।কি অদ্ভুত বেঁচে থাকা! বেঁচে থাকার আনন্দটা মরে যাওয়ার আনন্দের(!) চেয়ে অনেক সুখের ।
মিনার নামটাকে দূরে ফেলে তাই মুহিব সেজে এই এক বছর আমিই অর্পিতার পাশে ছিলাম ।মুহিবের এই চাকুরিটা আমিই দিয়েছি । কেন দিয়েছি সেটা আমার ব্যক্তিগত বিষয় ।আমার ব্যক্তিগত কিছু আমি আপাতত জানাতে আগ্রহী নই ।অর্পিতার সাথে নতুন করে পরিচয় নিয়ে কথা বলা যাক ।
অর্পিতাকে নতুন একটা আইডি খুলে প্রথমদিন মেসেজ দিলাম ফেসবুকে ।মেসেজটা ছিল অনেকটা এরকম -
“আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনার সাথে পরিচিত হওয়া উচিত ।আমার কাছে মনে হচ্ছে আপনার সাথে পরিচয় না হলে আমার জীবনের কিছু ভালো সময় থেকে আমি বঞ্চিত হব ।“
অর্পিতা আমার মেসেজ রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করল । আমাকে বলল কেন আপনার মনে হলো এমন ? আমি বললাম তেমন কিছু না ।মনের ইচ্ছে হলো ইচ্ছে পূরণ করলাম মেসেজ দিয়ে। আজ বাদে কাল মরে গেলে এসব ইচ্ছা আমাকে ভূত হয়ে আমারই ঘাড় ভাঙবে ।মৃত মানুষ মৃত মানুষের ঘাড় ভাঙবে! হা হা হা ।আপনাকে ধন্যবাদ ইচ্ছাটা বড় করে পূরণ করে দিয়েছেন তাই।অর্পিতা আমার কথায় বেশ মজা পেল ।
এরপর থেকেই ওর সাথে আমার আবার আগের মত কথা বার্তা চলছে । বার্তাই চলছে শুধু ।কারণ একদিন সে কথা বলতে চাইল ।আমি বললাম আমি কথা বলতে পারি না ।মানে বোবা । আমার খুব ইচ্ছে করছিল ওর সাথে কথা বলি । কিন্তু যে কন্ঠ সে শুনতে প্রতিদিন সকালে আমাকে ফোন দিত সে কন্ঠের প্রতিটা উচ্চারণও তার মুখস্ত।আমার মুহিবকে বিপদে ফেলার কোন ইচ্ছা নাই । মুহিব বিপদে পড়লে মিনার বিপদে পড়বে ।এরপর আমার বাকী দিনগুলোতে অর্পিতা বিহীন কাটাতে হবে।
আমি ওর বিয়ের ছবিটা দেখছি । অর্পিতাকে বেশ লাগছে দেখতে । পাশের ভদ্রলোক শুধু একজন বউ পাবে কিন্তু অর্পিতাকে কখনো পাবে না ।অর্পিতা শুধু আমার । মুহিবের সাথে পরিচয়ের দিনে অর্পিতা বার বার আমার কথাই বলেছে ।মেয়েটা কি অদ্ভুতভাবে আমাকে ভালোবেসেছিল। বেসেছিল বললে ভুল হবে অর্পিতা এখনো আমাকেই ভালবাসে।
আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার দিনে অর্পিতা খুব কেঁদেছিল । আমি কিছুই করি নি ।আমার তেমন কোন অনুভুতিই ছিল না তখন । অর্পিতা যখন বারবার আমার হাত ধরে রাখছিল তখন আমি কিভাবে কত দ্রুত তাকে ছেড়ে আসা যায় সেটা ভাবছিলাম । আমি ঠিকঠাকই অর্পিতাকে ছেড়ে আসতে পেরেছিলাম । আসলে কি ছেড়ে আসতে পেরেছি ? কে জানে ।আমি জানি না ।আমি জানি আমার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে । আমাকে হারিয়ে যেতে হচ্ছে । আমি হারিয়ে যাব ।আবার হয়তো স্বপ্নে দেখা করে যাব অর্পিতার সাথে ।আচ্ছা, যে স্বপ্ন দেখে সে যে একটা অনুভুতি পায় যে স্বপ্নে আসে তার কি কোন অনুভুতি পাওয়ার অধিকার আছে ?
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৩:১৮