হাঁটতে হাঁটতে একবার পেছন ফিরে তাকালেন গায়ত্রী। অনেকটা পেছনে ফেলে এসেছেন মিমিকে। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে হাঁটার অভ্যেস নেই ওদের। রাতে শুতে শুতে ওদের মাঝরাত গড়িয়ে যায়। গায়ত্রী নদীর দিকে তাকালেন। পূবের আকাশটা সামান্য লালচে হয়ে উঠছে। জলে তার প্রতিফলন স্রোতের মাথায় মাথায় ছড়িয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় থালার মতো সূর্য দেখা যাবে।
গায়ত্রী নিত্যদিনের মতো কদমগাছের মোটা শেকড়ের ওপর গুছিয়ে বসলেন। গাছটা বেশ বড়। বয়সও নিশ্চয়ই কম নয়। প্রাত:ভ্রমণে বেড়িয়ে অনেকেই একটু বিশ্রামের জন্য এখানে বসে। গায়ত্রী বছর পাঁচেক ধরে মর্ণিংওয়াক করছেন। চিনি সামান্য বেশি। উত্তরবঙ্গের জলহাওয়ার সঙ্গে চিনি আর বাতের সখ্যতা একটু কেশিই। সামান্য হলেও বাড়তির প্রবণতার জন্য ডাক্তারের পরামর্শে প্রতিদিন সকালে হাঁটতে মন্দ লাগছে না।
--বাব্বা! তুমি এতো জোরে হাঁটো কি করে ঠাম্মা? আমি তো হাঁপিয়ে উঠেছি--
--পাঁচ বছরের অভ্যেস যে দিদিভাই! তুমি সত্যিই হাঁপাচ্ছো। এখানে বসে একটু দম নিয়ে নাও--
--সেই ভালো!
মন্দিরা নামটা ছেলের খুব অপছন্দ না হলেও বৌমার আদপেই পছন্দ হয়নি। তখন নাকচ করার ক্ষমতা ছিল না। তাই পোষাকী নাম মন্দিরা থেকে গেলেও আধুনিকা মা মন্দিরাকে মিমি বলে ডাকে। এটা ওর ডাক নাম হলেও আসলটা নামটা প্রায় এই নামের নিচে চাপা পড়ে গেছে। এবারে মাধ্যমিক দেবে মিমি। গোলগাল চেহারা। এই বয়সেই নাকের ওপর হালফ্যাশানের চশমা বসে গেছে। গায়ত্রীর গা ঘেঁষে বসে পড়লে মিমি।
--এই ঠাণ্ডায় তুমি ঘামছো কি গো?
অবাক হয়ে মিমি গায়ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। গায়ত্রীর নাকের ডগায় এবং কপালে কিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। সুন্দর ফর্সা মুখটা লালচে দেখাচ্ছে। নদীর জল থেকে লালচে আলোর প্রতিফলনে লালচে ভাবটা মাঝে মাঝে গাঢ় হয়ে উঠছে। গায়ত্রী ইতিমধ্যে গায়ের হাল্কা মণিপুরী চাদরটা খুলে কোলের ওপর রেখেছেন। মিমি চাদরটা টেনে নিয়ে ভাল করে নিজের গায়ে জড়িয়ে নিল। কার্তিকের মাঝামাঝি এখানে সকাল সন্ধ্যায় ভালই ঠাণ্ডা লাগে। তবে সকালে হাঁটাহাঁটি করলে অতটা ঠাণ্ডা লাগে না। মিমির কথা শুনে গায়ত্রী মৃদু হাসলেন।
--তোমার মতো হাঁটলে আমি ঘামতাম না। আমি যে অনেক জোরে হেঁটেছি!
বলতে বলতে দক্ষিণে ব্রিজের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন গায়ত্রী। পড়নের শতচ্ছিন্ন শাড়িটা পাড়ে খুলে রেখে সটান নদীতে সেমে গেল পাগলী মেয়েটা। এই ছোট্ট শহরের সকলেই ওকে চেনে। কোথা থেকে এসেছে--কোথায় যাবে তা অবশ্য কেউ জানে না। হঠাৎই একদিন গায়ত্রীর মতো সকলেই ওকে লক্ষ্য করেছে ভিক্ষে করতে। কোর্টের বারান্দায় মন্দিরের চাতালে কুকুরকুণ্ডলী পাকিয়ে রাত কাটায়। দেখতে দেখতে এই শহরে বছর চারেক কেটে গেল মেয়েটার। শতচ্ছিন্ন একটা ময়লা ফ্রকে ওর বাড়ন্ত শরীরটা গায়ত্রীর চোখে কাঁটার মতো বিঁধতো। একদিন ওকে বাড়িতে ডেকে পেট পুরে খাইয়ে একটা শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ কাজের মেয়েটাকে দিয়ে পরিয়ে দিয়ে ছিলেন। তারপর থেকে প্রতিদিনই মেয়েটা একবার না একবার বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়াবে। কাজের মেয়েটাকে বলা আছে যা-হোক কিছু খাবার দিতে।
এইভাবেই চলছিল। হঠাৎই একদিন মেয়েটাকে দেখে মনে মনে ভীষণভাবে ধাক্কা খেয়েছিলেন গায়ত্রী। বেওয়ারিশ পাগলী মেয়েটাও রেহাই পায়নি। ওর শরীর জুড়ে মাতৃত্বের লক্ষণ দেখতে দেখতে প্রকট হয়ে উঠেছিল!
ওর দিকে চোখ পড়লেই গায়ত্রী নিজেই কেন যেন ভীষণ বিচলিত এবং অপমানিত বোধ করেন। নারীত্বের এক অসহনীয় অপমানের জ্বলন্ত প্রতিমূর্তির মতো মেয়েটা নির্বকারভাবে পথে ঘাটে হেঁটে চলে। গায়ত্রী পরোক্ষে যতটা সম্ভব মেয়েটাকে নজরে রাখেন।
--দেখ দেখ ঠাম্মা, পাগলীটা কেমন এই ঠাণ্ডায় স্নান করছে!
গায়ত্রী দেখলেন আসন্নপ্রসবা মেয়েটা মানসাই নদীর ঠাণ্ডা জলে একবার করে ডুব দিচ্ছে আর দু'হাত তুলে উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকাচ্ছে! গোটা শরীর বেয়ে নেমে যাচ্ছে জলে ধারা। লালচে সোনালি আলোয় মাখামাখি ওর পরিপূর্ণ নিরাবরণ শরীর এক অসাধারণ দৃশ্যের জন্ম দিচ্ছে। মিমির চোখে একরাশ মুগ্ধতা। লজ্জা কিংবা ঘৃণার কোনো রেখাই মিমির চোখে-মুখে ফুটে ওঠেনি। গায়ত্রী অবাক হলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তরের দিকে তাকালেন।
(চলবে)