আপনি জানেন কি?
ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অর্গানাইজেশন জানিয়েছে যে:
—অবসাদ জনিত ভারসাম্যহীনতা প্রায় ৫% প্রাপ্ত-বয়স্ক জনসাধারণের মধ্যে তাদের জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে দেখা যায়।
—অবসাদ, ২০২০ সালের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম মানসিক রোগের আকার ধারণ করবে।
—ভারতে পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে বেশী মাত্রাতে অবসাদের ঘটনা লক্ষ্য করা যায়।
অবসাদ বা ডিপ্রেশন কী?
কখন কি এই ভেবে অবাক হয়েছেন যে আপনার চেনা কেউ, যেমন কোন বন্ধু বা আত্মীয়, খুব দুঃখী, ক্লান্ত বা অন্যমনস্ক লাগছেন বেশ কয়েক দিন ধরে? আপনার হয়ত লক্ষ্য থাকবে যে মানুষটা খুবই শান্ত হয়ে গেছেন, রোজকার জীবনের কাজের কোনও ইচ্ছাই নেই; সঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া করছেন না বা মাঝে মাঝেই কাজের সময় মনঃসংযোগের অভাব ঘটছে। এই চিহ্নগুলো থেকেই বোঝা যায় যে সেই মানুষটি হয়ত বা ডিপ্রেশনে বা অবসাদে ভুগছেন।
অবসাদ হল একটি সাধারণ মানসিক ভারসাম্যহীনতা, যা মানুষের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি, ব্যবহার, সম্পর্ক, কর্মক্ষমতাকে আক্রান্ত করে; কখনও বা মানুষকে মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দেয়।
দুঃখের ঘটনায় সাময়িকভাবে দুঃখী বা অসুখী হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনও ভাবে যদি এই অনুভূতি অনেকদিন (দুই সপ্তাহের বেশি) ধরে চলতে থাকে অথবা এই ঘটনা খুব ঘন ঘন ঘটে এবং তা যদি স্বাভাবিক জীবন ও স্বাস্থ্যকে ব্যাহত করে, তখন তাঁকে অবসাদের চিহ্ন রূপে ধরে তাঁর চিকিৎসা করা প্রয়োজন হয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
অবসাদ কোনও দুর্বলতা বা মানসিক অস্থিরতার চিহ্ন নয়; এটা ডায়াবিটিস বা হার্টের রোগের মতই এক অসুস্থতা, যা যে কোন মানুষকে জীবনের যে কোনও সময় আক্রমণ করতে পারে।
অবসাদ চিকিৎসা দ্বারা সম্পূর্ণ সেরে যায়।
অবসাদের চিহ্নগুলি কি?
“কিছুদিন হল আমার খিদে নেই। সারাদিন ধরে আমার ঘুম পায়,কিন্তু রাতভর নানারকম দুশ্চিন্তাতেঘুমাতে পারি না। আমার কোনও কাজ করতে বা কারো সাথে কথা বলতে মন চায় না,বরং দিনভর নিজের ঘরে থাকতেই ভালো লাগে।যা কিছুই আমি করি না কেন মনে হয় সবই ভুল করছি।আমার কোনও মূল্যই নেই। কেউ আমাকে বোঝেই না...”
এই ধরণের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতি বুঝিয়ে দেয় যে এই ব্যক্তি হয়ত বা অবসাদে ভুগছেন। যদিও বা সব উপসর্গ একই ব্যক্তির মধ্যে দেখা নাও যেতে পারে; আবার রোগের উপসর্গ এবং প্রখরতা মানুষে-মানুষে বিভিন্ন হয়। অবসাদ মানুষের জীবনের যে কোনও পর্বেই দেখা যেতে পারে।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এই উপসর্গগুলি হল এই অবস্থার বিষয়ে অবগত করার উপায়। এটা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণেই যে এই উপসর্গগুলি দেখা গেলেই মানসিক স্বাস্থ্যের ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে সঠিক রোগ নির্ণয় ও উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি স্থির করতে সাহায্য করে।
কিছু কিছু উপসর্গগুলি হলঃ
বেশীরভাগ সময় মন খারাপ লাগা ও দুঃখী থাকা।
কোনও কিছুতেই উৎসাহ না পাওয়া ও রোজকার কাজ করতে অক্ষম হওয়া, সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়া, আগে যে কাজে উৎসাহ বোধ করতেন, এখন সেগুলি ভালো না লাগা।
মনঃসংযোগ ও চিন্তা-ভাবনা করার বা সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা।
আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি।
নিজের জীবন ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব।
বেশী খাওয়া বা একেবারেই খাবার না খাওয়া।
সব কিছুতেই নিজেকে দোষী মনে করা এবং অতীতের অসফলতার জন্য অন্যকে দায়ী করা; নিজেকে অযোগ্য মনে করা।
প্রায়ই কাজ থেকে ছুটি নেওয়া বা কাজ করতে না পারা।
ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিরাশ হয়ে যাওয়া।
অনিয়মিত ঘুম বা ঘুমাতে না পারা।
যৌন-জীবনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা।
শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা অনুভব করা, যেমন মাথা ব্যথা, ঘাড়ে যন্ত্রণা বা খিঁচ ধরা।
নিজেকে আঘাত করা বা আত্মহত্যা বা মৃত্যুর চিন্তা করা।
যদি আপনি উপরের কোনও উপসর্গ চেনা মানুষের মধ্যে লক্ষ্য করেন, আপনি তাঁকে মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেবার কথা বলতে পারেন।
অবসাদের কারণ কি?
অনেকগুলো উপসর্গের যুগ্ম প্রয়াসই হল অবসাদের কারণ; যার মধ্যে আছে জিনগত সমস্যা, জীবনের কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা দুশ্চিন্তা।
মানসিক বিকারঃ অনেক ক্ষেত্রে, নির্ণয় না হওয়া মানসিক ভারসাম্যহীনতা, যেমন অবসেসিভ কমপালসিভ ডিস্অর্ডার, সোশ্যাল ফোবিয়া ও স্কিৎজোফ্রেনিয়া-র রোগের পাশাপাশি অবসাদ বা ডিপ্রেশন প্রকাশ রূপে দেখা দেয়। এই সব ক্ষেত্রে মানসিক চিকিৎসকের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ খুবই জরুরি।
জীবনের চাপ বা দুশ্চিন্তাঃ একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের সাধারণ দুশ্চিন্তাগুলি কাজ সম্পর্কিত বা পরিবার অথবা বিবাহিত জীবন সম্বন্ধে বা অন্যান্য বিষয়েও হতে পারে।
শারীরিক স্বাস্থ্যের সমস্যাঃ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও থাইরয়েডের সমস্যা থেকেও অনেক সময় অবসাদ হয়ে থাকে। সেই কারণে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকের সাথে আলোচনার সাথে সাথে অনিয়ন্ত্রিত রোগগুলির কারণ অনুসন্ধান করাও দরকার। হার্টের রোগ, এইচ আই ভি বা ক্যান্সার-এর মত দুরারোগ্য রোগের সাথে লড়াই করতে করতে মানুষ অবসাদের শিকার হন।
পার্সোনালিটি বা ব্যক্তিত্বঃব্যক্তিত্বের সমস্যা অথবা বডি ইমেজ, অর্থাৎ অতিরিক্ত মোটা বা রোগা হওয়া, খুব বেঁটে বা লম্বা হওয়া নিয়ে সমস্যা, কম আত্মবিশ্বাস, সব কাজেই অসন্তোষ, স্কুল-কলেজ বা কর্মক্ষেত্রে চাপের সমস্যা – এই সবের মিলিত কারণেও অবসাদ হতে পারে বলে গবেষণায় জানা গেছে।
ড্রাগ বা মাদক পানে আসক্তিঃবেশীমাত্রায় অ্যালকোহল গ্রহণ অবসাদের কারণ। ড্রাগস বা অন্যান্য ক্ষতিকারক জিনিসের প্রতি আসক্তি মানুষকে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব থেকে আলাদা করে দেয়। অনেকদিন ধরে এই সবের সেবন মানুষকে অবসাদের দিকে ঠেলে দেয়।
নানান মানসিক কারণে বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে এই অবসাদ দেখা যায়। নিচের অংশে বর্ণিত আছে কি ভাবে অবসাদ বাচ্চা, মহিলা বা বয়স্কদের প্রভাবিত করে –
বাচ্চাদের অবসাদ
মহিলাদের অবসাদ
বয়স্কদের অবসাদ
কিভাবে রোগ নির্ণয় করা যায়?
প্রত্যেক ভারসাম্যহীনতাকে চিহ্নিত করার নিজস্ব পদ্ধতি আছে এবং মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকের সাহায্যে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে তবেই চিকিৎসা শুরু করা উচিত। রোগ নির্ণয় সঠিক না হলে তা রোগের জটিলতা বাড়িয়ে দেয় এবং রোগীর অবস্থাকে আরও খারাপ করে তোলে।
চিকিৎসার ইতিকথাঃ সাধারণত, একজন চিকিৎসক তাঁর রোগীর চিকিৎসার ইতিহাসের রেকর্ড রাখেন কারণ, অন্যান্য রোগ - যা থেকে এই অবসাদের উপসর্গ দেখা দিতে পারে - যাতে রোগীর থেকে দূরে রাখা যায়।
মানসিক মূল্যায়নঃ একজন মানসিক স্বাস্থ্য রোগ বিশেষজ্ঞ একগুচ্ছ প্রশ্নের দ্বারা রোগীর উপসর্গ, তাঁর চিন্তাভাবনা, অনুভূতি ও ব্যবহার সম্বন্ধে বিস্তারিত জ্ঞান লাভ করেন। তিনি উপসর্গগুলি কতক্ষণ দীর্ঘ হয়, কখন, কিভাবে তা শুরু হয়, তার জটিলতা এগুলোরও মূল্যায়ন করেন ও এই সকল উপসর্গ দ্বারা কিভাবে রোগীর চিন্তা ভাবনা ও ব্যবহার পরিচালিত হয় তাও নির্ধারণ করেন।
কোন ব্যক্তির মধ্যে যদি অবসাদের কমপক্ষে পাঁচটি লক্ষণ দিনের বেশিরভাগ সময় লক্ষ্য করা যায় এবং এই অবস্থা যদি দু-সপ্তাহের বেশী স্থায়ী হয় তখনই বলা যায় যে ওই ব্যক্তি অবসাদের শিকার। এই লক্ষণগুলিকে ওই ব্যক্তির কর্মক্ষেত্রে বা বাড়িতে তাঁর রোজের কাজ কে ব্যাহত করার মত প্রখর হতে হবে।
অবসাদের চিকিৎসা পদ্ধতি কি?
বেশিরভাগ সময় অবসাদজনিত সমস্যাকে লুকিয়েই রাখা হয় কারণ লোকে এই বিষয়ে কথা বলতে দ্বিধা অনুভব করেন। আমাদের মধ্যে অনেকেই মৃদু হেসে সমস্যার কথা জানাতে অস্বীকার করেন। কারণ, তাঁরা অন্যের কাছে নিজেদেরকে দুর্বল হিসাবে দেখাতে চান না। মানুষের এই দ্বিধাই তাঁকে অন্যের সাহায্য গ্রহণ থেকে বিরত রাখে। উপযুক্ত চিকিৎসা ছাড়া একজন রোগী শুধু শুধু দীর্ঘ সময় ধরে কষ্ট পান এবং তার পরিবারেরও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ান।
এই বিষয়ে না জানার কারণেও অনেকে অবসাদের চিহ্নগুলি সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারেন না। এই কারণে, অনেক সময় চিকিৎসা শুরু করতে অনেকটা দেরি হয়ে যায়; যা এই অবস্থাকে জটিল করে তোলে। প্রাথমিক পর্যায়ে অবসাদের জন্য নিজ সহায়তার পদ্ধতি, কাউন্সেলিং বা যে কোনও পদ্ধতিই রোগীর সেরে ওঠার জন্য যথেষ্ট। শুধুমাত্র অবসাদের জটিল অবস্থাতেই একজন রোগীর উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন হয়।
ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অর্গানাইজেশন অনুযায়ী, পৃথিবীর অন্য সব রোগের থেকে বেশী অবসাদ মানুষকে পঙ্গু করে দেয়। যদিও, অবসাদগ্রস্ত মানুষকে সহজেই সুস্থ করা যায় এবং তাঁরা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনও করতে সক্ষম হন।
অনেকভাবেই অবসাদের চিকিৎসা করা যায়। এটা নির্ভর করে রোগের জটিলতা, রোগীর স্বাস্থ্য এবং তার সুস্থ হয়ে ওঠার ইচ্ছার ওপর।
চিকিৎসক সাধারণত অ্যাণ্টিডিপ্রেসেণ্ট ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন।
একই সঙ্গে চলতে থাকা ডায়াবিটিস বা থাইরয়েডের সমস্যাকে সঠিক ভাবে নির্ণয় করে তার চিকিৎসা করা অবসাদগ্রস্ত রোগীকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে সাহায্য করে।
অবসাদের চিকিৎসাতে নানাবিধ সাইকোলজিক্যাল থেরাপিরও ভালো সাফল্য দেখা যায়। রোগীকে অনুদ্বিগ্ন থাকার পদ্ধতি শেখানো হয় যাতে ইতিবাচক চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পায়। এটা এক গুচ্ছ থেরাপি, যেমন কগ্নিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি, সাপোরটিভ থেরাপি, মাইন্ডফুলনেস-বেসড্ কগ্নিটিভ থেরাপি এবং অন্যান্য থেরাপি-র সাহায্যে করা যায়।
অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তির যত্ন
আপনি সব সময়ই অবসাদ গ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করতে পারেন। যদিও, এটা কিছুটা অসুবিধাজনক কারণ একজন মানুষ সহজে বিষয়টা মেনে নিয়ে সাহায্য চান না। তাও যদি আপনি উপরে বর্ণিত কোনও না কোনও উপসর্গ কোন চেনা মানুষের মধ্যে লক্ষ্য করেন, তাঁকে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে উৎসাহিত করুন।
একজন সহানুভূতিশীল হিসাবে আপনি পারেনঃ
আরও বেশী তাঁকে বোঝা, সাহায্য করা ও তার খেয়াল রাখা।
এই সব মানুষের সাথে সহানুভূতির সাথে কথা বলা ও তাঁদের অনুভূতির কথা শোনা।
মানুষটিকে নানাবিধ কাজে ব্যস্ত থাকতে সাহায্য করা কারণ কাজে ব্যস্ত থাকা অবসাদ থেকে বেরোনোর উপায়।
আত্মহত্যা বিষয়ে রোগীর বক্তব্যকে ঠিক মত বোঝা ও সাথে সাথে মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে জানানো।
অবসাদের সাথে মানিয়ে নেওয়া
অবসাদ একটা রোগ এবং এর থেকে সুস্থ হওয়ার জন্য অন্যের সাহায্যের দরকার। পরিবার-পরিজনের সাথে কথা বলা এবং প্রথমত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা শুরু করা উচিত।
চিকিৎসা পদ্ধতি বা থেরাপির সাথে সাথে নিজের খেয়াল রাখাটাও খুব দরকার। এটা সহজ নাও হতে পারে, কিন্তু রোজের রুটিনে সামান্য পরিবর্তনও ইতিবাচক দিক এনে দেয়।
নেতিবাচক সাইকেলকে ভেঙে ফেলাঃ সারাক্ষণ ভুল ভাবা, অদরকারী ভাবা, অপ্রয়োজনীয় ভাবা হল অবসাদের লক্ষণ। এই সব চিন্তা ভাবনাকে আটকানো এবং তার সাথে কোন অবস্থাতে এই সব চিন্তা ভাবনা মনে আসতে পারে সেই ব্যাপারে সচেতনতা থাকা প্রয়োজন। নেতিবাচক চিন্তার ধরণকে চিনে তাকে ইতিবাচক বা কনস্ট্রাকটিভ চিন্তাতে পরিবর্তিত করা। যদি সম্ভব হয়, এই সব চিন্তাগুলো নোট করা ও এটা লক্ষ্য করা কিভাবে সেগুলোকে সুখের চিন্তা বা অনুভূতিতে রূপান্তরিত করা যায়।
কর্মক্ষম হওয়াঃ কাজকর্মের মধ্যে থাকাটা অবসাদের থেকে মুক্তি পাওয়ার থেরাপির একটা অঙ্গ। রোজকারের কাজ যতটা সম্ভব সেদিনই শেষ করার চেষ্টা করা উচিত। ছোটো ছোটো গোল বা টার্গেট স্থির করে তার অপরই কাজ করা ও তা শেষ করা উচিত। গবেষণাতে দেখা গেছে যে ব্যাম শরীর ও মনের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
ভয়ের কারণগুলির মুখোমুখি হওয়াঃসাধারণত, যখন মানুষ দুঃখী হয় বা দুশ্চিন্তায় থাকে তখন অন্যদের সাথে কথা বলা বা অন্যান্য কাজ, যেমন রান্না করা, বাগানের পরিচর্যা করা, কোথাও বেড়াতে যাওয়া এই সব কাজকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু, এটাই ঠিক যে, ভয়ের কারণগুলি এড়িয়ে না গিয়ে সেগুলোর মুখোমুখি হয়ে সেই কাজগুলো সম্পন্ন করা উচিত।
রোজের কাজ ও রোজনামচা তৈরি করাঃ যেহেতু অবসাদ ঘুমের প্যাটার্নকে পরিবর্তিত করে, তবুও রোজই সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা ও প্রতিদিন রাতে একই সময়ে ঘুমানো দরকার। আর যতটা সম্ভব রোজনামচা মেনে চলা উচিত।
পরিবারের সাহায্যঃ বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারপরিজনের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়া অবশ্য কর্তব্য। ডাক্তারের পরামর্শ মত উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি বা থেরাপি প্রতিদিন গ্রহণ করা যা রোগীকে তাড়াতাড়ি সুস্থতার দিকে নিয়ে যায়। মোটিভেশন ও মনের জোর হল অবসাদ থেকে মুক্তি লাভের প্রধান চাবিকাঠি।
অবসাদগ্রস্তের যিনি দেখাশোনা করেন তাঁর খেয়াল রাখা
অবসাদগ্রস্ত কারোর খেয়াল রাখা আপনার কাছে হয়তো বা অস্বস্তিকর বা অতিরিক্ত চাপের কারণ হতে পারে। এটাও জরুরী যে, আপনি রোগীর সাথে সাথে অবশ্যই নিজের শরীরের দিকে যত্নবান হবেন যাতে আপনি নিজের ভালবাসার মানুষদেরও যত্ন নিতে পারেন। পরিবারপরিজনের ও বন্ধু-বান্ধবের সাহায্য এবং মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বেরতে সাহায্য করবে। আর যারা এই কাজের সাথে ইতিমধ্যেই জড়িত আছেন তাঁদের সাথে আপনার অবস্থা সম্পর্কে কথা বলা দরকার, কারণ তাঁরা আপনার অবস্থাটা ভালো করে বুঝতে পারবেন।
আপনি সেই সব কাজ করবেন যেগুলি আপনার ভালো লাগবে।
অবসাদের বিষয়ে জানাটা দরকার যেহেতু এটা আপনার দুশ্চিন্তাকে কমাতে সাহায্য করবে ও আপনাকে রোগীর দেখাশোনা করতে সাহায্য করবে।
সঠিক ঘুম ও উপযুক্ত নিউট্রিশন যুক্ত খাবার খান এবং নিজের শারীরিক স্বাস্থ্যের ঠিকমত যত্ন নিন।
হাঁটতে যান, বা কোন কাজ, যা আপনাকে আনন্দ দেয়, তার মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।
বন্ধু স্থানীয় কেউ যাকে বিশ্বাস করা যায়, তাঁর সাথে চিন্তাভাবনা ও অনুভূতির নিয়ে আলোচনা করুন। এটা আপনাকে আপনার নিজের অস্বস্তি থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে।
নিজের কাজের সীমা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়া এবং কতোখানি সময় আপনি রোগীর দেখাশোনার জন্য ব্যয় করতে পারেন সেই বিষয়ে বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। এই বিষয়ে আপনার পরিবার, রোগী ও ডাক্তারের সাথে পরিষ্কারভাবে কথা বলা উচিত যাতে তাঁরা কেউ এই বিষয়ে কোন অপ্রত্যাশিত কিছু আশা না করেন।
অল্প সময়ের একটা সাময়িক ছুটি এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বেরতে সাহায্য করবে।
অবসাদের চিকিৎসার প্রকারভেদ
অনেক ধরণের সাইকোথেরাপি অবসাদে খুব ভালো কাজ করে যেমন কগ্নিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি (CBT)এবং ইন্টার-পারসোনাল থেরাপি (IPT)। আসলে এই থেরাপিগুলি হল স্বল্প সময়ের - এই পদ্ধতির চিকিৎসাতে ১০ থেকে ২০ সপ্তাহ সময় লাগে। গবেষণাতে দেখা গেছে যে স্বল্প থেকে মধ্যম মাপের অবসাদের ওষুধের দ্বারা বা সাইকোথেরাপির মাধ্যমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়া যায়। কিন্তু জটিল ধরণের অবসাদে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার জন্য দুই রকম পদ্ধতির মিশ্রণে সফলতা লাভ করা যায়।
কগ্নিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি (CBT)অবসাদের চিকিৎসার জন্য খুবই কার্যকরী। এটা মানুষের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ও অবসাদ সংক্রান্ত ব্যবহারের সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট কার্যকরী যেহেতু এই পদ্ধতিতে রোগীকে কিভাবে নেতিবাচক চিন্তাভাবনাকে বুঝে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তাই শেখানো হয়। নেতিবাচক চিন্তাকে বুঝে তাকে ইতিবাচক চিন্তাতে পরিবর্তিত করাই রোগীকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এটাও দেখা গেছে যে, ব্যবহারে সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে রোগীর চিন্তাশক্তি ও মুডের উন্নতি ঘটানো যায়।
ইন্টার-পারসোনাল থেরাপি (IPT)ব্যক্তিগত সম্পর্কের উন্নতির দিকে বেশী গুরুত্ব দেয়। এই থেরাপি মানুষকে অন্যের সাথে তাঁদের সম্পর্কের মূল্যায়নের শিক্ষা দেয়। একাকীত্ব ও তার সঙ্গে জড়িত অসুবিধাগুলির বিষয়ে জ্ঞাত করে এবং তার সাথে অন্যদের বুঝতেও সাহায্য করে।
সাইকোএডুকেশন একজন মানুষকে তার অসুখের বিষয়ে জানায়। কিভাবে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়, কিভাবে বোঝা যায় যে রোগটা খারাপ দিকে চলে যাচ্ছে যাতে দরকার হলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
পরিবারের সাইকোএডুকেশন মানসিক চাপ, দোনোমনা ভাব ও দুশ্চিন্তা কমাতে এবং মানুষকে অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে, যাতে তাঁরা তাঁদের কাছের মানুষ, যারা অবসাদের শিকার, তাঁদের ঠিকমত দেখাশোনা করতে পারেন।
ECT বা ইলেক্ট্রো কনভালসিভ থেরাপিঃএটা খুবই সাফল্য লাভ করে জটিল তম অবসাদের ক্ষেত্রে। যে সব জটিল অবসাদের লক্ষণ, যেমন অ্যাকিউট সাইকোসিস বা আত্মহত্যার চিন্তা বা যদি রোগী অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ খেতে না পারে, এমন রোগীর ক্ষেত্রে ওষুধ বা সাইকোথেরাপি করে কোন ফল পাওয়া যায় না। তখন ECT-র সাহায্য নেওয়া হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে ECT ও অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট দুটোই একই সাথে চলতে থাকে। মনে রাখার সমস্যা জনিত প্রবলেম দেখা যায় ECT পদ্ধতির পরেই। কাজেই এই বিষয়ে সতর্ক থাকা ও ঠিকমত পর্যবেক্ষণ করা খুব জরুরি।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:৪০