প্রবাল নীচে নেমে যেতেই খামটা ছিঁড়ে ভেতর থেকে চার-পাঁচ পাতার একটা চিঠি বের করলো বিভাস। কঙ্কনা বিভাসের পাশ থেকেই সামান্য উঁকি দিয়েই জয়ন্তীর হাতের লেখা চিনতে পারলো। ভেতরে ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা টের পাচ্ছিল কঙ্কনা। কি আছে ওই চিঠিতে?
বিভাস পড়ছিল--
বিভাস, আমি জানি আজ এই চিঠি না লিখলেই ভালো হতো। কিন্তু আজ ওই বাড়িতে কাটিয়ে দু'দিন পরে এই চিঠি পাঠালে আরো খারাপ হতো। যতই হোক সেটা বড় রকমের প্রতারণার ব্যাপার হযে যেতো।
আমি তোমার জীবন থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়েছি মাস তিন-চার আগেই। কিন্তু ঠিক কিভাবে কেমন করে এই ব্যাপারটা তোমাকে জানানো যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না। অবশ্য অন্য কোনো লোক বা অন্য কোনো সামান্য সেন্সেটিভ হাজব্যাণ্ড হলে আমার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকেই ব্যাপারটা টের পেতো। কিন্তু তোমার তো ও-সবের বালাই নেই। ফলে আমাকে এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রায় তিনমাস ধরে ভাবতে হয়েছে। এদিকে দেখতে দেখতে তোমার নতুন বাড়িতে সাড়ম্বরে প্রবেশের দিন এসে গেল। তোমার মা-বাবার মতে গৃহপ্রবেশের পুজো-পাঠে আমাদের যুগলে বসা উচিত বলে রায় দিলেন। আমাদের এই বাঙালী পরিবারেও 'কিঁউ কি শাস্ ভি বহু থী' কালচার জাঁকিয়ে বসছে--অবশ্য আমার এতে কোনো আপত্তিই নেই।
নতুন বাড়ির জন্যে তুমি ভীষণ ছোটাছুটি করছো, প্রায়ই রাত করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরো--মনে মনে গুছিয়ে রাখা সত্ত্বেও কথাগুলো বলতে পারিনি। বলার সুযোগই হচ্ছিল না। শেষপর্যন্ত আজকের এই দিনটাকেই বেছে নিতে হলো। আমি আজ কি করে তোমার সঙ্গে পাশাপাশি বসে গৃহপ্রবেশের পুজোপাঠে অংশ নিই? যে বাড়িতে আমি তোমার সঙ্গে থাকবো না--ঘর-সংসার করবো না, অন্য একজনের সঙ্গে জীবন কাটাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে সে-ই আমি কি করে আজ ওই বাড়িতে যাই?'
এই পর্যন্ত পড়ে মুখ তুলে বিভাস কঙ্কনার মুখের দিকে তাকালো। চোখেমুখে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে কঙ্কনা ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। বিভাস প্রথম পাতাটা কঙ্কনার দিকে এগিয়ে দিল। প্রায় ছোঁ মেরে কঙ্কনা সেটা নিয়ে দ্রুত পড়তে লাগলো। বিভাস ফের পড়তে লাগলো--
--বিয়ের আগে সামান্য মাস ছয়েকের আলাপে কেন তোমাকে আমি পছন্দ করেছিলাম আমি নিজেই আজ তা বুঝতে পারছি না। সকলকে অবাক করে তোমাকে বিয়ে করার সাত দিনের মধ্যেই আমি টের পেয়েছিলাম আমি মারাত্মক ভুল করে বসেছি।
না, তোমার মধ্যে দোষের কিছুই নেই। তুমি মদ খাও না। ক্লাবে যাও না। মেয়েদের নিয়ে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ফ্লার্ট করো না। মা-বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারো না। কারুর সঙ্গে ঝগড়া করো না। কেউ কোনো কারণে যেন তোমার দিক থেকে দু:খ না পায় সে ব্যাপারে সদা সদর্ক থাকো। এমন কী তোমার প্রচণ্ড প্রয়োজনেও আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আমার শরীরে হাত দাও না। সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর প্রতি বিশেষ মনযোগ দিলে পাছে কেউ কিছু মনে করে কিংবা তোমাকে স্ত্রৈণ বলে--এই আশঙ্কায় সকাল সকাল বেডরুমে আসতেও তোমার সঙ্কোচ ছিল। সর্বদা সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে। আমি ঘরের মধ্যে একলা ক্লান্ত হতাম। আমার শরীর ঘুমিয়ে পড়তো। আমার স্বপ্ন আমার উচ্ছ্বলতা সব কিছু ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যেতো।
আমাদের একসঙ্গে বাইরে গিয়ে হৈ-চৈ করা উচিত ছিল। মাঝে মাঝে বাইরে খাওয়া দাওয়া করে রাত করে বাড়ি ফেরার প্রয়োজন ছিল। সময়-অসময়ে আমাকে নিয়ে আমার শরীর নিয়ে তোমার উন্মত্ততার প্রয়োজন ছিল। এসব প্রয়োজনকে আমি আমার জীবনে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করতাম--তুমি তা করতে না। আমার শরীর নিয়ে খেলা করার সময়েও (দৈবাৎ কখনো) যদি হঠাৎ তোমার মা-বাবার গলার আওয়াজ পেতে কিংবা জানলার পাশ দিয়ে হঠাৎ কোন পাখি উড়ে যাওয়ার শব্দ হতো তুমি একেবারে রক্তশূন্য মমি হয়ে ছিটকে যেতে পাঁচ হাত দূরে। তুমি একজন পুরুষ বটে--কিন্তু তার আগে তুমি একজন অসম্ভব রকমের ভালো মানুষ--যার সঙ্গে দু'চার পা হাঁটা গেলেও বিছানা শেয়ার করা যায় না। আমি একজন স্বাভাবিক কামনা বাসনায় চঞ্চল পুরুষমানুষ চেয়েছিলাম--যে তার চাহিদা পূরণের আকর্ষণীয় রাস্তাগুলো খুঁজে নিতে পারে। তোমার মতো ভালোমানুষের আকাঙ্ক্ষা আমার স্বপ্নেও ছিল না কখনো!
বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তোমার মা-বাবা সেই আদিম আদিখ্যেতা নিয়ে আসরে নেমে পড়লেন--নাতির মুখ দেখে মরতে চান! যেন রাত কাটে তো দিন কাটে না। কেন জানি না তোমার বাবার নানারকম আদিখ্যেতা আর কথাবার্তা শুনে আমার ভদ্রলোকের ভেতর-বার একরকমের মনে হয়নি। যদিও আমার জীবনে সেটা কোনো সমস্যা ছিল না। কারণ আমার জীবনে তোমার ভূমিকাটাই ছিল প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ!'
কঙ্কনা এবার নিজে থেকেই হাত বাড়িয়ে পরের পাতাগুলো টেনে নিল। বিভাসের একটু দ্বিধা ছিল মনে হলো কঙ্কনার।
বিভাস চিঠিটা যতই পড়ছে ততই যেন নিজেকে অন্যরকম করে আবিষ্কার করছে। নতুন সম্পর্ক মারেই কি চরিত্র বদলের অলিখিত শর্ত পূরণ? নিজেকে বদলাতে না পারলেই কি পরিচিত পৃথিবী, নিজস্ব বৃত্ত-রেখা-মুখ বদলে যাবে?
জয়ন্তী যে সব অভিয্গে করেছে হয়তো ওর দিক থেকে তার যথার্থতা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু বিভাস তো ওই সব ব্যাপারগুলোকে ঠিক এই ভাবে দেখেনি কখনো। দুটো মানুষের ভাবনা চিন্তা কি একই রকম হওয়া সম্ভব? না হলে কোথাও না কোথাও দুজনকেই কিছুটা দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে বোঝাপড়া করে নিতে হয়। জয়ন্তী তো সেরকম কোনো সুযোগই রাখলো না! এত সহজে এত অঙ্গীকার এত স্বপ্ন পেছনে ফেলে চলে যাওয়া যায়?
অবশ্য জয়ন্তীর মতে বিভাসের কোনো স্বপ্নই ছিল না। বিভাস শুধু ভালো মানুষই হতে চেয়েছে--জয়ন্তীর মতো মেয়ের স্বামী হতে চায়নি!
বিভাস দেখতে পেলো একটা সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলে (কাছা পরিহিত), সদ্য মা বা বাবাকে হারিয়েছে, বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো। হয়তো সাহায্য-টাহায্য চায়। বিভাস ফের চিঠিতে মন দিল। জয়ন্তী লিখেছে--
(চলবে)