আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। তথাকথিত বিশ্ব ভালবাসা (নাকি নিষিদ্ধ আশা) দিবস। ঘটা করে পালিত হচ্ছে সারা দেশে। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতি থেকে শুরু করে প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া, মায় অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যন্ত এ দিনটিকে ভালবাসায় একেবারে সিক্ত করে দেয়ার জন্য কোমর বেঁধে ময়দানে অবতরণ করেছেন। রাস্তার ধারে ধারে ফুলের পসরা। মৌসুমী ফুল ব্যবসায়ীদের পকেট আজ ফুলেফেঁপে উঠবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কারণ, যেভাবে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে, তাতে ফুল ব্যবসায়ীদের আজ পোয়াবারো না হয়ে উপায় আছে? আর সেই ফুল হাতে কপোত-কপোতিরা জোড়ায় জোড়ায় মহাসমারোহে দিবসটি পালন করার যজ্ঞে মেতে উঠেছে।
তো কথা হচ্ছিল তথাকথিত বিশ্ব ভালবাসা দিবস নিয়ে। এই দিনটির ইতিহাস নতুন করে কপচানোর আর প্রয়োজন মনে করি না। কিন্তু তথাকথিত এই ভালবাসা দিবস আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিতে কিভাবে অনুপ্রবেশ করল সেটা নিয়ে আমি রীতিমত বিস্মিত! বিদেশি সংস্কৃতি এদেশে অনেক আগে থেকেই অহরহ অনুপ্রবেশ করে আসছে। সেগুলোকে বিভিন্নভাবে মডিফাই করার আপ্রাণ চেষ্টা করে শেষপর্যন্ত এদেশের সংস্কৃতির সাথে খাপ খাওয়ানোর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মোটামুটি সফলকাম হতে পারা গেছে। বাঙালিকে বোঝাতে সক্ষম হওয়া গেছে যে বিদেশি সংস্কৃতি মানেই খারাপ কিছু নয়। এখন প্রতিবেশি দেশের অনেক ধার করা সংস্কৃতিও আমাদের স্বকীয় সংস্কৃতির সাথে তেলে জলে মেশার মত মিশে একাকার হয়ে গেছে। আর এসব নিয়ে তথাকথিত কাঠমোল্লাদের আপত্তিজনক লাফালাফিকে বরাবরই জাস্ট ইগনোর করে আসা হয়েছে। কিন্তু আজকের এই দিনের মাহাত্ম্য কিছুতেই আমার মত গণ্ডমূর্খ স্থূল বোধসম্পন্ন মস্তিষ্কে ঢোকানো যাচ্ছে না। প্রতিবেশি দেশের অনেক ধার করা সংস্কৃতি আমাদের স্বকীয় সংস্কৃতির সাথে কিছুটা মিললেও এই সংস্কৃতিটা যে একেবারেই আনকোরা! কোনভাবেই তো এটাকে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মেলাতে পারলাম না। শুধু ইসলামী বিশ্ব নয়; মধ্যযুগে সমস্ত ইউরোপে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ উদযাপন দীর্ঘকাল নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে ইংরেজি সাহিত্যের জনক জিওফ্রে চসার তার পার্লামেন্ট অব ফাউলস (১৩৮২) এর মধ্যে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ নিয়ে লেখেন। এরপর উইলিয়াম শেকসপিওরসহ খ্যাতিমান সাহিত্যিকগণ এ বিষয়টিকে সাহিত্যের উপাদান হিসেবে নিয়ে আসেন। ১৬৬০ সালে রাজা চার্লস টু আবার দিবসটি পালনের প্রথা চালু করেন।
২০১৪ সালে সৌদি আরবের ধর্মীয় পুলিশ ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ উদযাপনের দায়ে ১১ জনকে গ্রেফতার করেন। তাছাড়া ইরান, পাকিস্তান, মালয়েশিয়াসহ ইসলামী বিশ্বে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ উদযাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ভারতের মত দেশেও নিজস্ব সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় দিবসটি পালনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সূত্রঃ Click This Link
মাত্র দুই দশক আগেও এ দিনটির মাহাত্ম্য সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা ছিল না। আর ইদানিং রীতিমত ঘটা করে এই দিবসটিকে আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি বিলিয়ে দেয়ার (সবক্ষেত্রে নয়) মাধ্যমে উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে পালন করে থাকি। আমার কাছে মনে হয় এই দিনটিকে বিশ্ব ভালবাসা দিবস না বলে বিশ্ব প্রেম দিবস বললেই যথাযোগ্য মর্যাদা (?) দেয়া হবে। কারণ, ভালবাসার অর্থটা আমার কাছে ব্যাপক। ভালবাসা একজন পুরুষের জন্য পুরুষের হতে পারে। একজন নারীও আরেকজন নারীকে ভালবাসতে পারেন। একজন শিশু, একজন কিশোর, একজন তরুণ, একজন যুবক, একজন প্রৌঢ় এমনকি একজন বৃদ্ধও তার সমলিঙ্গের কাউকে ভালবাসতে পারে। যেমন মা ভালবাসতে পারেন সন্তানকে, সে যে কোন লিঙ্গেরই হোক না কেন, তেমনি সন্তানও মা-বাবাকে ভালবাসতে পারে। ভাই ভাইকে, বোন বোনকে ভালবাসতে পারে। এভাবে আমি মনে করি ভালবাসার পরিধিটা ব্যাপক। কিন্তু এই সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে'তে তো ভালবাসার নামে দেহজ খেলাই বেশি হয়। এখানে ভালবাসা নামকাওয়াস্তে থাকলেও দেহজ খেলাটাই মুখ্য হয়ে থাকে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে যে ভালোবাসার জন্য জীবন দিতে হয়েছিল সে ভালবাসার তাৎপর্য আমরা সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছি কি না তা নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। তাই আমি মনে করি এই দিনটিকে বিশ্ব ভালবাসা দিবস না বলে বিশ্ব প্রেম দিবস বলা উচিত, তাতে করে ভালবাসার মত পবিত্র একটা শব্দকে কলুষিত হওয়া থেকে রক্ষা করা যাবে।
ভালবাসা ঘটা করে পালন করা বা সবাইকে ঢাকঢোল পিটিয়ে জানানোর জিনিস নয়। ভালবাসা বছরের প্রতিটি দিনই হতে পারে। কোন নির্দিষ্ট দিনকে এর জন্য স্থির করার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। একজন মা যখন তাঁর সন্তানকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে মনে মনে দোয়া করেন তখন সেটাই সবচেয়ে বড় ভালবাসা। একজন স্বামী বা স্ত্রী যখন তার সঙ্গীর দিকে গভীর আবেগপূর্ণ দিষ্টিতে তাকায় তখন সেটাও ভালবাসা। একজন সন্তান যখন মায়ের দিকে গভীর শ্রদ্ধা ও মায়ায় জড়ানো দৃষ্টিতে তাকায় তখন সেটাও ভালবাসা। এসব ক্ষেত্রে দেহের কোন অবদান নেই। হ্যাঁ, আজকের দিনে খাঁটি আর অকৃত্রিম ভালবাসায় কোন বিধিনিষেধ নেই। এমনকি স্বামী-স্ত্রীও একে অপরকে ভালবাসা জানাতে পারে, ভালবাসার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তারা ফিজিক্যালি মিলিতও পারে হতে পারে, তবে সেটার জন্য কোন একটি দিবসকে বেছে নেয়ার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। আজকের দিনে ভালবাসা নিষিদ্ধ এ কথাও আমি বলছি না। আমরা যে কোনো দিন ভালবাসার প্রকাশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে করতেই পারি কিন্তু আজকের তারিখে তথাকথিত বিশ্ব ভালবাসা দিবসের নামে যেসব বেহায়াপনা আর অশ্লীলতাকে সাদরে বরণ করে নিচ্ছি, যেভাবে নিজের মহামূল্যবান সম্ভ্রমকে সঙ্গীর জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছি সেটাকে কোনভাবেই ভালবাসা বলা যায় না, বড়জোর প্রেম বলা যেতে পারে।
তাই আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যেটা বুঝি সেটা হল- ভালবাসা কোন খারাপ জিনিস নয়, এমনকি এটা কোন দিবসের সাথেও সংযুক্ত নয়। ভালবাসা যে কোন দিন বা যে কোন সময়ে হতে পারে। তবে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে বা বিশ্ব ভালবাসা দিবসের নাম দিয়ে চরম অশ্লীলতা আর অবৈধ যৌনাচারের এই সংস্কৃতিকে কোনভাবেই সমর্থন করতে পারি না। আমি আমার পরিবারের কাউকে তথাকথিত এই বিশ্ব ভালবাসা দিবস পালন করতে উৎসাহিত তো করবই না এমনকি অনুমতিও দেব না। তাতে যদি আমাদের পারস্পরিক অকৃত্রিম ভালবাসায় কিছুটা ভাটাও পড়ে যায় তাতেও কোন আপত্তি নেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:৫১