somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৃত্ত ভাঙার খেলা (৪)

১৮ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ১১:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জয়ন্তী লিখেছে--
--কিন্তু তোমরা ভূমিকা আমাকে শুধু হতাশই করেনি, আমার গোটা ভবিষ্যতকেই অনিশ্চিত করে তুলছিল ধীরে ধীরে। এই রকম একটা সময়েই তোমার বন্ধু অঞ্জনের সঙ্গে তুমি আমার আলাপ করিয়ে দিয়ে পরোক্ষে আমার দারুণ উপকার করে ফেলেছো। আমি ঠিক যেমন মানুষের স্বপ্ন দেখতাম--অঞ্জন ঠিক সেই মানুষ। তোমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব হলো কি করে বলোতো? এমন অসম চরিত্রের দুটো মানুষ আর যাই হোক বন্ধু হয় কি করে? যাইহোক, প্রথম দিকে অঞ্জনের একটু দ্বিধা ছিল তোমার কথা ভেবে। ও তোমাকে ঠকাতে চাইছিল না। কিন্তু যখন বুঝলো আমার নিজেরই নির্বুদ্ধিতার জন্যে আমি নিজের কাছেই নিজে ভীষণভাবে ঠকে গেছে তখন আর ওর কোনো দ্বিধা ছিল না। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম আমরা বিয়ে করবো। কারণ আমরা ঠিক ততদূর এগিয়েছি যতদূর এগুলে বিয়েটা অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং আমি যাকে দেহে মনে গ্রহণ করবো তাকে বিয়ে করেই তার সঙ্গে জীবন কাটাবো এটাই আমার সিদ্ধান্ত। কারণ উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে আমার রুচি নেই।
বিভাসের হঠাৎ মনে হলো গোটা বাড়ি কেমন যেন বোবা হয়ে গেছে। কোনো হৈ-চৈ নেই! তাহলে কি সবাই ব্যাপারটা জেনে গেছে? জয়ন্তী কি মা-বাবাকেও চিঠি দিয়ে তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছে?
পরের পাতাটাও যন্ত্রচালিতের মতো কঙ্কনা টেনে নিয়ে পড়তে লাগলো। বিভাস আবার পড়িতি শুরু করলো--
--এখন আমাকে আবার বিয়ে করতে হলে তোমার সঙ্গে আমার আইনসম্মত বিচ্ছেদের প্রয়োজন। দু'এক দিনের মধ্যে আমি কাগজপত্র পাঠিয়ে দেবো। আমি জানি তুমি সই-সাবুদ করে দেবে। কারণ সই না করে জোর-জবরদস্তি করে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে ধরে রাখার চেষ্টা করার মতো হিম্মত তোমার নেই। বিশেষ করে এসব ব্যাপারে অনেকেই অনেককিছু বলবে যা তুমি কিছুতেই শুনতে চাইবে না। কারণ অসম্ভব ভালোমানুষের এই দুর্বলতাটাই মারাত্মক দুর্বলতা। এর জন্যে জীবনকেও বাজি ধরা যায়--তাই না?
তোমার ওই বাড়ি বানাবার জন্যে আমি যে চার লাখ টাকা দিয়েছিলাম সেটা একসঙ্গে ফেরৎ পেলেই আমার উপকার হয়। অসুবিধে থাকলে তুমি গোটা চারেক ইনস্টলমেন্টেও দিতে পারো। অবশ্য কঙ্কনা তোমাকে ভালোবাসে (যা:! বলে ফেললাম শেষপর্যন্ত! কঙ্কনা চায়নি তুমি কোনোদিন টের পাও। তোমার টের পাওয়ার কথাও নয়। তুমি কি কঙ্কনার চোখের দিকে তাকিয়ে কখনো ওর মনের কথা বোঝার চেষ্টা করেছো?), বেচারী কঙ্কনা--ভাবতে পারো--স্রেফ তোমার জন্যেই চিরকুমারী থাকবে বলে পণ করেছে! তোমার মতো 'ভালোমানুষের জন্য' এত সৌভাগ্য ঈশ্বর কোন আক্কেলে বরাদ্দ করেন কে জানে! সে যাইহোক, তুমি যদি কঙ্কনাকে বিয়ে কর তাহলে ওই চার লাখ টাকার সবটাই আমি আমার নির্বোধ বোনের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে দিয়ে দেবো। সেই সঙ্গে একটা অযাচিত উপদেশও দেবো--জীবনটাকে চেনার এবং জানার চেষ্টা করে একা একা নয, জীবনে যদি কাউকে আনো তাকে সঙ্গে নিয়েই সে চেষ্টা কোরো--জীবনের যথার্থ মানে খুঁজে পাবে।
আচমকা এখানেই চিঠিটা শেষ করেছে জয়ন্তী। বিভাস সত্যিই সবিস্ময়ে মুখ তুলে তাকালো কঙ্কনার মুখের দিকে। কঙ্কনা হাত বাড়িয়ে বললো--
--দাও শেষটুকু দেখি--
বিভাস নি:শব্দে শেষ পৃষ্ঠাটা বাড়িয়ে দিল। কঙ্কনা মন দিল চিঠিন পাতায়। বিভাস লক্ষ্য করছিল কঙ্কনাকে। চিঠি পড়তে পড়তে কঙ্কনার চোখমুখ লাল হয়ে উঠছে। চিঠি শেষ করে কঙ্কনা নি:শব্দে ছাদের কার্নিশের ধারে গিয়ে দাঁড়ালো।
বিভাস অনুমান করছে নীচে সবাই বিভাসের বিপর্যয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে নির্বাক হয়ে গেছে হয়তো। গৃহপ্রবেশের এই দিনটা এমনভাবে আসবে কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। কঙ্কনার চিঠি পড়া হয়ে গেলেও বিভাসের দিকে ফিরতে পারছে না। আজ পর্যন্ত কঙ্কনা ওর মনের কথা কোনো ছলেই বিভাসের সামনে প্রকাশ করার চেষ্টা করেনি। বিভাসও আজ পর্যন্ত এর বিন্দুবিসর্গ জানতো না।
পায়ে পায়ে বিভাস কঙ্কনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আড়চোখে ওর দিকে একবার তাকিয়ে বললো--
--জয়ন্তীর সব কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তোমার এ মতিভ্রম হলো কেন কঙ্কনা!
কঙ্কনা কোনো উত্তর দিল না। কিন্তু জয়ন্তীর মূল্যায়নের পর বিভাসের ভীষণভাবে জানতে ইচ্ছে করছিল কঙ্কনার কাছে বিভাসের গ্রহণযোগ্যতার মধ্যে অন্য কোনো বড় রকমের ভুল নেই তো? বিভাস তাই বোঝার চেষ্টায় জিজ্ঞেস করলো--
--আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না তো?
কঙ্কনা বিভাসের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। সরাসরি বিভাসের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো--
--দিদির কিছু কিছু অভিযোগের ভিত্তি আছে। আমারো মনে হয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দিদির ধারণা ঠিক। তবু সবটাই এভাবে রিয়্যাক্ট করা মতো বলে আমার মনে হয়নি। চেষ্টা করলে হয়তো দিদি পারতো তোমার সঙ্গে জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে। আমি বহুবার দিদিকে এ ব্যাপারে বোঝাবার চেষ্টা করেছি। সেই থেকেই হয়তো দিদির মনে হয়েছে--
--যা মনে হয়েছে তা কি সত্যি ঠিক নয়?
কঙ্কনার মনে হলো বিভাস ওর মুখ থেকে ছোট্ট 'হ্যাঁ' শব্দটাই শোনার জন্যে নি:শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। হ্যাঁ বলে দিতে পারলেই হয়তো ভালো হতো। কিন্তু কঙ্কনার মনে হলো--এই মুহূর্তটাকে বিশ্বাস করার মতো মুহূর্ত নয়। আবেগ আর জীবন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ঠিকই--কিন্তু পাল্লা একদিকে বেশি ঝুঁকে আছে কি না সেটাও তো বোঝা দরকার। কঙ্কনা বললো--
--এ ব্যাপারে পরে কথা হবে। এখন চলো নীচে যাওয়া যাক্--
--কিন্তু কোন্ মুখে যাবো সেখানে?
--যেতেই হবে বিভাসদা। এটা তোমার নিজের সমস্যা। এর মুখোমুখি তোমাকে হতেই হবে। পলাবার উপায় নেই যে!
বিভাস ভয়ঙ্কর এই মুহূর্তেও বুঝতে পারছিল জয়ন্তী ঠিক এইভাবে ওকে পুরুষ মানুষ হতে সাহায্য করেনি। বিভাস বললো--
--তুমি ঠিকই বলেছো! চলো নীচেই যাই--
সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে কঙ্কনা বললো--
--দিদির চার লাখ টাকা ফেরৎ দিতে কি খুব অসুবিধে হবে?
--এই মুহূর্তে এই বাড়ি করার পরে তো--
--এ বাড়ির আর কি প্রয়োজন? কিক্রি করে দেওয়া যায় না? দিদির জেদের জন্যেই তো এ বাড়ি--
--হ্যাঁ, তা ঠিক--দেখা যাক্--তাই হবে!

ড্রইংরুমে সকলে নিশ্চল হয়ে বসে দাঁড়িয়ে যেন ওদেরই অপেক্ষা করছিল। দরজার কাছে কাছা-পরিহিত ছেলেটাও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। বিভাস ঘরে ঢুকেই দেখলো মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওদের পায়ের শব্দ পেয়ে আঁচল সরিয়ে ডুকরে উঠলো--
--আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে বাবা! আমি আর এ মুখ কাউকে দেখাতে পারবো না বাবা!
হকচকিয়ে গেলো বিভাস। মায়ের এই তীব্র প্রতিক্রিয়া ওকে স্তম্ভিত করে দিল একেবারে! কোনোক্রমে বিভাস বলার চেষ্ট করলো--
--কি আর করা যাবে মা--
--তোর বাবার কাণ্ড দেখ তুই। ওই ছোঁড়াটা তোর বাবাকে বাবা বলছে! ওর মা মারা গেছে, তাই তোর বাবাকে নিতে এসেছে ছোঁড়াটা--
বিভাস প্রায় টলে পড়েই যাচ্ছিল। পাশ থেকে কঙ্কনা ওকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল।
--বাবা নিজেও স্বীকার করেছে। একই সঙ্গে দু'দিকে দু'টো সংসার--তুই ভাবতে পারিস দাদা!
ছোট বোন জয়ার চোখমুখ টকটকে লাল! জীবনের অদ্ভুত অপ্রত্যাশিত সব ঘটনা মানুষের নিজের নিজের ঢঙে গড়ে তোলা চেনা বৃত্তগুলোকে কি ভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় তা এক লহমা আগেও টের পাওয়া যায় না। বিভাস দেখলো ওর বাবা ছেলেটার সঙ্গে নি:শব্দে বেড়িয়ে গেল। কঙ্কনা মা-কে কিছু বোঝাচ্ছে। বিভাসের মনে হলো--ওকে আর একটা নতুন বৃত্ত গড়তে হবে যেখানে জয়ন্তী থ্কবে না, আর অবশ্যই বাবাও থাকবে না--!
(শেষ)
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×