জয়ন্তীর অপেক্ষায় বাড়ির সকলেই প্রায় বিস্মিত এবং বিরক্ত হয়ে উঠছে ক্রমশ:। হওয়াই স্বাভাবিক। অন্তত: আজকের দিনটিতে নিজের ভূমিকাটা কি সেটা জয়ন্তীর বোঝা উচিত ছিল। নতুন গৃহ-প্রবেশের অনুষ্ঠানে হাজির থাকার জন্য মা-বাবা সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যেই সল্টলেক থেকে শ্রীরামপুরে চলে এসেছেন। ব্যাণ্ডেল এবং কালনা থেকে দুই বোন কল্যাণী আর জয়াও চলে এসেছে সাড়ে আটটার মধ্যে। পুজোর আয়োজনও সম্পূর্ণ। এদিকটা এবারেও মাকেই সব করতে হলো। অথচ আজকের দিনটিতে অন্তত: এসব কাজ নিজে পুরোপুরি করতে না পারলেও জয়ন্তীর উচিত ছিল মায়ের পাশাপাশি থাকা। তাঁকে সাহায্য করা। বিভাসের মনে হলো সে আজও জয়ন্তীকে ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারেনি।
গোটা বাড়িতে আজ পাঁচমিশেলি কথা-বার্তা হৈ-হুল্লোড়-হাসি চকিতে দু'চার কলি গান ঠাট্টা তামাশায় ঝলমল করছে। এসবেরই ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ করে লোডশেডিং-এর মতো সকলেরই মনে পড়ে যাচ্ছে জয়ন্তীর অনুপস্থিতির কথা। দু'এক মুহূর্তের জন্যে সকলেরই মুখ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। সকাল থেকে না-হোক হাজার বার বিভাস সেলফোনে জয়ন্তীর নাম্বারে ট্রাই করে চলেছে--কিন্তু স্যুইচ্ অফ করে রাখলে কথা বলবে কার সঙ্গে!
সকাল ন'টার মধ্যে পুজোয় বসার কথা। সাড়ে দশটা বাজতে চলেছে। জয়ন্তী নাকি সকাল ছ'টার মধ্যেই বেড়িয়ে পড়েছে কালীঘাটে পুজো দিয়ে সোজা শ্রীরামপুরে চলে আসবে বলে। বিভাস গতকাল অফিস থেকে সোজা এখানে চলে এসেছিল। প্রাথমিক প্রস্ততির প্রয়োজনেই ওকে আসতে হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরেই আসবাবপত্র দিয়ে ঘর সাজানোর কাজটা অবশ্য ইন্টিরিয়র ডেকরেটরই করেছে। আলোর সাজ-সজ্জাও যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শেষ করতে হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর থেকেই গ্লোব নার্শারি খেকে বাছাই করে নানান রকমের ফুলের চারা-বীজ আনিয়ে লোক দিয়ে গোটা পঁচিশেক টব সাজিয়েছে বিভাস এবং এসবই হয়েছে জয়ন্তীরই ইচ্ছেতে।
নানা রঙের ফুলে পূর্ণ টবগুলো ডেকরেটররাই গোটা বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় সাজিয়ে দিয়েছে। বাড়ির চেহারাটাই দুচোখ ভরে দেখার মতো হয়ে উঠেছে। নতুন বাড়িটা আজ সত্যিই স্বপ্নের বাড়ি হয়ে উঠেছে। অথচ জয়ন্তী...
মা-বাবা এবং ছোটভাই প্রবাল কারুরই ইচ্ছে ছিল না বিভাস আলাদা বাড়ি করে সল্টলেকের বাড়ি খেকে বউ নিয়ে চলে যায়। সল্টলেকের বাড়িতে সকলের জন্যেই যথেষ্ট জায়গা ছিল। পরিবারও এমন কিছু বৃহৎ নয়। পারিবারিক ক্রিয়াকর্ম ছাড়া বাড়িতে ভিড়-ভাট্টা হয় না। যদিও সেরকম পরিস্থিতিতে দু'চার দিনের জন্যে সকলেই বেশ মানিয়ে নেয় এবং মানিয়ে নেওয়াটা কর্তব্য বলেই বিভাস মনে করে। তবু বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলো জয়ন্তীর জন্যেই। ওর স্বাধীনতা নাকি বিঘ্নিত হচ্ছিল। একটু রাত করে বাড়ি ফিরলে মা-বাবার মুখ ভারি হয়ে ওঠে। জয়ন্তীর আধুনিক সাজসজ্জা পছন্দ না হলে মা মুখের ওপর নাকি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনিয়ে দেয়। মোটকথা জয়ন্তীর আধুনিক জীবনযাত্রা নাকি পদে পদে বিঘ্নিত হচ্ছিল। কিন্তু এসব বিশ্বাস করা বিভাসের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ মা-বাবা দুজনের একজনও প্রাপ্তবয়ষ্ক ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি-ঝুঁকি মারার কথা ভাবতেই পারেন না। সে ধরণের গ্রাম্য সংস্কৃতি ওঁদের আদৌ নেই। আর নেই বলেই শ্রীরামপুরের নতুন বাড়িতে উঠে যাওয়ার কথা শুনেও কেউ কোনো কথাই বলেননি। জানতেও চাননি বিভাসরা এরকম একটা গুরুতর সিদ্ধান্ত কেন নিল। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ওঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করার সাহস হয়নি বিভাসের। ভেবেছিল যে কোনো সুযোগে বলে দেবে কথাটা। মা শুধু একবার জানতে চেয়েছিল এ বাড়িতে ওদের কি অসুবিধে হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে বলেছিল ওরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাক এটা এ বাড়ির কেউ চায় না। তবু যদি যেতে চায় তাহলে অবশ্য কেউ বাধাও দেবে না!
নতুন ছাদের রেলিঙে হেলান দিয়ে নীচের লনে খোশমেজাজে যাতায়াতরত লোকজনদের দেখছিল বিভাস। ভেতরে ভেতরে একটু দুর্ভাবনাও হচ্ছিল। রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি তো? বিভাসের হঠাৎ মনে পড়ে গেল অঞ্জনের কথা। ওরও তো সকাল সকাল আসার কথা ছিল। অঞ্জনের এতো দেরি হচ্ছে কেন?
জয়ন্তীর সঙ্গে অঞ্জনের বন্ধুত্ব নিয়ে বিভাসের তেমন কোনো সংশয় ছিল না বটে, তবে অন্যান্য বন্ধুদের তুলনায় অঞ্জনকে জয়ন্তী একটু বেশি গুরুত্ব দেয় কেন এটা বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখেছে অঞ্জনের ব্যাপারে জয়ন্তীর একটা মানসিক সংযোগের ব্যাপার কিছু আছেই যেটা খুব হাল্কা করে অন্য কেউ হলে বোধহয় দেখতো না।
বিভাস অঞ্জনকে ফোনে ধরার চেষ্টা করলো। বাড়ি থেকে ওর মা বললেন, অঞ্জন কোথাও বেড়িয়েছে। হয়তো বিভাসের নতুন বাড়িতেই গেছে। ওখানেই তো যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অঞ্জন এখনো আসেনি!
--বিভাসদা, তুমি সত্যিই জানো না দিদি কোখায় গেছে?
ঠিক ঘাড়ের ওপর কঙ্কনার নি:শ্বাস পড়তেই চমকে উঠলো বিভাস। জয়ন্তীর ছোট বোন কঙ্কনা। চমৎকার দেখতে। একটা বেসরকারি চ্যানেলে খবর পড়ে। আধুনিকতার এবং অত্যাধুনিক সাজসজ্জার একটা জীবন্ত মডেল হতে পারতো কঙ্কনা। কিন্তু সে তা হয়নি। একেবারেই না সাজার মধ্যেই নিজেকে অসাধারণ সজ্জিত করে তোলার স্বাভাবিক দক্ষতা আছে মেয়েটার এবং এটাই ওর সবচেয়ে নজর কাড়ার মতো প্রধান গুণ। শুধু এদিকেই নয় অন্যান্য সমস্ত দিক থেকেই কঙ্কনা একবারে জয়ন্তীর বিপরীত মেরুর মেয়ে। অনেক বিষয়েই ওর নিজস্বতা আছে যা সহজেই অন্যকে আকৃষ্ট করে। বিয়ের বয়স হয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু বিয়ের কথায় তেমন করে গুরুত্বই দেয় না!
(চলবে)