হন হন করে হেঁটে আসছেন কমলেশ। আজ একটু দেরি করে ফেলেছেন। কপালে চিন্তার কয়েকটা রেখা নিয়ে এগিয়ে আসা কমলেশের কথাই এখন ভাবছেন গায়ত্রী।
বছর পাঁচেক আগেই শিক্ষকতার জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন কমলেশ। দুটি ছেলে একটি মেয়েকে মানুষ করেছেন--বিয়ে দিয়ে সংসারী করেছেন। জীবনের যাবতীয় সঞ্চয় দিয়ে ছোটখাটো একটা ছিমছাম বাড়িও বানিয়েছেন। দুই ছেলে এই বাড়িতে বসবাস করলেও ওদের হাঁড়ি পৃথক। দু'দিকের দুই রান্নাঘর থেকে যখন যা জোটে তাই দিয়ে কমলেশের একার পেট 'চলে যায়'!
যতদিন স্ত্রী বেঁচে ছিলেন ততদিন সংসারের আসল চেহারাটা কেমন ঠিক বোঝেননি। বছর চারেক আগে স্ত্রী বিয়োগের পর থেকে কমলেশের জীবনে একটু একটু করে অন্ধকার নেমে এসেছে। দুই পুত্রবধূর হুকুম তামিল করতে করতেই তাঁর সারাটা দিন কখন একসময় রাতের গভীর অন্ধকারে ডুবে যায় টের পান না।
একসময় কমলেশ নানান কাগজে কবিতা লিখতেন। প্রাসঙ্গিক বিষয়ে খবরের কাগজে প্রচুর চিঠিপত্র লিখতেন। পড়াশোনাও করতেন প্রচুর। তাঁর লেখা সেইসব চিঠিপত্র এবং কবিতার কাটিং দুটি ফাইলে বড় যত্ন করে তুলে রেখে গেছেন তাঁর স্ত্রী। এখন আর তাঁর কিছুই লেখা হয় না। ইচ্ছে হলেও সময় হয় না।
প্রাত:ভ্রমণের প্রথম ঊষায় নদীর ধারেই গায়ত্রীর সঙ্গে কমলেশের আলাপ। বিষণ্ণ একটি মানুষ চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে এসে কিছুক্ষণ পূবদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
প্রথমদিন রীতিমতো হাঁপ ধরে গিয়েছিল গায়ত্রীর। কদমগাছের শেকড়ে বসে দম নিচ্ছিলেন। কমলেশও এখানেই বসে বসে প্রতিদিন সূর্য ওঠা দেখেন। আকাশ পরিষ্কার থাকলে উত্তরের কাঞ্চনজঙ্ঘার সোনালি উজ্জ্বল শীর্ষদেশও দেখা যায়। সেদিন গায়ত্রীকে বসে থাকতে দেখে কমলেশ ইত:স্তত করছিলেন। গায়ত্রীই আহ্বান জানিয়েছিলেন--
--বসবেন এখানে? বসুন না!
বসতে না পেরে একটু কষ্টই হচ্ছিল কমলেশের। চারপাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে। দু'জন পরস্পরকে চেনেন। গায়ত্রী মেয়েদের স্কুলের বড়দি। বয়সে কিছুটা ছোট হলেও সামাজিক প্রতিষ্ঠার দিক থেকে তিনি কিছুটা এগিয়ে ছিলেন। পাশের ছেলেদের স্কুলের প্রাক্তন ইংলিশ টিচার কমলেশ যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বসেছিলেন। স্মিত হাসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা যে পারেননি সেটা বুঝতে পেরেই নদীর দিকে তাকিয়েছিলেন। গায়ত্রীর মনে হয়েছিল ধন্যবাদ জাতীয় কিছু একটা কমলেশ অস্ফূটে উচ্চারণ করেছিলেন।
--ডাক্তারের নির্দেশে আমি আজ থেকেই শুরু করলাম।
গায়ত্রী একটু হাসলেন। দু'জন বয়স্ক নর-নারী পাশাপাশি বসে কথা না বলে গোমড়া মুখে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে থাকবে এটা ভাবতেই হাসি পাচ্ছিল গায়ত্রীর।
--সুগার?
কমলেশ খুব আস্তে প্রশ্নের ঢঙে কথাটা আলতো করে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
--সামান্য বটে--তবে সাবধান হওয়া ভালো। আপনার?
--আমার কোনো রোগ নেই। অবশ্য রাতে ঘুম না হওয়াটা যদি রোগ হয় তাহলে--
--কোনো রোগ নেই তবু এত ভোরে বেরিয়ে পড়েন কেন? আমি হলে দিব্যি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতাম।
--ভোরের এই স্নিগ্ধ সতেজ পরিচ্ছন্ন সময়টুকুই আমার নিজস্ব সময়। শুয়ে থেকে নষ্ট করতে ইচ্ছে হয় না।
শেষের এই সামান্য দুটি কথাতেই গায়ত্রী কমলেশকে তাঁর পরিচিত আর পাঁচজনের বাইরের মানুষ বলে মনে হয়েছিল। টুকরো টুকরো এইরকম সাধারণ কথাবার্তা ধীরে ধীরে অনেক বেড়ে গিয়েছিল। গোটা কমলেশকে গায়ত্রী পুরোপুরি জেনে বুঝে গিয়েছিলেন। একসময় ভারী আশ্চর্যের মনে হলেও তাঁরা পরস্পরকে 'তুমি' সম্বোধন শুরু করে দিয়েছিলেন। কবে তা শুরু হয়েছিল মনে নেই কারো। তবে হঠাৎ যেদিন খেয়াল হয়েছিল সেদিন সাতান্ন বছরের গায়ত্রী নিজের কাছেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিলেন। দর্পণে নিজের চোখে চোখ রাখতেও সে যে কী বিড়ম্বনা! অথচ তখন আর আনুষ্ঠানিকতায় ফেরার পথ ছিল না।
পরে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে গিয়ে বুঝেছেন দু'জন উদার সংস্কৃতিমনস্ক নি:সঙ্গ নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি আন্তরিক সহমর্মিতার সূত্র ধরেই মনের দিক থেকে খুব কাছাকাছি এসে গেছেন।
গায়ত্রীর দুই ছেলের একজন থাকে কলকাতায়, অন্যজন মুম্বাইতে। মেয়ে থাকে পাঞ্জাবে। সকলেই সুপ্রতিষ্ঠিত। তিন বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে গায়ত্রীও একেবারেই নি:সঙ্গ। ছেলেমেয়েরা সকলেই নিজেদের কাজকর্ম ও সংসার নিয়ে দারুণ ব্যস্ত। মায়ের কাছে আসার সময় হয় না ওদের। বাপের মৃত্যুর তিন বছর পরে ওরা সকলে একসঙ্গে এসেছে বিশেষ কারণেই। আজই গায়ত্রী তাঁর স্কুলের চাকরি থেকে অবসর নেবেন। অবসরের পর তাঁর আর এখানে একলা পরে থাকার মানে হয় না। বয়স হচ্ছে। কে দেখাশোনা করবে? এখানকার পাট চুকিয়ে গায়ত্রী কলকাতা কিংবা মুম্বাইতে গিয়ে থাকুন। ছেলেমেয়েদের বক্তব্য এটাই।
গায়ত্রী অবশ্য তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন। এই বাড়ি বিক্রী করে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে তিনি ভাগের মা হয়ে পুত্রবধূদের নিয়ন্ত্রণে বাকি জীবনটা কাটাবেন। তাঁর স্বাধীনতা ইচ্ছা অনিচ্ছা সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হবে ওদের কর্তৃত্বে! গায়ত্রী তা আদৌ চাইছেন না। আজ রাতেই তিনি তাঁর মতামত স্পষ্ট জানিয়ে দিতে চান।
কমলেশ মিমির পাশে বসে একটু হাসলেন। গত দু'দিনেই কমলেশের সঙ্গে মিমির বেশ আলাপ জমে উঠেছে।
--আপনিও তো খুব ঘামছেন কমলেশদাদু! ঠাণ্ডা লাগছে না আপনার?
--না দিদিভাই। আমরা তো ঠাণ্ডার দেশেরই লোক । তবে আজ একটু বেশি জোরে হেঁটেছি মনে হচ্ছে--
কমলেশ সত্যিই একটু হাঁপাচ্ছেন। গায়ত্রী দেখলেন কমলেশের রগের পাশ দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। কপালও বেশ ভিজে। একটু উদ্বিগ্ন হলেন। প্রেশার কমে যাচ্ছে না তো? গায়ত্রী তাড়াতাড়ি নিজের আঁচল দিয়ে কমলেশের কপাল ঘাড় গলা মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন--
--প্রেশারটা ঠিক আছে তো? রাত্রে কি একেবারেই ঘুম হয়নি?
--না না, সব ঠিকই আছে।
কমলেশ মিমির অবাক গোল গোল দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে বিব্রত বোধ করছেন।
--কবিতার বই প্রেস থেকে আজ কয়েক কপি অন্তত: দিয়ে যাবে তো?
গায়ত্রীকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। কমলেশ মৃদু হাসলেন। গায়ত্রীর চাপাচাপিতেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'যাপন বৃত্তান্ত' প্রকাশিত হতে চলেছে আগামী সন্ধ্যায়। গ্রন্থপ্রকাশ উপলক্ষ্যে একটা ছোটখাট কবিসম্মেলনের আয়োজন করেছেন গায়ত্রী তাঁর বাড়ির লনে। অনেক নবীন প্রবীণ কবি সাহিত্যিক আসবেন। আজ গায়ত্রীর কর্মজীবনের অবসান। কাল সকাল থেকেই নতুন জীবনে প্রবেশ। নতুন কাজ--নতুন দায়িত্ব। একলা হলে হয়তো পারতেন না। কমলেশ তাঁর পাশে রয়েছেন। তিনি পারবেন। জীবনের অন্তিম মুহূর্তটাও তিনি বৃথা ব্যয় করতে চান না।
--ঠাম্মা দেখ দেখ, পাগলীটা কেমন ছটফট করছে!
মিমি হঠাৎই নদীর পাড়ে লুটিয়ে পরা পাগলী মেয়েটার দিকে হাত তুলে চিৎকার করে ওঠে। একসঙ্গে চমকে দূরে মেয়েটার দিকে তাকালেন গায়ত্রী আর কমলেশ। নির্জন নদীর তীরে বালির ওপর আসন্নপ্রসবা পাগলী মেয়েটা যন্ত্রণায় হাত-পা ছুঁড়ছে। একেবারে নগ্ন অসহায় মেয়েটার দিকে নিষ্পলক কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে গায়ত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন--
--কমলেশ, একটা রিক্সা বা ভ্যান যা পাও নিয়ে এসো--এক্ষুণি!
বলেই গায়ত্রী যথাসম্ভব দ্রুত মেয়েটার কাছে ছুটে পৌঁছে গেলেন। নদীর তীরে পড়ে থাকা শতচ্ছিন্ন ঘাড়িটা মিমি তাড়াতড়ি তুলে এনে গায়ত্রীকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটার শরীরে যত্ন করে জড়িয়ে দিল! গায়ত্রী মনে মনে ঈশ্বরের কাছে কাতর প্রার্থনায় ভেঙ্গে পড়লেন, মা ও শিশু যেন বেঁচে থাকে! গায়ত্রীর নতুন জীবনে এঁদের তাঁর বড়ই প্রয়োজন।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০০৯ বিকাল ৫:৩১