জয়ন্তী লিখেছে--
--কিন্তু তোমরা ভূমিকা আমাকে শুধু হতাশই করেনি, আমার গোটা ভবিষ্যতকেই অনিশ্চিত করে তুলছিল ধীরে ধীরে। এই রকম একটা সময়েই তোমার বন্ধু অঞ্জনের সঙ্গে তুমি আমার আলাপ করিয়ে দিয়ে পরোক্ষে আমার দারুণ উপকার করে ফেলেছো। আমি ঠিক যেমন মানুষের স্বপ্ন দেখতাম--অঞ্জন ঠিক সেই মানুষ। তোমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব হলো কি করে বলোতো? এমন অসম চরিত্রের দুটো মানুষ আর যাই হোক বন্ধু হয় কি করে? যাইহোক, প্রথম দিকে অঞ্জনের একটু দ্বিধা ছিল তোমার কথা ভেবে। ও তোমাকে ঠকাতে চাইছিল না। কিন্তু যখন বুঝলো আমার নিজেরই নির্বুদ্ধিতার জন্যে আমি নিজের কাছেই নিজে ভীষণভাবে ঠকে গেছে তখন আর ওর কোনো দ্বিধা ছিল না। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম আমরা বিয়ে করবো। কারণ আমরা ঠিক ততদূর এগিয়েছি যতদূর এগুলে বিয়েটা অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং আমি যাকে দেহে মনে গ্রহণ করবো তাকে বিয়ে করেই তার সঙ্গে জীবন কাটাবো এটাই আমার সিদ্ধান্ত। কারণ উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে আমার রুচি নেই।
বিভাসের হঠাৎ মনে হলো গোটা বাড়ি কেমন যেন বোবা হয়ে গেছে। কোনো হৈ-চৈ নেই! তাহলে কি সবাই ব্যাপারটা জেনে গেছে? জয়ন্তী কি মা-বাবাকেও চিঠি দিয়ে তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছে?
পরের পাতাটাও যন্ত্রচালিতের মতো কঙ্কনা টেনে নিয়ে পড়তে লাগলো। বিভাস আবার পড়িতি শুরু করলো--
--এখন আমাকে আবার বিয়ে করতে হলে তোমার সঙ্গে আমার আইনসম্মত বিচ্ছেদের প্রয়োজন। দু'এক দিনের মধ্যে আমি কাগজপত্র পাঠিয়ে দেবো। আমি জানি তুমি সই-সাবুদ করে দেবে। কারণ সই না করে জোর-জবরদস্তি করে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে ধরে রাখার চেষ্টা করার মতো হিম্মত তোমার নেই। বিশেষ করে এসব ব্যাপারে অনেকেই অনেককিছু বলবে যা তুমি কিছুতেই শুনতে চাইবে না। কারণ অসম্ভব ভালোমানুষের এই দুর্বলতাটাই মারাত্মক দুর্বলতা। এর জন্যে জীবনকেও বাজি ধরা যায়--তাই না?
তোমার ওই বাড়ি বানাবার জন্যে আমি যে চার লাখ টাকা দিয়েছিলাম সেটা একসঙ্গে ফেরৎ পেলেই আমার উপকার হয়। অসুবিধে থাকলে তুমি গোটা চারেক ইনস্টলমেন্টেও দিতে পারো। অবশ্য কঙ্কনা তোমাকে ভালোবাসে (যা:! বলে ফেললাম শেষপর্যন্ত! কঙ্কনা চায়নি তুমি কোনোদিন টের পাও। তোমার টের পাওয়ার কথাও নয়। তুমি কি কঙ্কনার চোখের দিকে তাকিয়ে কখনো ওর মনের কথা বোঝার চেষ্টা করেছো?), বেচারী কঙ্কনা--ভাবতে পারো--স্রেফ তোমার জন্যেই চিরকুমারী থাকবে বলে পণ করেছে! তোমার মতো 'ভালোমানুষের জন্য' এত সৌভাগ্য ঈশ্বর কোন আক্কেলে বরাদ্দ করেন কে জানে! সে যাইহোক, তুমি যদি কঙ্কনাকে বিয়ে কর তাহলে ওই চার লাখ টাকার সবটাই আমি আমার নির্বোধ বোনের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে দিয়ে দেবো। সেই সঙ্গে একটা অযাচিত উপদেশও দেবো--জীবনটাকে চেনার এবং জানার চেষ্টা করে একা একা নয, জীবনে যদি কাউকে আনো তাকে সঙ্গে নিয়েই সে চেষ্টা কোরো--জীবনের যথার্থ মানে খুঁজে পাবে।
আচমকা এখানেই চিঠিটা শেষ করেছে জয়ন্তী। বিভাস সত্যিই সবিস্ময়ে মুখ তুলে তাকালো কঙ্কনার মুখের দিকে। কঙ্কনা হাত বাড়িয়ে বললো--
--দাও শেষটুকু দেখি--
বিভাস নি:শব্দে শেষ পৃষ্ঠাটা বাড়িয়ে দিল। কঙ্কনা মন দিল চিঠিন পাতায়। বিভাস লক্ষ্য করছিল কঙ্কনাকে। চিঠি পড়তে পড়তে কঙ্কনার চোখমুখ লাল হয়ে উঠছে। চিঠি শেষ করে কঙ্কনা নি:শব্দে ছাদের কার্নিশের ধারে গিয়ে দাঁড়ালো।
বিভাস অনুমান করছে নীচে সবাই বিভাসের বিপর্যয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে নির্বাক হয়ে গেছে হয়তো। গৃহপ্রবেশের এই দিনটা এমনভাবে আসবে কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। কঙ্কনার চিঠি পড়া হয়ে গেলেও বিভাসের দিকে ফিরতে পারছে না। আজ পর্যন্ত কঙ্কনা ওর মনের কথা কোনো ছলেই বিভাসের সামনে প্রকাশ করার চেষ্টা করেনি। বিভাসও আজ পর্যন্ত এর বিন্দুবিসর্গ জানতো না।
পায়ে পায়ে বিভাস কঙ্কনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আড়চোখে ওর দিকে একবার তাকিয়ে বললো--
--জয়ন্তীর সব কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তোমার এ মতিভ্রম হলো কেন কঙ্কনা!
কঙ্কনা কোনো উত্তর দিল না। কিন্তু জয়ন্তীর মূল্যায়নের পর বিভাসের ভীষণভাবে জানতে ইচ্ছে করছিল কঙ্কনার কাছে বিভাসের গ্রহণযোগ্যতার মধ্যে অন্য কোনো বড় রকমের ভুল নেই তো? বিভাস তাই বোঝার চেষ্টায় জিজ্ঞেস করলো--
--আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না তো?
কঙ্কনা বিভাসের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। সরাসরি বিভাসের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো--
--দিদির কিছু কিছু অভিযোগের ভিত্তি আছে। আমারো মনে হয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দিদির ধারণা ঠিক। তবু সবটাই এভাবে রিয়্যাক্ট করা মতো বলে আমার মনে হয়নি। চেষ্টা করলে হয়তো দিদি পারতো তোমার সঙ্গে জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে। আমি বহুবার দিদিকে এ ব্যাপারে বোঝাবার চেষ্টা করেছি। সেই থেকেই হয়তো দিদির মনে হয়েছে--
--যা মনে হয়েছে তা কি সত্যি ঠিক নয়?
কঙ্কনার মনে হলো বিভাস ওর মুখ থেকে ছোট্ট 'হ্যাঁ' শব্দটাই শোনার জন্যে নি:শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। হ্যাঁ বলে দিতে পারলেই হয়তো ভালো হতো। কিন্তু কঙ্কনার মনে হলো--এই মুহূর্তটাকে বিশ্বাস করার মতো মুহূর্ত নয়। আবেগ আর জীবন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ঠিকই--কিন্তু পাল্লা একদিকে বেশি ঝুঁকে আছে কি না সেটাও তো বোঝা দরকার। কঙ্কনা বললো--
--এ ব্যাপারে পরে কথা হবে। এখন চলো নীচে যাওয়া যাক্--
--কিন্তু কোন্ মুখে যাবো সেখানে?
--যেতেই হবে বিভাসদা। এটা তোমার নিজের সমস্যা। এর মুখোমুখি তোমাকে হতেই হবে। পলাবার উপায় নেই যে!
বিভাস ভয়ঙ্কর এই মুহূর্তেও বুঝতে পারছিল জয়ন্তী ঠিক এইভাবে ওকে পুরুষ মানুষ হতে সাহায্য করেনি। বিভাস বললো--
--তুমি ঠিকই বলেছো! চলো নীচেই যাই--
সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে কঙ্কনা বললো--
--দিদির চার লাখ টাকা ফেরৎ দিতে কি খুব অসুবিধে হবে?
--এই মুহূর্তে এই বাড়ি করার পরে তো--
--এ বাড়ির আর কি প্রয়োজন? কিক্রি করে দেওয়া যায় না? দিদির জেদের জন্যেই তো এ বাড়ি--
--হ্যাঁ, তা ঠিক--দেখা যাক্--তাই হবে!
ড্রইংরুমে সকলে নিশ্চল হয়ে বসে দাঁড়িয়ে যেন ওদেরই অপেক্ষা করছিল। দরজার কাছে কাছা-পরিহিত ছেলেটাও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। বিভাস ঘরে ঢুকেই দেখলো মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওদের পায়ের শব্দ পেয়ে আঁচল সরিয়ে ডুকরে উঠলো--
--আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে বাবা! আমি আর এ মুখ কাউকে দেখাতে পারবো না বাবা!
হকচকিয়ে গেলো বিভাস। মায়ের এই তীব্র প্রতিক্রিয়া ওকে স্তম্ভিত করে দিল একেবারে! কোনোক্রমে বিভাস বলার চেষ্ট করলো--
--কি আর করা যাবে মা--
--তোর বাবার কাণ্ড দেখ তুই। ওই ছোঁড়াটা তোর বাবাকে বাবা বলছে! ওর মা মারা গেছে, তাই তোর বাবাকে নিতে এসেছে ছোঁড়াটা--
বিভাস প্রায় টলে পড়েই যাচ্ছিল। পাশ থেকে কঙ্কনা ওকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল।
--বাবা নিজেও স্বীকার করেছে। একই সঙ্গে দু'দিকে দু'টো সংসার--তুই ভাবতে পারিস দাদা!
ছোট বোন জয়ার চোখমুখ টকটকে লাল! জীবনের অদ্ভুত অপ্রত্যাশিত সব ঘটনা মানুষের নিজের নিজের ঢঙে গড়ে তোলা চেনা বৃত্তগুলোকে কি ভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় তা এক লহমা আগেও টের পাওয়া যায় না। বিভাস দেখলো ওর বাবা ছেলেটার সঙ্গে নি:শব্দে বেড়িয়ে গেল। কঙ্কনা মা-কে কিছু বোঝাচ্ছে। বিভাসের মনে হলো--ওকে আর একটা নতুন বৃত্ত গড়তে হবে যেখানে জয়ন্তী থ্কবে না, আর অবশ্যই বাবাও থাকবে না--!
(শেষ)