আকাশের মুখ ভার ক'দিন ধরেই চলেছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি। কখনও তুমুল কখনও টিপ-টিপ। রেললাইনের ধারে প্লাস্টিক ভাঙ্গা টিন বাঁশের চাটাই দিয়ে বানানো ঘরে দুধের মেয়ে নিয়ে ইরা'র ঘর-সংসার। ইরা এখানে হিন্দু হয়ে বসবাস করছে। আসল নাম ইরফাত বেগম।
বাংলাদেশ থেকে জলিলের হাত ধরে 'সৌভাগ্যের খোঁজে' বনগাঁ সীমান্ত পেরিয়ে এপারে এসে জীবন-সংগ্রামটা কী বস্তু তা টের পেতে পেতে প্রথমেই যেটা বুঝেছে সেটা হলো, এপারে মোটামুটি নিরাপদে পেটের ভাত কোনরকমে যোগাড় করতে হলে জলিল-ইরফাত নাম বাদ দিতে হবে। এপারে তাদের সাক্ষাৎ আত্মীয় স্বজন বলতে তেমন কেউ নেই। খুঁজে পেতে স্বজাতিদের মহল্লায় গেলেও এখন নতুন মুখ হিসেবে চট্ করে নজরে পড়ার ভয়। অতএব দু'চারদিন জলিল থেকে জগা আর ইরফাত থেকে ইরা নাম নিয়ে খুবই সতর্কভাবে চলতে চলতে কাজের সন্ধানে একদিন লোকাল ট্রেন চেপে প্রথমে শিয়ালদায়। দু'চারদিন উঞ্ছবৃত্তি করে মাঝে মাঝে লোকালে চেপে দ'চার স্টেশন এদিক-ওদিক যেতে যেতে চোখে পড়ল রেললাইনের গা ঘেঁষে চাকবাঁধা বস্তি।
এখানেই শেষপর্যন্ত নিত্যদিন ঘোরাঘুরি। একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই যদি মেলে। আলাপ হলো শশধর মিস্ত্রীর সঙ্গে। তার নিজের একটা ডেরা আছে এখানে। শশধর একা থাকে। যে মেয়েটা সঙ্গে থাকতো, যাকে শশধর শেষপর্যন্ত বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছিল, সে ঠিকে কাজ করতে করতে একটা ছোঁড়ার সঙ্গে মুম্বাই পালালো সিনেমা করবে বলে। বেশ কয়েকমাস পরে এই মহল্লায় ফের ছোঁড়াটাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে অবাক হয়েছিল শশধর। একদিন তক্কে তক্কে থেকে পেছন থেকে জামার কলার চেপে ঝাঁকুনি দিয়ে জানতে চেয়েছিল তার ময়না'র খবর। ছেলেটা বিশেষ ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে বলেছিল, তোমার ময়না এখন 'ইস্টার!' বার-গার্ল। মানে বোঝো? ঝিনচাক্ নাচে। রোজ রোজ বুকের ভেতর গোছা গোছা নোট নিয়ে চালিতে ফেরে।
শশধর খুব স্পষ্ট করে কিছু না বুঝলেও এটা নিশ্চিত বুঝেছিল, ময়না আর এই নরকে ফিরবে না। একবার তার ইচ্ছে হয়েছিল মুম্বাই গিয়ে ময়নার সঙ্গে দেখা করে আসে। মেয়েটা তাকে অনেক দিয়েছে। মাঝে মাঝে রাত-বিরেতে শশধরের শরীর ময়নাতে আক্রান্ত হয়ে বড় জ্বালায়। তখন ইতি উতি মাঝেমধ্যে যেতেই হয় শশধরকে।
জগা-ইরাকে শশধর জায়গা দিল। ইরার শরীরটা ভদ্রলোকের বাড়িতে সাজিয়ে রাখার মতোই। তখন তার পেটে প্রথম বাচ্চা। মাথা গোঁজার একটা ঠাঁইয়ের খুব দরকার ছিল।
শশধর অবসর সময়ে পার্টি করে। বস্তিতে তার বেশ দাপট আছে। জগা রেলে হকারি করতে চাইলো। শশধর দু'শো টাকা ধার দিল পুঁজি হিসেবে। হকার্স-ইউনিয়নে নাম লিখিয়ে দিল। দু'চার দিন সঙ্গে থেকে লাইনে ফিটও করে দিল। কোনোদিন বাদাম ভাজা, কোনোদিন বা লেবু-লজেন্স--যেদিন যেটাতে দু'পয়সা বেশি আমদানির সম্ভাবনা থাকে জগা সেদিন তাই নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাচ্চাটা জন্মাতে খরচ কিছু বেড়ে গেল। জগার পরিশ্রমও বাড়লো। দু'চার মাস যেতে শশধরই বলল, ইরাকে বাবুদের বাড়িতে কাজে লাগিয়ে দাও, দু'চার পয়সা ঘরে আসবে। সঙ্গে ভালোমন্দ খাবার-দাবারও মাঝে মাঝে জুটে যাবে।
মনে মনে ভয় পেল জগা-ইরা দু'জনেই। বাবুদের বাড়ি মানে তো হিন্দু বাড়ি। ধরা পড়লে? জগা বলল, কিন্তু এতটুকু বাচ্চাকে কার কাছে রেখে যাবে? আমি তো থাকি না সারাদিন।
--কনকমাসী দেখবে তোমার বাচ্চা। একবেলার জন্যে পাঁচটাকা করে নেবে। বাচ্চার খাবারটা অবশ্য তোমাদেরই দিতে হবে।
কনকমাসীর গল্প আগেই শুনেছে ইরা। বেশ্যাপাড়ায় গতর খাটিয়ে খেত। শরীর আলগা হয়ে যেতে কোথা থেকে কি-ভাবে এখানে এসে ডেরা বেঁধেছিল । বস্তির বহু মেয়ে-বউ ঠিকে কাজে যায়। বউগুলো তাদের বাচ্চা-কাচ্চা কনকমাসীর জিম্মায় দিয়ে নিশ্চিন্তি। অতএব ইরাদের আপত্তি ধোপে টিকলো না।
নিজের মনের সঙ্গে ভয়ানক লড়াই করে ইরা একদিন জগার অনুপস্থিতিতে শশধরকে বলেই ফেলে--
--আমরা যে মোচলমান--হিন্দু নই! পেটেরে দায়ে বাংলাদেশ থেকে এখানে এসে নাম পাল্টেছি। বাবুদের বাড়িতে যদি ধরা পড়ে যাই?
তাজ্জব হয়ে গেল শশধর। এই অভিজ্ঞতা ওর প্রথম। মনে মনে ইরার সাহসের তারিফ করলো। কিছুক্ষণ ইরার রাঙা মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নতুন করে ইরাকে দেখতে লাগলো। ওর সিঁথিতে সিঁদুর। হাতে লাল পলা। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর শরীর কিছুটা ভারী হয়েছে বিশেষ করে বুক এবং কোমরের নিচের অংশ। বয়েস কত হবে? মেরেকেটে কুড়ি-একুশ। শশধর বলল--
--আমি যখন এতদিনেও ধরতে পারিনি কারো বাপের ক্ষমতা নেই তোদের ধরে। আমার জাতটাও তোরা মেরে দিলি! তোর হাতে ভাত খাচ্ছি রোজ!
--ভাতের মধ্যি কি মোচলমান-মোচলমান গন্ধ লাগে?
--সে তো গায়ে-গতরেও লেখা থাকে না রে--এসবই মনের বেত্তান্ত রে ইরা! যাক্, যা হবার তা তো হলোই। এখন আর--
বলতে বলতে কেমন যেন উদাস হয়ে যায় শশধর। মুখ শুকিয়ে গেল ইরার। বুকের ভেতর ঢাকের শব্দ। হঠাৎই মুখে আঁচল চাপা দিল কান্না চাপতে। চোখ দিয়ে হু-হু জল। শশব্যস্তে শশধর ইরার পাশে গিয়ে প্রথমে একহাতের বেড় দিয়ে কাছে টানলো। তারপর দু'হাতে জড়িয়ে ধরে ইরার মুখের দিকে তাকালো। দেখতে দেখতে ময়নাতে আক্রান্ত হলো শশধর। ইরাও শশধরের শরীরের উত্তাপ টের পাচ্ছিল। শশধরের হাত কাঁপছিল এবং একই সঙ্গে ইরার শরীরের বিশেষ জায়গাগুলিতে অভ্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছিল।
বাবুদের বাড়িতে অতএব কাজে লেগে গেল ইরা। জগা সাড়ে ছ'টায় বজবজ লোকাল ধরে। ইরা সাড়ে সাতটায় শশধরের সঙ্গে বেড়িয়ে পড়ে। এক স্টেশন পরেই আলিপুর। বড়লোকদের পাড়া। ঘরে ঘরে কাজের লোকের ভীষণ চাহিদা। কলমিস্ত্রী শশধরের জানা-চেনা ঘরেই জুটে গেল কাজ। প্রতিদিনই কিছু না কিছু বাড়তি খাবার-দাবার, যার অধিকাংশেরই নাম জানে না ইরা, প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগে মুড়ে নিয়ে আসে ঘরে। জগা খায়। শশধরও খায়। ওদের দু'জনকে দিয়ে যা থাকে তাতেই খুশি ইরা।
একদিকে জগা, অন্যদিকে শশধর--এই দু'জনকে নিয়েই ইরার সংসার। এখন আর শশধর ময়নাতে বেশি আক্রান্ত হয় না। ইরা খুব সতর্কভাবেই দু'জনকে সামলায়। এছাড়া যে তার আর কোনো উপায় নেই সেটা সে বুঝে গেছে। হিন্দুবাড়িতে ইরা কাজ করছে হিন্দু নাম নিয়ে এটা শশধর জানে। কিন্তু আর কেউ জানলে যে কী হতে পারে সেটা মোটেও ভাবতে চায় না ইরা। এ ভাবেই চলছিল তাদের বিচিত্র ঘর-সংসার।
একদিন হঠাৎ বিকেলে ঘরে এসে জগা ইরা আর শশধরকে যে অবস্থায় দেখলো সেটা সে আশা করেনি। কানাঘুষো দু'চার কথা আশপাশ থেকে তার কানে আসছিল, কিন্তু বিশ্বাস করতে মন চায়নি। জগার মাথায় আগুন চড়ে গেল। খুনোখুনি একটা হতেই পারতো। কিন্তু হলো না। শশধর জগাকে মনে করিয়ে দিল তার আসল পরিচয়। বেশি হৈ-চৈ না করে চেপে গেলেই জগার পক্ষে মঙ্গলের।
ছন্দ কেটে জলিল-ইরফাত-এর জীবনে। অবিশ্বাস আর সন্দেহ ক্রমশ:ই গাঢ় হতে থাকলো। এভাবে কিছুদিন চলার পর জলিল ওরফে জগা বস্তির একটা মেয়েকে নিয়ে গুজরাটে চলে গেল কাজের খোঁজে। কে নাকি তাকে কাজের সন্ধান দিয়েছে। জগার পথ চেয়ে ইরা বেশ কয়েকমাস অপেক্ষা করেছে। জগা ফেরেনি। শশধরের সঙ্গে এক ঝুপরিতে বসবাস করলেও এসব নিয়ে এখানে কেউ ভাবে না। সকলেই নিজের নেজের সমস্যা নিয়ে ঘোরতর ব্যস্ত।
(চলবে) াাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাাা,