somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জোনাকী জীবন (৩)

২৪ শে মে, ২০০৯ রাত ৯:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

--এখন থেকে ভাবতে শেখো। জীবনটাকে নতুন করে গড়তে হলে অনেক নতুন কথা ভাবতে হবে।
--সুবীরদা, দিদির সঙ্গে দেখা করতে যাব কবে?
--গেলেই হবে একদিন। দু'একদিন রেস্ট নাও--
--কাল গেলে হয় না?
--কয়েকদিন আমার হাতে একেবারেই সময় নেই। একটু সময় পেলেই--
--দিদিকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে--কতদিন দেখিনি!
হঠাৎই হাতের অর্দ্ধেক ভর্ত্তি হুইস্কির গ্লাসটা বারান্দার রেলিং টপকে ছুঁড়ে ফেলে দিল সুবীর। চমকে উঠে দাঁড়াল তৃষা।
--কি হল সুবীরদা?
--নাথিং। ভাল্লাগছে না। একটু ফ্রেশ হয়ে নিই।
বলে নিজের ঘরে দ্রুত ঢুকে গেল সুবীর। পেছনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তৃষা।

তিন-চারদিন সুবীরের প্রায় পাত্তাই পাচ্ছিল না তৃষা। অনেক রাতে যখন ফেরে তখন ঠিক না ঘুমিয়ে পড়লেও সুবীরের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছেটা থাকে না। সকালে যেটুকু সময় সুবীর বাড়ি থাকে তার প্রায় সবটাই তার কাজকর্মের প্রস্তুতিতেই কেটে যায়। দু'একবার দিদির সঙ্গে দেখা করে আসার কথা বলেওছে তৃষা। সুবীর সেই একই কথা বলেছে, কাজের চাপটা একটু কমলেই--
বিকেলের দিকে ফ্যাক্টরিতে ফোন করলে শুনতে হয়, স্যার বেরিয়ে গেছেন। পরপর তিনদিন একই কথা শুনে তৃষা একটু অবাকই হলো। তাহলে কি দিদির শরীর নিয়ে কোনো সমস্যা?
ঘড়িতে এখন ঠিক সাড়ে চারটে। সুবীর গাড়ি নিয়েই অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে। তৃষা রাঁচীর মেন্টাল অ্যাসাইলামে সরাসরি ফোন করলো।

সূর্য অনেকটাই পাহাড়ের পেছনে হেলে পড়েছে। দূর থেকেই নদীর ধারে শাল-মহুয়ার গাছের ফাঁকে সুবীরের গাড়ি চোখে পড়লো তৃষার। অনেকটা অনুমানের ওপর নির্ভর করেই সুবীরের সন্ধানে নদীর ধারে চলে এসেছে। অনেক উঁচু পার থেকে নদীর ঠিক মাঝ বরাবর বিরাট সেই পাথরের ওপর সুবীর চুপচাপ বসে আছে এদিকে পিছন ফিরে। অস্তগামী সূর্যের লালচে আভার সামনে সুবীর যেন তেলরঙে আঁকা একটা ছবি।
একটু পরেই চারপাশে অন্ধকার গড়িয়ে আসবে। কিছুক্ষণ নি:শব্দে সুবীরের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকার পর আলতো করে সুবীরের কাঁধে হাত রাখলো তৃষা। চমকে পিছন ফিরে তাকালো সুবীর। অবাক হলো।
--একি! তুমি এখানে?
--চলে এলাম। মন বলছিল তোমাকে এখানেই পাওয়া যাবে।
--তাই বুঝি!
--সুবীরদা, এই জায়গাটাতে এসে বসলে দিদির উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, না?
--তা বলতে পারো। এই জায়গাটা এষার বড় প্রিয় ছিল।
--হ্যাঁ, ছিল। এখনো কি--
--এখন তো সব বোধের বাইরে।
--সত্যি! আমারও এই জায়গাটা ভীষণ ভালো লাগে--আবার একই সঙ্গে ভয়ও লাগে--
--ভয় লাগে! কেন?
সোজা উঠে দাঁগালো সুবীর।
--তুমি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। দিদি কতদিন একা একা এখানে এসে বসতো। পাথরের ফাঁক ফোকড় দিয়ে বয়ে যাওয়া জলের শব্দের সঙ্গে দিদির নি:সঙ্গতাও বয়ে যেত--শেষপর্যন্ত তো দিদি--
--বাংলোয় ফেরা যাক্। অন্ধকার হয়ে আসছে--
পা বাড়ালো সুবীর। এষাও সুবীরের পেছনে হাঁটা দিল নি:শব্দে।

আজ নিজের হাতেই টেবিল সাজালো তৃষা। হুইস্কির বোতল-বেলজিয়ান কাটগ্লাস-এক প্লেট ভাজা সল্টেড কাজু সেন্টার টেবিলে সাজিয়ে মিউজিক সিস্টেমে রবিশঙ্কর চালিয়ে দিল। ড্রেস চেঞ্জ করে বারান্দায় এসে অবাক হলো সুবীর।
--এস, আজ আমিই তোমার জন্যে সব সাজিয়ে রেখেছি।
তৃষার কথা শুনে ওর দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সুবীর। মুখোমুখি উল্টো দিকের চেয়ারে বসে সুবীর বলল--
--দারুণ অবাক হচ্ছি! তোমার দিদি এসব পছন্দ করতো না।
--করলে সম্ভবত দিদি পাগল হতো না!
--কী জানি!
--আমি পছন্দ না করলেও এ ব্যাপারে আমার কোনো রক্ষণশীলতা নেই। আমি সহ্য করতে পারি।
--শোভন কিন্তু এসব খায় না। একেবারে পেতি মধ্যবিত্ত শাবক।
--আমার ব্যাপারে শোভনকে নিয়ে আর ভাববে না তুমি।
--সেকি! কেন? শোভন তো খুবই ভালো ছেলে--
--আমি ভালো মেয়ে নই। আমার ঘটনা বিস্তারিত জানলে শোভন ঠিক তা-ই করবে যা মধ্যবিত্ত শাবকরা করে থাকে--
--কিন্তু তোমার ব্যাপারে আমার একটা দায়িত্ববোধ থাকা স্বাভাবিক। তোমার দিদি থাকলে--মানে ঠিক থাকলে হয়তো সে নিজেই--
--আজ বিকেল থেকে আমার ভয়ানক মন খারাপ সুবীরদা--
--কেন?
তৃষার দিকে এবারে বেশ অবাক হয়েই তাকালো সুবীর। তৃষা বারান্দার নিচের নীলাভ আলোর বৃত্তের বাইরের নিঝুম অন্ধকারে তাকিয়ে রয়েছে। মুখের প্রোফাইল থেকে শরীরের দৃশ্যমান অংশের ওপর নীল আলোর আভা এক অসাধারণ রহস্যময়তার সৃষ্ট করেছে। তৃষা এষার মতো না হলেও যথেষ্ট সুন্দরী। হীরের নাকছাবি থেকে একটা তীব্র নীলচে দ্যুতি মাঝে মাঝেই তৃষার মুখের দিকে সুবীরের চোখ দুটো টেনে নিচ্ছে বলেই তৃষার সম্পর্কে সুবীরের ভাবনা সরে যেতে পারছে না।
--দিদি যে আর কখনোই ফিরবে না--এটা আজ বিকেলেই জেনেছি। তুমি কেন আমায় জানালে না সুবীরদা? আশ্চর্য!
--এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে এমন একটা খবর--
--মা-বাবাকে জানিয়েছো?
--সেদিনই ফোন করেছি।
--এখন তুমি কি করবে?
--জানি না! এখনো কিছু ভাবিনি--
--এমন একটা সময়ে আমি এখানে এলাম!
তৃষা সোজাসুজি তাকালো সুবীরের দিকে। রবিশঙ্করের সেতার বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলোর বাইরের অন্ধকারে অজস্র জোনাকী ওড়াউড়ি করছে। গাঢ় স্তব্ধতা ভেঙে মাঝে মাঝে দূর থেকে দেহাতি বস্তি থেকে ভেসে আসছে ভোজপুরী কোরাস!
--তুমি তাহলে কি করতে চাও? শোভনকে পছন্দ হচ্ছে না?
--হতে পারে। যদি শোভনকে সব ঘটনা আমার সামনে খুলে বলে ওকে রাজি করাতে পারো--
--তোমার কি ধারণা শোভন রাজি হবে না?
--আমার বিশ্বাস শোভন পালাবে।
--ইন্ ফ্যাক্ট--তোমার কথাই ঠিক। আজ দুপুরে শোভনকে আমি তোমার সব কথা বলেছিলাম--অ্যাণ্ড দ্যাট স্কাউণ্ড্রেল পেটের মধ্যে ল্যাজ গুটিয়ে সত্যি সত্যি পালিয়েছে!
--আমি ঠিক জানি না আমি কি করবো!
--তুমি কিছুদিন এখানে থাকতে পারো। পাঁচজনে পাঁচকথা অবশ্যই বলতে পারে। তবে যদি সাহস না হারাও তাহলে হয়তো কি করলে তোমার নিজের ভালো হবে সেটা তুমি বুঝতে পারবে।
সুবীর উঠে দাঁড়ালো। আজ এক ফোঁটাও হুইস্কি স্পর্শ করেনি। বারান্দার রেলিংয়ের ওপর ভর দিয়ে সুবীর তাকিয়ে রইলো অন্ধকারের দিকে।
তৃষা আশ্চর্য হয়ে হঠাৎই লক্ষ্য করলো অজস্র জোনাকীর অজস্র আলোর টুকরো কেমন যেন জমাট বেঁধে যাচ্ছে। জমাট আলোর বৃত্তের মধ্যে দিদি এষার বড় বড় চোখ দুটো যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। তৃষা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকেই!
(শেষ)
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×