দিদি এষার কথা মনে পড়তেই তৃষার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উজ্জ্বল সোনালি আলোয় মাখামাখি সবুজ আর আকাশের নীল কেমন যেন বদলে গেল। মুহূর্তেই যেন চারপাশ ঢেকে গেল কুয়াশায়।
এষাকে নিয়ে সুবীর যখন পালিয়ে আসে তৃষা তখন সপ্তদশী সদ্য তরুণী। সুবীরের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে কোনোমতেই রাজি ছিলেন না বাবা। বংশ মর্যাদার অহমিকাকে জলাঞ্জলি দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে এষাকে পালাতে হয়েছিল সুবীরের সঙ্গে। মেন্টাল অ্যাসাইলামে আশ্রয় পাওয়ার আগে পর্যন্ত বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু দিদির এই মর্মান্তিক পরিণতি শেষপর্যন্ত মা-বাবা সহ্য করতে পারেনি। ওঁরা ছুটে এসেছিলেন। খুব কাছ থেকে কয়েকটা দিন সুবীরকে দেখে বাবার ধারণা বদলে গিয়েছিল। সম্পর্কটা সহজ হয়ে গিয়েছিল--কিন্তু এত দেরিতে যে দিদি তার বিন্দুমাত্র স্বাদ পেল না।
বাবা যখন অনুভব করেছিল দিদির ভালো হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে তখন নিজে থেকেই প্রস্তাব দিয়েছিল সুবীর যদি চায় তাহলে সে তৃষাকে বিয়ে করে নতুনভাবে সংসার শুরু করতে পারে। রীতিমতো হতচকিত ও বিস্মিত সুবীর সঙ্গে সঙ্গেই বাবার প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিল। দিদির দু:খজনক পরিণতি বাবাকে মানসিক দিক থেকে অসুস্থ করে দিয়েছিল বলে সেই মুহূর্তে শুধু সুবীরই ভাবেনি--তৃষাও ভেবেছিল। বছর দুয়েক আগে এসব কথাবার্তা তৃষার অজ্ঞাতে হলেও পরে মায়ের মুখ থেকে শুনেছিল তৃষা। প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে খারিজ করে দেওয়ার জন্যে মনে মনে ধন্যবাদ জানিয়েছিল তৃষা এবং সুবীরের প্রতি তার শ্রদ্ধাও বেড়ে গিয়েছিল অনেকটাই। সেই কারণেই এখন নি:সঙ্কোচে দু'চার দিনের জন্যে তৃষা একাই চলে আসে এখানে দিদিকে দেখার জন্যেই মূলত:।
কিন্তু এবারের আসাটা সম্পূর্ণ অন্য কারণে। ভয়াবহ লজ্জায় মুখ লুকোতেই এবারে তৃষার এখানে আসা। গতকাল রাঁচী স্টেশনে সুবীরেরই থাকার কথা ছিল। কিন্তু ছিল না। বিশেষ জরুরি কি একটা কাজে সুবীর বাইরে চলে যাওয়ায় স্টেশনে ছিল শোভন। অন্য সময়ে হলে স্টেশন থেকেই সুবীরের সঙ্গে গিয়ে দিদিকে দেখে রামগড়ে আসতো। কিন্তু কাল শোভনের সঙ্গে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মনটা তাই একটু খারাপ।
গভীর রাতে কোনো এক সময়ে সুবীর ফিরেছিল। তৃষা টের পায়নি। সকালে বারন্দার নীচে সুবীরের বোলেরো দেখেই বুঝেছিল সুবীর ফিরেছে এবং নিশ্চয়ই গভীর ক্লান্তিতে ঘুমুচ্ছে। না হলে খুব ভোরেই সুবীর উঠে পড়ে।
বারকয়েক এখানে আসার ফলে শোভনের সঙ্গে তৃষার সম্পর্কটা বেশ সহজ হয়ে উঠেছিল। সুবীরও চেয়েছিল শোভনের সঙ্গে তৃষার সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত গড়াক। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। তৃষা ভালোবেসেছিল এবং বিয়ে করেছিল এমন একজন সরকারি অঢিসারকে যে ইতিমধ্যেই পরিচয় গোপন করে তিন-তিনটে বিয়ে করে বসেছিল!
খবরটা যখন জানা গেল তৃষা তখন মাস তিনেকের গর্ভবতী। অবৈধ বিয়ে এবং সেই বিয়ের সূত্রে অবৈধ সন্তান সম্ভাবনাকে তৃষা মেনে নিতে পারেনি। গর্ভপাত ঘটিয়ে লজ্জায় ঘেন্নায় পরিচিত পরিবেশ থেকে ওকে একরকম পালিয়ে আসতে হয়েছে এখানে। সুবীরই তৃষার বাবাকে বলেছিল এখানে পাঠিয়ে দিতে।
শোভন শুনেছিল তৃষার বিয়ে হয়ে গেছে। তারপরের ঘটনা কিছুই না জানলেও শুনেছিল বিয়েটা যে কোনো কারণেই হোক টেকেনি। কারণটা জানার কৌতুহল থাকলেও জানতে চাইতে পারেনি ভদ্রতার কারণেই। তবু তৃষার আজ সকালে শোভনের সঙ্গে আলাপচারিতায় মনে হয়েছিল শোভন সম্ভবত: তৃষার অসফল বিবাহিত জীবনের মাঝখানে কোথাও সুবীরের ছায়া দেখছে। কৌশলে তৃষাকে শুনিয়েছে স্ত্রীহীন সুবীরের বাংলোয় তৃষার থাকাটা কেউ কেউ ভালো চোখে না-ও দেখতে পারে। এই সন্দেহটা মাথায় ঢোকার পর থেকেই সকালে বেড়ানোর আমেজটাই মাটি হয়ে গেছে তৃষার।
বারন্দার শেষপ্রান্তে বেতের চেয়ারে সাত-সকালেই ড্রিংক নিয়ে বসে আছে সুবীর! মুখোমুখি একটা চেয়ারে তৃষাও বসে পড়ল। সুবীরের দুটো বড় বড় চোখ টকটকে লাল। রাত জাগার চিহ্ন স্পষ্ট। জীন্সের প্যান্ট আর গোল গলা অ্যাডিডাস গেঞ্জিতে ধুলোবালি লেগে রয়েছে। চুল উস্কোখুস্কো। গোটা শরীরে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।
--সরি, কাল একটা জরুরি কাজে--
--শোভনবাবুর মুখে শুনেছি। কিন্তু এই সাতসকালে এসব নিয়ে বসেছো? কখন ফিরলে? চেঞ্জও তো করোনি!
--আজকের সকালটাই যে একেবারে অন্যরকম--
--তাই বুঝি?
--এনিওয়ে--তোমার কথা বলো--
--আমার তো আর কোনো কথাই নেই সুবীরদা! বেঁচে থাকতেই বড় ঘেন্না হচ্ছে, জানো!
--ডোন্ট বী সিলি! ইটস্ আ গেম অফ লাইফ! এসব নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে--
--সেই জন্যেই হয়তো এখানে ছুটে এলাম। কিন্তু--
--কিন্তু?
--দিদি এখানে থাকে না। তুমি একলা থাকো। এখানে আমার আসা যাওয়াটা--
--কেউ কিছু বলেছে বুঝি? শোভন? মন খারাপ লাগছে?
--মানুষ মানুষের গভীর কষ্টটা বোঝে না কেন সুবীরদা?
--হাতে গোণা দু'একজন বোঝে বইকি! আসলে আমরা চাই সব্বাই বুঝবে। সেটা হয় না বলেই মন খারাপ হয়--
--তোমার মন খারাপ হয় না?
--হয় না। কারণ আমি যখন রাত্রে শুতে যাই তখন এই বিশ্বাস নিয়ে চোখ বুঁজি যে, কাল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যাদের সঙ্গে আমার দেখা হবে তারা প্রত্যেকেই শয়তান। কেউ ভালো ব্যবহার করবে না। আমাকে অপদস্থ করার চেষ্টা করবে--হেনস্থা করার চেষ্টা করবে--
--সে কী! এমন কখনো হয়?
--হয় না। কিন্তু ঐ বিশ্বাস নিয়ে তুমি যদি সকালে জেগে ওঠো তাহলে সারা দিনের মধ্যে একটাও যদি ভাল লোকের দেখা পাও তাহলে তোমার প্রাপ্তির ঘর পূর্ণ হয়ে যাবে। না হলেও দু:খ থাকবে না। কারণ শয়তান তো মানুষের মতো ব্যবহার করতে জানে না। তাহলে কীসের মন খারাপ!
--আশ্চর্য! এমন করে তো কখনো ভাবিনি!
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০০৯ রাত ১০:৩২