সকালে হাঁটতে হাঁটতে রাঁচীরোড স্টেশন পর্যন্ত চলে গিয়েছিল তৃষা। এই রাস্তা ধরে সোজা চলে গেলে হাজারিবাগ। উল্টোদিকে গেলে একটা গাঢ় সবুজ পাহাড় পেরুলেই রাঁচী। ঠিক মাঝখানে এই রামগড়। রামগড়ের ঠিক মাঝ বরাবর অজস্র বড় বড় পাথরের ফাঁকফোকর দিয়ে বয়ে চলেছে দামোদর। এখানকার লোকেরা দামোদরই বলে। তৃষা প্রথমবার এসে এটাকে একটা পাহাড়ী নদী ভেবেছিল। সকালে এবং বিকেলের নরম আলোয় জলের অজস্র ছোটবড় ধারায় ঘেরা পাথরের ওপর বসে থাকতে বেশ ভালোই লাগে। আজও ইচ্ছে ছিল নদীর দিকেই যাবে। কিন্তু রাস্তায় নামতেই দেখা হয়ে গেল শোভনের সঙ্গে। রামগড় গ্লাস ফ্যাক্টরির অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার শোভনের সঙ্গে তৃষার জামাইবাবু সুবীর বোসের সম্পর্কটা কিছুটা ভাই-ভাই, কিছুটা বন্ধুর। শোভনের চেয়ে অবশ্য সুবীর কিছুটা বড়-ই।
সুবীরের এখানে একটা সেরামিক ফ্যাক্টরি আছে। খুব বড় নয়, আবার খুব ছোটও নয়। এই সেরামিক ফ্যাক্টরি থেকে ফায়ার ব্রিক তৈুর হয়। সারা দেশের নানান পাওয়ার প্ল্যান্টে আর স্টীল ইণ্ডাস্ট্রিতে এই ব্রিকের চাহিদা রয়েছে। এই ফ্যাক্টরি থেকেই সুবীরের ভাগ্য বদলে গেছে। এখন প্রচুর টাকার মালিক। হৃদয়টাও অবশ্য অনেক বড়।
গ্লাস ফ্যাক্টরির অধিকাংশ কর্মচারীই বাঙালি। এদের মধ্যে অনেকেই বৃটিশ আমল থেকেই এখানে বসবাস করছে। কেউ সরকারি চাকরিসূত্রে, কেউ বা রেলওয়ের কর্মচারী হিসেবে এখানে বসবাস শুরু করেছিল। এক সময়ে রাঁচী ধানবাদ বোকারো হাজারিবাগ গিরিডি জামশেদপুর অহ্চলে প্রচুর বাঙালির বাস ছিল। অনেকেই এখন আর নেই। তবুও এখনো যারা রয়ে গেছে তাদের সংখ্যাও খুব কম নয়। এইসব প্রবাসী বাঙালিরা প্রায় সকলেই পরস্পরকে চেনে। এই চেনা-চিনির সূত্রেই সুবীরের সঙ্গে শোভনের ঘনিষ্ঠতা।
তৃষার দিদি এষাকে নিয়ে সুবীর এই রামগড়ে পালিয়ে এসে বিয়ে করে ঘর বাঁধে। সদ্য সেরামিক ইঞ্জিনিয়ার সুবীর রামগড়ের একটা কোল রি-ফ্যাক্টরিতে সামান্য চাকরি সম্বল করে এষাকে নিয়ে আসার অল্প কিছুদিন পরে একটা ছোট্ট সেরামিক ফ্যাক্টরির চিফ ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি পায়। নামেই চিফ। আসলে জনা কুড়ি প্রায় লেবারের মাথায় বসে ধীরে ধীরে ফ্যাক্টরির চেহারা বদলে দেবার স্বপ্ন নিয়ে ঢুকেছিল সুবীর। শেষপর্যন্ত কয়েকবছর যেতে না যেতেই পাঞ্জাবী মালিক ইন্দর সিং ফ্যাক্টরিটা সুবীরকে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেশে চলে যাওয়াতেই সুবীরের বরাত ফিরল। পৈতৃক বিষয় সম্পত্তির যতটুকু নিজের বলে ছিল সবকিছু বিক্রি করে এই ফ্যাক্টরি কিনে প্রচণ্ড লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নিষ্ঠা শ্রম আর একাগ্রতার ফল ফলতে দেরি হয়নি। কিন্তু একদিকে যখন স্বপ্ন হচ্ছিল দারুণভাবে তখন অন্যদিকে তৈরি হচ্ছিল এক দারুণ শূন্যতা! বিদেশ বি-ভূঁইয়ে এষার গোটা দিন আর রাতেরও অনেকটাই কাটছিল একা। এককিত্বের যন্ত্রণায় অস্থির এষা মাঝে মাঝেই ক্ষোভে ফেটে পড়তো। সুবীর প্রাণপণ বোঝাবার চেষ্টা করতো কিছুদিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এষা বিশ্বাস করতে পারেনি। ক্রমশ:ই সে তার মানসিক স্থিরতা হারিয়ে ফেলছিল। মাঝে মাঝে ভীষণরকম ভায়োলেন্ট হয়ে উঠতো। এষার পরিবার এষাকে ত্যাগ করেছিল। সবকিছু মিলে মিশে এক দুর্বিষহ অস্থিরতার মধ্যে থাকতে থাকতে এষা সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেল।
যথাসাধ্য চেষ্টা করেও এষাকে মানসিক দিক থেকে সুস্থ করে ঘরে রাখতে পারেনি সুবীর। তীব্র একটা আতঙ্ক তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো--হয়তো কোনোদিন ঘরে ফিরে দেখবে এষা সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে! বাধ্য হয়েই রাঁচীর মেন্টাল অ্যাসাইলামে পাঠাতে হলো এষাকে। আজও প্রতি রবিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুবীর রাঁচীতেই কাটিয়ে আসে। বাকি দিনগুলোয় ডুবে থাকে নিজের কাজের মধ্যে এবং মদ্যপানে!
অবশ্য মদ্যপানের মধ্যেও তার একটা আভিজাত্যের চেহারা ফুটে ওঠে। ছোট সেন্টার টেবিলের ওপর দামী হুইস্কির বোতল (কখনো স্কচের), সুদৃশ্য বেলজিয়ান কাটগ্লাস, এক প্লেট বাদামী রঙের ভাজা সল্টেড কাজু বাদাম সাজিয়ে নিয়ে বসে। মিউজিক সিস্টেমে বাজতে থাকে রবিশঙ্কর বা আমজাদ আলি কিংবা ভি জি যোগ! কখনো কখেনো দেবব্রত বিশ্বাস কণিকা রেজওয়ানার রবীন্দ্র সঙ্গীতও বাজে। একেবারে একলা। নেশায় মাতাল হয়ে আজ পর্যন্ত কখনো প্রগলভ হয়ে ওঠেনি। বিন্দুমাত্র অশালীন আচরণ করেনি। বলতে গেলে গোটা সময়টাই প্রায় চোখ বুঁজে থাকে। দেখলে মনে হয় কোথায় যেন তলিয়ে গেছে। এই রকমই চলেছে আজ প্রায় বছর সাতেক।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০০৯ বিকাল ৫:০০