হাসপাতালে সকাল আটটা নাগাদ একটি ফুটফুটে মেয়ের জন্ম দিল পাগলী মেয়েটা। বাইরের পৃথিবীর এক কণাও ধুলো-ময়লা শিশুটাকে স্পর্শ করেনি। শিশুটাকে অবাক বিস্ময়ে দেখতে দেখতে মিমি গায়ত্রীর একটা হাত শক্ত করে ধরে ফিস ফিস করে বলে ওঠে--
--একে তুমি বাড়ি নিয়ে যাবে ঠাম্মা!
--হ্যাঁ দিদিভাই। এদের আমিই নিয়ে যাবনা হলে এরা রাস্তায় বেঘোরে মরে যাবে--
--খুব ভাল হবে ঠাম্মা! কিন্তু মা-বাবা রেগে যাবে না তো?
--নিশ্চয়ই যাবে। কিন্তু কি করা যাবে বলো?
--তোমার বাড়িতে তুমি যাকে খুশি আশ্রয় দিতে পার। তাই না ঠাম্মা?
গায়ত্রী নি:শব্দে তাকালেন মিমির দিকে। অত্যাধুনিক শহুরে সমাজে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা মেয়েটাকে দেখে মনে হয়েছিল বয়সের তুলনায় নিতান্ত খুকি সেজে থাকার শিক্ষায় পটু একটা পুতুল ছাড়া অন্য কিছু নয়্ কিন্তু এই দু'তিন দিনে, বিশেষ করে আজকের ঘটনায় মিমি হঠাৎই যেন নিজেকে নারী হিসেবে আবিষ্কার করে ফেলেছে। বছর পনের বয়স তো হয়েই গেল।
গায়ত্রী হাসপাতালের সুপারকে বলে এলেন সদ্যজাত শিশু ও মা-কে তিনিই নিয়ে যাবেন।
রাতে খাবার টেবিলের আবহাওয়া আজ একটু ভারি বোধ হল গায়ত্রীর। সারাদিন তাঁর নি:শ্বাস ফেলার সময় ছিল না। দীর্ঘদিনের কর্মজীবনের শেষ মুহূর্তগুলো স্মৃতি কাতরতায় আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। কচিকাঁচা ছাত্রীদের সজল নিষ্পাপ মুখগুলো তাঁকে আজ সারাদিন বিমর্ষ করে রেখেছে।
মেঘলা মুখে বড়ছেলে দিব্য কোনোরকম ভণিতা না করেই গায়ত্রীর দিকে তাকিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করল--
--তুমি নাকি একটা পাগলী আর তার অবৈধ সন্তানকে এই বাড়িতে এনে তুলতে চাও?
--ঠিকই শুনেছিস। না হলে ওরা বাঁচবে না। খোলা আকাশের নিচে এই শীতে দুজনেই মরে যাবে--
--এরকম তো আরো অনেকেই আছে--তুমি নিষ্চয়ই তাদের সকলকে এই বাড়িতে আশ্রয় দেবে না?
--এই এলাকায় এরকম অসহায় আর কেউ নেই। তবে থাকলে তাদেরও নিয়ে আসতাম।
--শুনলাম কমলেশ বলে কে একটা বুড়ো ভাম আছে তাকেও নাকি এ বাড়িতে থাকার জন্যে নেমতন্ন করেছো?
গায়ত্রী খাবারের প্লেটটা একটু ঠেলে দিয়ে দিব্য'র মুখের দিকে কঠিন চোখে তাকালেন।
--কমলেশ তোমার বাবার বন্ধু ছিলেন। সেই হিসেবে ওঁকে তোমার কাকা বলা উচিত ছিল দিব্য!
--কিন্তু মা, আপনি তো আমাদের বাড়িটাকে ধর্মশালা বানাতে পারেন না?
বড় বৌ শ্যামলীর কথা শুনলেন গায়ত্রী। কিন্তু ওর কথার কোনো উত্তর দিলেন না।
--এই বাড়িতে তুমি যা খুশি তাই করতে পারে না মা। এসব আমরা মানতে পারব না।
ছোটছেলের মুখটাও দেখলেন গায়ত্রী। কথা বলার সময় ওর চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে চেপে বসে। ভাল কথাও কানে অন্যরকম করে বাজে।
--কি মানতে পারবি আর পারবি না সেটা তোদের ব্যাপার। আমি তোদের মানা না মানার ওপর বিন্দুমাত্র নির্ভরশীল নই। আমার অবসর জীবনটা আমি কিভাবে কাটাবো সেটা অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করে ঠিক করে রেখেছি। যেমন ভেবেছি তেমনভাবেই বাকি জীবনটা কাটাবো আমি।
--তার মানে? তুমি কি এখানেই থাকবে নাকি?
মেয়ে দীপ্তি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল গায়ত্রীর দিকে।
--তোরা কি ভেবেছিস? আমি তোদের সঙ্গে কলকাতায় কিংবা মুম্বাইতে অথবা তোর সঙ্গে পাঞ্জাবে গিয়ে থাকবো?
--নিষ্চয়ই থাকবে! এখানে কে দেখবে তোমাকে?
দিব্য বেশ জোরের সঙ্গেই কথাটা বলে ভাইবোনের সমর্থন চাইল। সকলেই দিব্য'র পাশে রয়েছে দেখে গায়ত্রী বললেন--
--গত বছর তোদের মামার বাড়ি গিয়েছিলাম দু'দিনের জন্যে। বেড়াতে নয়। আমার প্রাপ্য পৈতৃক অংশটুকু ভাইপোকে লিখে দিতে গিয়েছিলাম। তোরা জানিস আমার বিধবা মা এখনও বেঁচে আছেন। কেন যে মানুষ দীর্ঘায়ু হও বলে আশীর্বাদ করে কে জানে!......কিভাবে আছেন জানিস?
একটু থেমে গায়ত্রী সকলের দিকে তাকালেন। সকলেই বিরক্তচোখে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তিনি বললেন--
--মায়ের ঘরে মা একলা রাত কাটান। নিজের শোবার ঘরটাও হাতছাড়া হয়ে গেছে। নাতি তাঁকে পাঠিয়ে দিয়েছে সিঁড়ি ঘরে। তোরা দেখেছিস ঘরটা। ছোট্ট--হাওয়া-বাতাস খেলে না। অন্ধকার ঘুপচি ঘরে পরিত্যক্ত পুরনো আসবাবের মতো মা আমার নি:সঙ্গ জীবন যাপন করছেন। আমার ভায়েরা তাদের বৌ-নাতি-নাতনিরা সকলেই ভীষণ ব্যস্ত। ঐ ঘরে উঁকি দেওয়ার সময়ও তারা পায় না। মা এখন সকলকে চিনতেও পারেন না। অথচ ওঁর শরীরের রক্তস্রোতেই ওদের জন্ম--বাড়বাড়ন্ত!
--দিদার গল্প শুনে কি লাভ? তোমার কি বলার আছে বলো--
অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে দিব্য। প্রসঙ্গ না পাল্টে গায়ত্রী বলতে থাকেন--
--রাতে সারারাত প্রায় জেগে থাকেন। তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে যাবার উপক্রম হলে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ান যখন পা দুটো ঠক্ ঠক্ করে কাঁপে। চোখে দেখতে পান না। হাতড়ে হাতড়ে জলের গ্লাস কাঁপা কাঁপা হাতে মুখের কাছে ধরে দু'এক ঢোক জল খেতে না খেতেই গ্লাস হাত থেকে পড়ে যায়। প্রায় রাতেই বিছানা ভিজে যায়। নাতি-নাতনি এমন কী বৌ'রা পর্যন্ত ভিজে বিছানা নিয়ে ঠাট্টা করে! মায়ের দু'চোখে এখন অফুরন্ত জল। গোটা সংসারটাই তাঁর চোখে ঝাপসা। আমি ওঁকে বারবার আমার সঙ্গে আনতে চেয়েছিলাম। এলেন না। স্বামী সন্তানের স্মৃতি মেয়েদের পাথরের জীবন দান করে রে দিব্য--তুই বুঝবি না! কিন্তু আমি আমার মায়ের মতো নই। আমি ঐ জীবন কিছুতেই চাইতে পারি না।
--দিদার জীবনের সঙ্গে তুমি তোমার তুলনা করছো কেন? তোমাকে আমরা মোটেই ওভাবে রাখবো না--
--নিজের শেকড় উপড়ে গেলে আর শক্ত হয়ে দাঁড়ানো যায় না বাবা! আমি এখনো যথেষ্ট কর্মক্ষম আছি। নিজের ইচ্ছে মতো স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই। তোমাদের দয়া নির্ভর জীবনে আমার কোনোরকম আগ্রহ নেই--
--তার মানে তুমি এই বাড়ি বিক্রি করে আমাদের সঙ্গে যাবে না?
দিব্য সরাসরি জানতে চাইল।
--না।
--কমলেশবাবুর সঙ্গে এই বাড়িতে একসঙ্গে থাকতে তোমার লজ্জা করবে না?
--কি আষ্চর্য! লজ্জা করবে কেন? আমরা পরস্পরকে দেখাশোনা করবো। পাগলী মেয়েটা আর তার বাচ্চাটা আমাদের সঙ্গে থাকবে। বাচ্চাটা বড় হবে, পড়াশোনা করবে--
--কিন্তু লোকে কি বলবে? কমলেশবাবুর সঙ্গে একসঙ্গে এই বাড়িতে এই বয়সে--ছি: ছি:!
বড় বৌ শ্যামলী গায়ত্রীর সিদ্ধান্তটা কল্পনা করেই যেন কুঁকড়ে গেল ঘেন্নায়।
--এক বাড়িতে কি বলছো বৌমা? আমার ঘরে গিয়ে দেখে এসো দুটো খাট দু'দিকের দেওয়ালের পাশে নেখেছি। আমরা তো একই ঘরে থাকবো। তা না হলে পরস্পরকে সাহায্য করবো কি করে? দেখাশোনা করবো কি করে?
--মা! চুপ করো তুমি। তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছো?
দিব্য চিৎকার করে ওঠে। হাতের সপাট ধাক্কায় টেবিলের ওপর সাজানো কাচের বাসনপত্র ঝনঝন শব্দে মেঝেয় ভেঙ্গে পড়ে।
--বাবার কথা মনে পড়ছে না তোমার? এই ব্যাভিচার সমাজ মেনে নেবে? মাথা সোজা রেখে এই শহরে হাঁটতে পারবে?
মেয়ে দীপ্তি কেঁদে ফেললো হাউ হাউ করে।
--অযথা তোরা হৈ-হৈ করছিস। এই বয়সে ব্যাভিচারী হওয়া যায় না। স্রেফ একটু ভাল ভাবে বাঁচার জন্যে একটা সুস্থ সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করা যায়। আমি তো তাই করেছি। এতে অন্যায় কি দেখছিস তোরা আমি তো বুঝতেই পারছি না।
--মাগো! এই বয়সে নতুন করে প্রেম! এতো ফিল্মেও হয় না!
বিদ্রূপে ঝলসে ওঠে বড় বৌ শ্যামলী।
--ফিল্মেও যা হয় না তা তুমি কি করে বুঝবে বৌমা? এসব বোঝবারই বা দরকার কি তোমার? আমাকে আমার মতো থাকতে দাও তোমরা। তোমাদের সঙ্গে আমি যাচ্ছি না এটাই আমার শেষ কথা!
গায়ত্রী টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই দিব্য বলে ওঠে--
--এই বাড়ি তোমার একার নয়। আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি। আমরা ঠিক করেছি এই বাড়ি আমারা বিক্রি করে দিয়ে যাব।
--তা কি করে হয় দিব্য? এ বাড়ির মালিক তোর বাবা নন। আমার নামেই বাড়ি। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন---দলিলপত্র দেখতে চাইলে দেখতে পারিস!
গায়ত্রীর ঘোষণায় সকলে স্তম্ভিত হয়ে গেল। সকলকে নির্বাক পাথর করে দিয়ে গায়ত্রী নি:শব্দে নিজের ঘরে য়ুকে খিল দিয়ে দিলেন!
প্রাত:ভ্রমণের জন্য তৈরি হয়ে নিচে নেমে গায়ত্রী দেখলেন মিমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে নদীর দিকে মুখ করে। গায়ত্রী পেছন থেকে মিরি কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন--
--কি দিদিভাই আজ আমার সঙ্গে হাঁটবে না?
--না ঠাম্মা। আজ সকালেই যে আমরা চলে যাচ্ছি। গোছগাছ সব হয়ে গেছে।
--তাই বুঝি?
গায়ত্রীকে কেউ এ কথা জানায়নি। সম্ভবত: রক্তমাংসের তৈরি সম্পর্কের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তা গতরাত্রেই শেষ হয়ে গেছে!
--জানো ঠাম্মা, মা-বাবা আমাকে মিমি বলে ডাকে। ছোট্ট ছোট্ট জামাকাপড় পড়তে বলে। আধুনিক শহুরে হতে বলে। অথচ নিজেরা দেখ, কাল তোমার সঙ্গে কেমন বিশ্রী ঝগড়া করলো! তোমার কত পিছনে পড়ে আছে ওরা।
--আমাকে তোর খারাপ লাগছে না দিদিভাই!
--একটুও না। তুমি তোমার মতো বাঁচবে--অন্যকে বাঁচাবে--এর মধ্যে খারাপের কি আছে? আমিও তো তাই করবো ঠাম্মা!
--হ্যাঁ দিদিভাই, তাই করবে। তবে তার আগে ভাল আর মন্দের তফাৎটাও বুঝতে শিখবে। ভুল হয় না যেন!
--ঠাম্মা!
--কিছু বলবে দিদিভাই?
--পাগলী মেয়েটার বাচ্চাটার নাম আমি দেব?
--ওরে বাবা! এর মধ্যে নামও ভাবা হয়ে গেছে?
--হ্যাঁ। আমার দেওয়া নাম রাখবে?
--রাখবো। বলো কি নাম?
--ওর নাম রেখো গায়ত্রী। অনেকদিন পরে যদি আমি কখনো এখানে আসি তখন--
বলতে বলতে একছুটে ভেতরে চলে গেল মিমি।
গায়ত্রী সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে ভাবলেন রক্তমাংস শেষপর্যন্ত কাউকেই ছাড়ে না! (শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০০৯ বিকাল ৫:৫০