তারাপদ'র হিলহিলে চেহারা। চোখমুখ মন্দ নয়। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। কিন্তু রাণীর রঙ দুধ-আলতা! প্রথম দু'আড়াই বছর তারাপদ পাগল হয়ে গিয়েছিল প্রায়। কাজের সময়টুকু ছাড়া সে বাড়ি ছেড়ে নড়তো না। রাণীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হতে দেরি হয়নি। তার চাহিদাও বেড়েছে দিন দিন। কুলিয়ে উঠতে পারছিল না তারাপদ। অথচ রাণী চাইলে আকাশের চাঁদ এনে দিতেও তার কুণ্ঠা নেই।
বেওয়ারিশ লাশ কি ভাবে লাশঘর থেকে উধাও করতে হয় সে সম্পর্কে তারাপদকে শিক্ষিত করেছিল নরেন বিশ্বাস। হুগলীর এক কঙ্কাল-ব্যাপারীর এজেন্ট ছিল সে। বেওয়ারিশ লাশ মাঝেমধ্যে দু'চারটে এসে যেত। দু'একটা উধাও করার কাজে তারাপদ পরিপক্ক হয়ে ওঠায় বাড়তি বেশ দু'চার পয়সা হাতে আসছিল ঠিকই, কিন্তু তাতেও সুরাহা হচ্ছিল না।
তারাপদই শেষপর্যন্ত নরেনকে বললো সে লাশবাবুর চাকরি ছেড়ে কঙ্কালের ব্যাপারী হবে। নরেন এক কথায় রাজি। তারাপদকেও সে মাল জোগাড় করে দেবার কথা দেয়।
কাজে নেমে প্রথম কয়েকটা মাস টানাটানি গেছে। বাড়ি ফিরতে প্রায়ই গভীর রাত হয়ে যেতো। জামাকাপড় পাল্টে গা-হাত-পা ধুতে সময় লাগতো। রাণী প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়তো। কাজ বেশ জমে উঠতেই এক রাতে রাণী তারাপদ'র গোটা শরীরে পচা লাশের গন্ধ পেয়ে বমি করতে করতে বেদম অসুস্থ হয়ে পড়লো।
তারপর যখনই তারাপদ রাণীর কাছে যায় রাণী নাকে আঁচল চাপা দিয়ে চোখ বুঁজে মরার মতো পড়ে থাকে। শোবার ঘরের বিছানায় কিছুতেই রাণীর নাক ও মন থেকে পচালাশের গন্ধ মুছে ফেলতে পারলো না তারাপদ।
স্বাভাবিক শারীরিক সম্পর্ক প্রথম প্রথম থাকলেও পরে ধীরে ধীরে তারাপদ'র প্রয়োজনটাই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। রাণী তারাপদ'র প্রয়োজনেও সাড়া দিতে চাইতো না। শেষপর্যন্ত পচালাশের গন্ধ তার আর রাণীর মধ্যে অনতিক্রম্য দূরত্ব তৈরি করে ফেললো। রাণী এখন আর তারাপদকে কাছেই ঘেঁষতে দেয় না। আকণ্ঠ চোলাই গিলে মাঝে মধ্যে জোর জবরদস্তি করতে গিয়ে ফল আরো মারাত্মক হয়েছে। বালিশের নীচে থেকে একমুঠো কলকে বিচি বের করে তারাপদ'র বিস্ফারিত চোখের সামনে মেলে ধরে বলেছে রাতেই বেটে খাবে!
তারাপদ'র আর সাহস হয় না। উত্তর দিকের নধর কলকে ফুলের গাছটা কেটে ফেলেছে। মিষ্টি গন্ধ ছড়ানো হলুদ ফুল আর ফোটে না। কিন্তু দেশে তো আর বিষের অভাব নেই--কিংবা দড়ি! গঙ্গাও তো একশো গজ দূরেই।
রাণী মরে যাবে কিংবা তার সংসার ছেড়ে চলে যাবে এমনটা তারাপদ ভাবতেই পারে না। একটু বেশি বয়সে প্রায় কিশোরী রাণীকে মায়ের চাপে বিয়ে করতে হয়েছিল। প্রথম দু'আড়াই বছরের সেই সোহাগ ভালোবাসা তারাপদ চেষ্টা করেও ভুলতে পারে না। তার গভীর দু:খ একটাই--দু'একটা ছেলে-মেয়ে যদি তাদের হতো--তাহলে হয়তো রাণী এমনটা হয়ে যেতো না।
প্রথম যেদিন বাড়ির বেড়ার পাশে মোটর সাইকেলটা দেখেছিল সেদিন তার তেমন কিছু মনে হয়নি। রাণীদের গাঁয়ের ছেলে হরিশ হাঁসপুকুরে বাঁশের ব্যবসা করে। এখানে বিঘের পর বিঘে বাঁশ বাগান। বাঁশ কেটে কেটে গঙ্গার পাড়ে এনে লেবাররা জমা করে। তারপর কয়েকহাজার বাঁশ দিয়ে ভেলা বানিয়ে গঙ্গার ওপর দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কলকাতা পর্যন্ত। হরিশের কাজ গঙ্গার পাড়ে বাঁশ পৌঁছে দিয়ে ব্যাপারীর কাছ থেকে হিসেব বুঝে নেওয়া। তাই ঘন ঘন তারাপদ'র বাড়ির পাশ দিয়ে ঘাটে যাতায়াত করতে হয়।
তারপর যা হবার তাই হলো। রাণী পথ চেয়ে বসে থাকে। হরিশ এলেই প্রাণখোলা হাসি গল্প। এটা সেটা খাওয়া-দাওয়া। হরিশ যতক্ষণ থাকে তারাপদ ততক্ষণ ফালতু। ভেতরে ভেতরে নানারকমের খুনখারাপি রক্তপাত হতে থাকে। কিন্তু বাইরে তারাপদ নির্বাক বিষণ্ণ।
মোটরবাইকের পেছনে বসে হরিশের কাঁধে হাত রেখে ক্যালেণ্ডারের মেয়েছেলে হয়ে রাণী ওর চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যায়। সিনেমা মেলা সর্বত্রই হরিশ রাণীর সঙ্গী।
তারাপদ বোঝে রাণী আর তার নয়। শুধু সেই ভয়ঙ্কর দিনটার অপেক্ষায় সে কাঁটা হয়ে থাকে--যেদিন রাণী হরিশের সঙ্গে বেরিয়ে আর ঘরে ফিরবে না।
তবু তারাপদ কর্তব্যকর্মে এতটুকু ত্রুটি রাখে না। শাড়ি-গয়না-টাকাপয়সা যখন যা লাগে কোনোকিছুতেই তার না নেই। প্রতিবছর বিয়ের দিনটাতে কিছু না কিছু দামী উপহার নি:শব্দে রাণীর ড্রেসিংটেবিলের ওপর রেখে আসে।
কাছাকাছি সকলেই তারাপদকে কাপুরুষ বলে। ঘরের বউকে বশে রাখতে পারে না যে পুরুষ সে আবার পুরুষ কিসের? তারাপদ তর্ক-বিতর্ক করে না। শুধু নীরবে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানায়--কখনো যেন এমন কোনো অবস্থায় হরিশ আর রাণীকে একসঙ্গে না দেখে ফেলে যখন তার ভেতরের বীভৎস রকমের খুনখারাপির ঘটনাগুলো ঘটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়!
গর্ত খোঁড়া শেষ। প্লাস্টিক খুলে মালগুলো বের করতেই একটা তীব্র কটূগন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে গেল। চটপট গর্তের মধ্যে সোজা দাঁড় করিয়ে বালি চাপা না দিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই কুকুরগুলো ছুটে এসে চিৎকার জুড়ে দেবে।
চারটের মধ্যে তিনটে বেটাছেলের লাশ। একটা মেয়েছেলের। দু'জন বিষ খেয়েছিল। একজন গলায় দড়ি দিয়েছিল। আর একজন রাতে রাস্তার ধারে শুয়ে আর ওঠেনি। শেষরাতে তারাপদ'র লাশ খোঁজার লোক গুঁতো মেরে টের পেয়েছিল ঘুমের মধ্যেই সেঁটে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিকে মুড়ে ভ্যানে তুলে হাওয়া!
এরা সকলেই এখানে ওখানে ভিক্ষে করতো। নির্দিষ্ট কোনো ঘরদোর ছিল না। এইসব লাশের দাবিদার খুব একটা থাকে না। থাকলেও খরচের ভয়ে ধারে কাছে আসে না।
এদের কেউ গুলি করে মারেনি। সোর্ড কিংবা চপার দিয়ে কূপিয়ে খুন করেনি। অর্থাৎ হাড়ের কোনো ক্ষতি হয়নি। হলে স্টিলের তার দিয়ে জোড়া-তালি দিতে হতো। দামও অনেক কমে যেতো। এগুলোর দাম ভালোই পাওয়া যাবে।
সকলে ধরে ধরে লাশগুলো সোজা গর্তের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিল। তারাপদ ছাড়া সকলেরই নাকে গামছা জড়ানো। দুটো মাল ইতিমধ্যেই নরম হয়ে গেছে। মাস তিনেকের মধ্যেই সবটুকু গলে বালির সঙ্গে মিশে যাবে। তারপর ধোয়া-মোছা পালিশ--অনেক কাজ থেকে যায়। হাতে যা অর্ডার আছে তার তুলনায় মাল এখন অনেক কম। দু'চারদিনের মধ্যে অন্তত: গোটা দশেক মাল না পেলে সময়মতো ডেলিভারি দেওয়া যাবে না।
বালি চাপান দিতে দিতে বারোটাই বাজলো। লেবারগুলো টাকা নেবে সকালে। এখন নদীতে নেমে পলিমাটি দিয়ে গা-গতর হাত-পা ঘষে ঘষে স্নান করবে। তারপর চোলাইয়ের বোতল নিয়ে বসবে শ্মশান ঘাটের আশেপাশে কোথাও!
বেড়া ঠেলে উঠোনে পা দেওয়ার আগে নিত্যদিনের মতো আজও চারপাশে টর্চ জ্বেলে দেখে নিল তারাপদ। পশ্চিমের বাঁশঝাড়ে নিকষ অন্ধকার। অন্ধকারের মধ্যে অজস্র জোনাকীর ওড়াউড়ি। এই একটা দৃশ্য তারাপদ'র চোখে পুরোনো হয় না কখনো। দু'চার মুহূর্ত নিজেকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়ে জোনাকীর আলো দেখলো তারাপদ। তারপর বারান্দায় উঠে জুতো খুলে বালতির জলে পা দুটো ভালো করে ধুয়ে নেয় ঘষে ঘষে। পা ধুতে ধুতেই রাণীর ঘরের আলোর তেজ বেড়ে যায়। দরজা খুলে নাকে আঁচল চেপে কপাটের প্রায় আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে কাঠের পুতুলের মতো।
(চলবে)