বিশাল বাড়িটার গেটের বাইরে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি। একে একে দামি দামি গাড়ি হাঁকিয়ে অভ্যাগত মেহমানরা হুশ করে সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছেন। অবশেষে আমন্ত্রিত অতিথিদের প্রায় সবাই চলে যাওয়ার পর বাড়ির ভেতরে কেমন একটা নিরবতা নেমে এসেছে। শুধু একটি গাড়িই এখনও গাড়িবারান্দায় সগৌরবে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে।
আরও কিছুক্ষণ পর গাড়িটার আশেপাশে কিছু মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেল। কনের বাবা-মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুসজল চোখে কিছু কথা বলছেন মনে হল। সম্ভবত শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কেমন আচরণ করতে হবে সে ব্যাপারে মেয়েকে দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন। আরও কিছু পুরুষ-মহিলা কনেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে বিদায় করার শেষ আনুষ্ঠানিকতা সারছেন। একে একে সবাই কনেকে বিদায় জানানোর পর হরেক রকমের রঙ-বেরঙের ফুলে সাজানো অত্যন্ত দামি গাড়িটায় বর-কনে আসন গ্রহণ করল। ড্রাইভার অত্যন্ত দক্ষতায় খুব ধীরে ধীরে গাড়িটাকে চালিয়ে গেটের বাইরে নিয়ে এল। নিয়নসাইনের স্পষ্ট আলোয় খুবই সুন্দর করে সাজানো কনের অপূর্ব সুন্দর মুখটি ক্ষণিকের জন্য দৃষ্টিগোচর হল। গেটের বাইরে এসে ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। আমার ঠিক সামনে দিয়ে অত্যন্ত খুশিমনে পরম নিশ্চিন্তে নিজের ভালোবাসার মানুষটার সাথে হাসতে হাসতে চলে গেল মেয়েটা! নির্বাক হয়ে স্থাণুর মত কিছুক্ষণ নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণহারা মাতালের মত টলতে টলতে মেসের দিকে রওনা হলাম।
পরদিন ট্রেনে করে সন্ধ্যার দিকে নিজের বাড়িতে পৌঁছুলাম। মা আমার অপেক্ষায় বসে ছিলেন। আমার ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারা দেখে মা কিছু আঁচ করলেন কি না বলতে পারব না। আমি সটান বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ পর মা খেতে ডাকলেন। নিরবে খেয়ে যেতে লাগলাম। সাদামাটা খাবারও মায়ের হাতের যাদুস্পর্শে অমৃতের মত লাগে; কিন্ত আজ কেমন যেন বিস্বাদ লাগছিল। অল্প কিছু নাকেমুখে গুঁজে দিয়ে হাত ধুয়ে উঠে পড়লাম। ঘরের বাইরে এসে আকাশের দিকে অনেকক্ষণ নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলাম। আরও কিছুক্ষণ পর মা এসে ডেকে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন। নড়বড়ে খাটের একপাশে বসে মা'কে বসার জায়গা করে দিলাম।
-কী হয়েছে? সব খবর ভালো?' মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
-মা' বলে আমি মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম।
মা কিছুই না বলে নিশ্চুপ বসে রইলেন।
আমার কান্নার দমকে চোখ থেকে বেরিয়ে আসা বাঁধভাঙা অশ্রুর জোয়ারে মায়ের জীর্ণ শাড়িটা খুব দ্রুত ভিজে যেতে থাকল। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আমাকে সান্ত্বনা দিতে থাকলেন। তারপর আস্তে করে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে উঠে চলে গেলেন।
কালকের বেদনাদায়ক ঘটনাগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে পোড়াচোখে কখন যে ঘুম নেমে এসে আমাকে যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি দিয়েছে তা বলতে পারব না। ঘুম থেকে উঠে দেখি অনেক বেলা হয়ে গেছে। মা'কে ডাকতে ডাকতে তাঁর ঘরে প্রবেশ করলাম। দেখি তিনি নামায পড়ছেন। এত বেলা হওয়ার পরও কোন্ নামায পড়ছেন বুঝতে পারলাম না। বেশ কিছুক্ষণ পরও তিনি সেজদা থেকে মাথা তুলছেন না দেখে আবার মা'কে আস্তে আস্তে ডাকলাম। তিনি অনড় রইলেন। বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল। তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে তাঁকে আস্তে ঠেলা দিতেই তিনি জায়নামাযের উপর কাত হয়ে পড়ে গেলেন। 'মা' বলে বুকফাটা এক তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে তাঁর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে বিলাপ করতে লাগলাম।
মা'র কাফন-দাফন শেষ করে ঢাকায় ফিরে পুরনো মেসে উঠলাম। আগের কয়েকটা টিউশনি ছিল সেগুলোতে নতুন করে মনোযোগ দিলাম। একাকী জীবন কেটে যেতে লাগল। চাকরির চেষ্টা করার মনমানসিকতা আর ছিল না। রেজাল্ট খুব একটা ভালো নয়। তারওপর মামার জোর বা টাকাপয়সা কোনকিছুই নেই। নিদেনপক্ষে কোন রাজনৈতিক দলের সাথেও সখ্যতা নেই। তাই চাকরির আশা বাদ। গ্রামে বাড়িতে শুধু থাকার ভিটেটুকু আছে। সামান্য জমি ছিল সেটা বিক্রি করে আমার পড়ার খরচ যুগিয়েছেন মা। বাবা দরিদ্র স্কুলমাস্টার ছিলেন। গ্রাম্য এক কোন্দলের মধ্যে পড়ে অকালে প্রাণ হারান। আমার বয়স তখন সাত-আট বছরের মত। তারপর মা আমাকে অনেক কষ্টে লেখাপড়া শিখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছার ব্যবস্থা করেন। মা শিক্ষিতা ছিলেন। বাবার স্কুলমাস্টারের চাকরিটা পেয়ে যান। সেই মা, যিনি সারাটি জীবন দুঃখ আর কষ্টই সহ্য করে গেলেন। আর আমি তাঁর অপদার্থ ছেলে একটি মেয়ের জন্য আমার নিজের ভবিষ্যত আর মা'র সব আশা-আকাঙ্ক্ষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁকে মৃত্যু পর্যন্ত ঠেলে দিলাম!
মনে পড়তে লাগল ফারিহার সাথে কাটানো সুখস্মৃতিগুলোর কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কোন জায়গা ছিল না যেখানে আমাদের পদধুলি পড়েনি। ক্লাসের সবাই জানতো আমাদের দুজনের একে অপরকে ভালোবাসার কথা। আমি ওর ভালো রেজাল্টের জন্য কত পরিশ্রমই না করেছি। দিন নেই রাত নেই ওর পেছনে সময় দিয়েছি। যত নোট প্রয়োজন পড়ত সবই আমি ব্যবস্থা করে দিতাম। ওর পেছনে সময় দিতে গিয়ে নিজের পড়ালেখা গোল্লায় গেল। সবসময় ওর চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেত। পরীক্ষার পর দেখা গেল ওর রেজাল্ট আশাতীতভাবে ভালো হয়েছে আর আমারটা অনেক খারাপ। তারপরও সব মেনে নিয়েছিলাম। নিজের ভবিষ্যত, মা'র আশা-আকাঙ্ক্ষা সব তখন গৌণ ছিল আমার কাছে। ওর প্রেমে এতটাই বেহুঁশ ছিলাম যে একবারও নিজের আর মা'র কথা ভাবার ফুরসত পাইনি। অথচ সেই ফারিহা এখন অন্যের ঘরণী! আমার মত হাভাতের সাথে ও প্রেমের অভিনয় করেছিল শুধু ওর স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। আমি ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম। আমার সাথে যেচে আলাপ করে ও। কাছে আসার অভিনয় করে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে নিয়ে এখন বিরাট বড়লোকের এক ছেলের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে!
প্রায় দশটি বছর কেটে গেছে। আমি এখনও আগের মতই আছি। পরিবর্তনের মধ্যে এতটুকু হয়েছে যে আগে টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতাম আর এখন ট্যাক্সি চালাই। এক রুমের ছোট্ট একটা ভাড়া বাসায় থাকি। আমার মতই আরেকজন পাশের একটা রুম নিয়ে থাকে। কমন বাথরুম ব্যবহার করি। কিচেন নেই। রান্না করতে চাইলে রুমেই স্টোভ বসিয়ে সেটা করতে হয়। যদিও আমি বেশিরভাগ সময় বাইরেই খাই। এখন মোটামুটি কিছু সঞ্চয় হয়েছে। ভাবছি এই কবুতরের খোপটা ছেড়ে দিয়ে একটা দু'রুমের বাসায় উঠব। অ্যাটাচড্ বাথরুম আর কিচেন থাকতে হবে। রান্না তেমন না করলেও মাঝেমধ্যে চেষ্টা করে দেখব পারি কিনা। অগত্যা যদি রান্না না-ই পারি তাহলেও তেমন কিছু আসবে যাবে না। কম সে কম চা বানিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা তো অন্তত হবে।
এর মধ্যেই একদিন ধানমন্ডির নামকরা এক স্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখি এক সুন্দরী মেয়ে তার সাত-আট বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত ট্যাক্সির জন্য। আমি কাছাকাছি যেতেই হাত তুলে থামার জন্য ইশারা করল। কাছে গিয়ে ব্রেক কষে থামলাম। কাচ লাগানো গাড়ির ভেতর থেকে সম্ভাব্য যাত্রীর দিকে চেয়েই পাথর হয়ে গেলাম! মেয়েটা আর কেউ নয়, আমার এককালের ধ্যান-জ্ঞান, আমার জীবনের সবচেয়ে আরাধ্য মানুষ, আমার প্রাক্তন ভালোবাসা ফারিহা!
একবার ভাবলাম চলে যাই কিন্তু পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পাল্টে পেছনের দরজা খুলে দিলাম। দু'জন উঠে বসে বসল। মেয়েটা বলল উত্তরা চলুন। আমি গাড়ি ছেড়ে দিলাম। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম- যে মেয়ের স্বামী শহরের নামকরা ধনী, তিন-চারটে গাড়ি সবসময় যার বাড়ির গাড়িবারান্দায় দাঁড়ানো থাকে সেই মেয়ে ট্যাক্সিতে কেন? কিন্তু কোন উত্তর বের করতে পারলাম না। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ওর দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী বিশাল এক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম।
গাড়ি থামিয়ে জানালার কাচ নামিয়ে দিলাম। নেমে আমার দিকে ভালোমত না তাকিয়েই ও জিজ্ঞেস করল- কত এসেছে? মিটার দেখে টাকার অংকটা বললাম। পার্স থেকে টাকা বের করে ও আবছাভাবে একবার আমার দিকে তাকিয়ে টাকা দিয়েই ঘুরে গেটের দিকে রওনা হল। আমিও কিছু না বলে গাড়ি ছেড়ে দিলাম। ভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে দেখি ও আবার ঘুরে গিয়ে গাড়ির পিছন পিছন কয়েক কদম এগিয়ে আসতে আসতে আমাকে হাত ইশারায় থামতে বলছে। আমি না থেমে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম।
পরদিন রাতে গাড়ি কোম্পানীর গ্যারেজে জমা দিয়ে যখন ঘরে ফিরলাম তখন রাত এগারোটা পার হয়ে গেছে। শরীরটা ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে। কাপড়চোপড় না ছেড়েই মাত্র খাটে একটু পিঠ ঠেকিয়েছি এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল। স্ক্রীনের দিকে চেয়ে দেখি অপরিচিত নাম্বার। কোন প্যাসেঞ্জার হয়ত নাম্বার রেখে দিয়েছিল, এখন ফোন করে ট্যাক্সি ভাড়া করতে চায় মনে করে রিসিভ করলাম না। রিং বেজে বেজে থেমে গেল। মিনিটখানেক পর আবার বাজতে শুরু করল। চেয়ে দেখি সেই আগের নাম্বারই। বিরক্ত হয়ে কেটে দিলাম। কিছুক্ষণ পর আবার রিং। রেগে গিয়ে এতরাতে বিরক্ত করার জন্য প্যাসেঞ্জারকে কয়েকটা শক্ত কথা বলব ভেবে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সুরেলা নারীকন্ঠ ভেসে এল। কন্ঠটা শোনার সাথে সাথে চমকে সোজা হয়ে বসলাম! সেই পরিচিত কন্ঠ! এ কন্ঠস্বর আমি কেমন করে ভুলি? সারাজীবনেও কি এই কন্ঠস্বরের মালিককে ভুলতে পারব? না, পারব না। (চলবে)
ছবিঃ গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৮ রাত ৮:৩৩