তারাপদ ঘরে ঢুকে সরাসরি তাকায় রাণীর দিকে নিত্যদিন। রাণীর চোখ প্রায় বুঁজে আসে। ইচ্ছে করেই বোধহয় এই সময়টাতেই রাণী তার আদুর শরীরে শুধু একটা শাড়ি জড়িয়ে রাখে। নিটোল দুটো হাত কাঁধ গলা এবং শাড়ির ফাঁক ফোকরের দুধে-আলতার তীব্র দ্যুতি তারাপদকে বিবশ করে তোলে। শরীরের সম্পদ এখনও ফেটে পড়ে রাণীর। হাত বাড়ালেই মণিমুক্তো। জোর খাটালে রাণীর কিছুই করার নেই। কিন্তু সকালে উঠে যদি দ্যাখে রাণীর দুধে আলতা শরীর নীলবর্ণ হয়ে পড়ে আছে--তাহলে? বুকের মধ্যে তুফান ওঠে তারাপদ'র। বুক খালি করে ফোঁস করে একটা লম্বা নি:শ্বাস ফেললো তারাপদ। দু'পা পিছিয়ে যেতেই রাণী পিছন ফিরে দরজায় খিল দিয়ে দিল। খোলা দুধে-আলতা পিঠের ওপর আচমকা মুখ গুঁজে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হয় তারাপদ'র। পারে না।
--চেনটা এনেছো?
নাকে আঁচল চাপা দিয়েই নাকি সুরে জানতে চাইলো রাণী।
--হ্যাঁ, এনেছি।
শার্টের পকেট থেকে দু'ভরির চেনটা বের করে রাণীর চোখের সামনে তুলে ধরলো।
--এখানে দাও।
বাঁ-হাতে আঁচলের একটা অংশ মেলে ধরলো রাণী। তারাপদ'র বুকে ঢাকের গর্জন শোনা গেলেও অচঞ্চল তারাপদ আলতো করে চেনটা রাণীর আঁচল ঢাকা হাতের তালুতে ফেলে দিল।
কাল হরিশের জন্মদিন। রাণী চেনটা ওকে উপহার দেবে। ভালোমন্দ খাওয়াবে। ছেলেরা আজকাল সোনার চেন গলায় পরে।
হরিশ তারাপদ'র তুলনায় বেশ শক্ত সমর্থ তাগড়াই যুবক। বয়সেও অনেক ছোট। রাণীর চেয়ে খুব বেশি হলে এক আধ বছরের বড় হবে। সামনা সামনি হলে তারাপদকে বেশ মান্যিগণ্যি করে। ভাবটা এমন দেখায় যেন সে লাশবাবুর স্নেহধন্য শালাবাবু!
তারাপদ'র বুকে তীব্র জ্বালা ধরাতে রাণী হরিশকে নিয়ে যে মাঝেমধ্যেই বাড়াবাড়ি করে ফেলে এটা হরিশও বোঝে। সে বিব্রত বোধ করে। তারাপদ'র মুখের দিকে তাকাতে তখন তার বেশ লজ্জাই করে। রাণীকে বোঝালেও বোঝে না। অথচ রাণীকে এখন আর এড়িয়ে চলার ক্ষমতা তার নেই। রাণীর টানে অতলে তলিয়ে গেছে হরিশ। এর পরিণতি কি হবে তার জানা নেই। যাইহোক না কেন রাণীর টান উপেক্ষা করে সরে যাওয়ার ইচ্ছে হয় না তার। রাণী এখন তার তীব্র নেশা।
দেখতে দেখতে আরো আট-দশ দিন কেটে গেল। তারাপদ অস্থির হয়ে উঠেছে। এবারের অর্ডারটা বাংলাদেশের এক ব্যাপারীর। দেশ বিদেশে মাল চালানোর ওস্তাদ আরিফুল ভাই প্রায়ই সীমানা টপকে এপারে চলে আসে। চারদিকে তার আটঘাট বাঁধা। একসঙ্গে শ'খানেক মাল বেমালুম পাচার করতে পারে। আরিফুল দামও দেয় অবাক করার মতোই।
শেষপর্যন্ত মেদিণীপুরের ব্যাপারী নিমাই মাইতির কাছেই লোক পাঠাতে হবে নাকি কে জানে! নিমাই মাইতি অবশ্য তৈরি মাল পাঠাবে পাইকারী রেটেই। ওদিকে এখন মালের দাম কিছুটা কম। গত দু'তিন বছরে বেমক্কা দু'দশ পিস মাল মাইতির হাতে প্রায়ই এসে যাচ্ছে। অবশ্য সব মালই হাড়ভাঙ্গা হাড় কাটা। গোলাগুলি কিংবা চপারের কোপে খালাস হওয়া মাল। মাঝে মাঝেই যে দু'দশ জন করে উধাও হয়ে যাচ্ছে সে সবই এখন মাইতির হাতে এসে যাচ্ছে। হলদি নদীর ধারে ধারে মাইতির বহু মাল জমে আছে বলে শুনেছে।
মালের চিন্তায় যখন মনটা বেশ উচাটন ঠিক তখনই ঘটলো ঘটনাটা।
কালনা-পাণ্ডুয়া রুটের প্যাসেঞ্জার ঠাসা একটা বাস অ্যাক্সিডেন্ট করলো। সামনের একটা চাকা আচমকা বিকট শব্দে ফেটে গিয়ে মাতালের মতো এদিক ওদিক করতে করতে একেবারে রাস্তার ধারের একটা খালে গিয়ে উল্টে গেল। সন্ধ্যের মুখে এই দুর্ঘটনা ঘটার প্রায় তিনঘন্টা পরে পুলিশ এলো। ততক্ষণে বহু লোক জমে গিয়েছে অকুস্থলে।
বাসের ভেতরের অনেকেই দম আটকে মরে গেছে। আধমরার সংখ্যাও কম নয়। রাত আটটা নাগাদ খবরটা কানে এলো তারাপদ'র। তার লোকজন অবশ্য ঘটনা ঘটার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার নেমে এসেছে। কয়েকশো লোকের চেঁচামেচির মধ্যে কেউ কারুর কথা শুনতেই পাচ্ছে না। এর মধ্যেই টেনে হিঁচড়ে পনেরোটা লাশ তুলে এনে রাস্তার ওপর সার দিয়ে রাখা হয়েছে। আরো যে কত লাশ জলের মধ্যে পড়ে আছে কে জানে!।
বাঁধের ওপর অন্ধকারের মধ্যেই দুটো রিক্সাভ্যান এসে থামতেই তারাপদ'র শিরদাঁড়া টানটান হয়ে গেল। খোলা আকাশের নীচের অন্ধকারে ততটা গাঢ় হয় না। অন্ধকারে কাজ করতে করতে চোখের দৃষ্টি অন্ধকারে বেশ চলাচল করে।
দুর্ঘটনার কথা কানে যাওয়া মাত্র তারাপদ সময় নষ্ট না করে নদীর ধারে চলে এসেছে। দুটো রিক্সাভ্যানে আটটা লাশ! সবগুলোই প্রমাণ সাইজের। পাঁচটা পুরুষ আর তিনটে নারীর লাশ।
চটপট লাশগুলো একটা ঢিপির আড়ালে রেখে লোকগুলো ঝপাঝপ বালি খুঁড়তে লেগে ঘেল। তারাপদ দেশলাই কাঠি জ্বেলে জ্বেলে বডিগুলো দেখতে লাগলো। চেনা কেউ আছে কি না কে জানে! দেখতে দেখতে একটা মুখ দেশলাইকাঠির আলোয় স্পষ্ট হতেই অবাক হলো তারাপদ! হঠাৎ তার মনে হলো যতক্ষণ জীবন ততক্ষণই নাচোন কোদন। প্রাণটা বেরিয়ে গেলেই লাশ বই আর কিছুই নয়। যতক্ষণ না বডির গতি হচ্ছে ততক্ষণ কী অশান্তি--কী যন্ত্রণা!
লাশের জামাকাপড়গুলো খোলা হয়নি। মেয়ে শরীরগুলোয় যা কিছু সোনাদানা ছিল ওরা খুলে নিয়েছে। পুরুষগুলোর হাতের ঘড়ি আংটিও খুলে নিয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কলার ওলা গেঞ্জির ভেতরে লুকিয়ে থাকা একটা সোনার চেন ওদের নজর এড়িয়ে গেছে।
তারাপদ চেনটা খুলে নিয়ে পকেটে রেখে দিল। তার এক সহকারীকে ডেকে বলে দিল--এই লাশটা একটু তফাতে আলাদা করে পুঁতে রাখে যেন!
একটা একটা করে দনি গড়ায় আর রাণী অস্থির হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝেই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায় এদিক ওদিক। ফিরে আসে যখন ক্লান্ত হতাশ এবং অসুস্থ মনে হয় ওকে।
হরিশের কোনো খোঁজ নেই। হঠাৎ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সে। মাঝে মধ্যেই উড়ে আসা উড়ো খবর শুনে রাণী ছুটে যায় এখানে সেখানে। কিন্তু কোনো সন্ধানই পায় না।
চোখের কোণে কালি পড়ে গেল। দেখতে দেখতে কন্ঠা উঁচু হয়ে গেল। সাজ-সজ্জা খাওয়া দাওয়াতেও রাণীর এখন একেবারেই রুচি নেই।
তারাপদ ইদানীং বাড়িতে একটু বেশি সময় কাটায়। রাণী হঠাৎ হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। এখন আর নাকে আঁচল চাপা দেয় না। তীব্র আগুনঝরা চোখে মাঝে মাঝেই তারাপদ'র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করে।
তারাপদ'র নির্বিকার ভাবলেশহীন মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না রাণী। সামনে থেকে সরে যায়।
(চলবে)