প্রকৃতি প্রতিনিয়ত আমাদেরকে ডাকে। আমরা দেখি। মুগ্ধ হই। বারবার মুগ্ধ হই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষের মনে ঘুরে বেড়ানোর যেই বিষয়টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা থেকে কিন্তু বাঙালিরাও পিছিয়ে নেই। তার আগে যে মানুষ ঘোরাফেরা করতো না এমন নয়। ইবনে বতুতা, মার্কো পোলো আর হিউয়েন সাং-এর মতো বিশ্ব নন্দিত পর্যটক-পরিব্রাজকের জীবনাবসান কিন্তু তার অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে। উনাদের মতো মনীষীদের অনেকেই এসেছিলেন আমাদের এই অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাঙলায়। প্রশংসা করেছেন।
ছবি : পদ্মিক প্রতিফলন
আমাদের দেশের পরিচিত কয়েকটা জায়গা ছাড়া আমরা তেমন কোথাও ঘুরতে যাই না। অন্যদিকে ইদানীংকালে আমাদের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর প্রতি আগ্রহটা যেভাবে বাড়ছে, সেই হিসেবে নিরাপদে ঘুরে বেড়ানোর জন্য নতুন জায়গার সন্ধান আমরা কেমন পাচ্ছি?
যাইহোক, আমি বলতে চাচ্ছি আমাদের মৈনট ঘাটের কথা। যেখানে আপনি আসলে মুগ্ধ হবেন। তাকিয়ে থাকবেন পদ্মা নদীর অপরূপ জলরাশির দিকে। এই বিশাল জলরাশি, পদ্মায় হেলেদুলে ভেসে বেড়ানো জেলেদের নৌকা দেখা আর পদ্মার তীরে হেটে বেড়ানো, সব মিলিয়ে কিছুক্ষণের জন্য আপনার মনে হবে আপনি এখন ঢাকার দোহারে নয়, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আছেন। মূলত এই কারণেই অনেকে মৈনট ঘাটকে বলে থাকেন ছোট কক্সবাজার।
ছবি : ঢেউ ঢেউ
ঘুরে বেড়ানোর জন্য ঢাকা জেলার প্রতি মানুষের অনীহা লাঘব হবে, যদি মৈনট ঘাটকে কেন্দ্র করে এখানে একটি পরিপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠে। একসময় মৈনট ঘাট থেকে ফরিদপুর যাতায়াতের জন্য আমাদের কার্তিকপুর বাজার থেকে মৈনট ঘাট পর্যন্ত প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে ফেরির প্ল্যানটা বাস্তবায়ন না হবার কারণে এই রাস্তাটিও অবহেলায়-অযত্নে ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। অনেকদিন এভাবে থাকার কারণে অপ্রয়োজনে কেও ওইদিকটায় তেমন একটা পা বাড়াতো না। সাম্প্রতিককালে রাস্তাটি পুনরায় মেরামত করার ফলে আবার আসা শুরু করছে মানুষ। এদের বেশিরভাগই আসছে দোহার, নবাবগঞ্জ, শ্রীনগর, কেরানীগঞ্জ থেকে। মৈনট ঘাট এখনো ব্যাপকভাবে পরিচিত না হবার কারণে ভ্রমনপিপাসু অনেক মানুষই বঞ্চিত হচ্ছেন মৈনট ঘাটের সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে।
খুব ভোরে মৈনট ঘাটেই বসে সারারাত পদ্মা নদীতে জেলেদের শিকার করা মাছের বাজার। পদ্মা নদীর সেই নামকরা ইলিশ সহ অনেক প্রজাতির মাছই আপনি কিনতে পারবেন এখান থেকে, একদম টাটকা! মৈনট ঘাট পরিদর্শনের উপযুক্ত সময় হচ্ছে বর্ষাকাল। তখন রাস্তার দুই পাশের নিম্নভূমি, যেখানে অবর্ষায় বিস্তীর্ণ ভূমি জুড়ে বাদামের চাষ করা হয়, সবই পদ্মার পানিতে তলিয়ে যায়। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। অবর্ষায়ও এর সৌন্দর্যের কমতি নেই। তখন দেখা যাবে পদ্মা নদীর শান্ত রূপ। একটা সন্ধ্যায় পদ্মা নদীতে সূর্যাস্ত দেখলে পরবর্তী একশোটা সন্ধ্যা এর কথা মনে থাকবে। আমাদের প্রধান প্রধান উৎসবের দিনগুলোতে মানুষ এখানে আসছে, ঘুরছে। স্পীডবোট, ট্রলার অথবা খেয়ানৌকা নিয়ে পদ্মার বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে অনেকেই।
নবাবগঞ্জ রুটে মৈনট ঘাটে আসলে ইচ্ছা করলে পাশাপাশি দেখে যেতে পারবেন নবাবগঞ্জের জজবাড়ি, উকিলবাড়ি, আনসার ক্যাম্প, খেলারাম দাতার বাড়ি সহ আরও কিছু দর্শনীয় স্থান। আর মৈনট ঘাটে আরও দেখতে পাবেন পদ্মা নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা পদ্মাবিধৌত অতি সাধারণ এক জনগোষ্ঠীর জীবন যাপন, যারা শত প্রতিকূলতার মাঝেও পদ্মাকে আগলে ধরে আছে বছরের পর বছর। ঢাকাবাসীরা চাইলে খুব সহজেই দোহারের এই ছোট কক্সবাজার মৈনট ঘাটে একটা ডে ট্রিপ দিতে পারেন।
ছবি : বর্ষায় পদ্মাপারের নিচুভূমি
কিভাবে আসবেন?
ঢাকা থেকে মৈনট ঘাটে আসার সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায়টি হচ্ছে গুলিস্তানের গোলাপ শাহের মাজারের সামনে থেকে সরাসরি মৈনট ঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা যমুনা পরিবহনে চেপে বসা। ৯০ টাকা ভাড়া আর দের থেকে আড়াই ঘন্টার বিনিময়ে আপনি পৌঁছে যাবেন মৈনট ঘাট। ফেরার সময় একই বাসে আবার ঢাকা চলে আসবেন। মৈনট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে শেষ বাসটি ছেড়ে যায় সন্ধ্যা ৬ টায়।
গুলিস্তানের একই স্থান থেকে এন মল্লিক পরিবহনেও আসতে পারবেন। এক্ষেত্রে আপনাকে নামতে হবে নবাবগঞ্জের মাঝিরকান্দা নামক স্থানে। ভাড়া ৭০ টাকা। মাঝিরকান্দা থেকে লোকাল অটোতে দোহারের বাশতলা। ভাড়া ১৫ টাকা। চাইলে লক্ষীপ্রসাধ নামক স্থানে নেমে পোদ্দারবাড়ি নামক পুরনো বাড়িটিও দেখে নিতে পারেন। আর জজবাড়ি, উকিলবাড়ি, কোকিলপ্যারি দালান, খেলারাম দাতার বাড়ি যাকে স্থানীয়ভাবে আন্ধার কোঠা বলা হয়, এইসব দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখতে চাইলে মাঝিরকান্দার আগে কলাকোপা নামক স্থানেই নামতে হবে। যাইহোক, মাঝিরকান্দা থেকে বাশতলা আসার পর কার্তিকপুরগামী আরেক লোকাল অটোতে উঠতে হবে। ভাড়া ১৫ টাকা। কার্তিকপুর বাজার থেকে আরেক অটোতে মৈনট ঘাট। ভাড়া ১০ টাকা। রিক্সায় গেলে ২০ টাকা।
গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া থেকে নগর পরিবহনেও আসতে পারবেন। ভাড়া ৯০ টাকা। নগর পরিবহন নবাবগঞ্জের রুট ব্যবহার করে না। এই বাসটি আসে মুন্সিগঞ্জ হয়ে। এক্ষেত্রে আপনাকে কার্তিকপুর বাজারে নামতে হবে। ঢাকার বাবুবাজার ব্রীজ পার হয়ে কদমতলী থেকে সিনজিতেও আসতে পারবেন। লোকাল সিএনজি কদমতলী থেকে জনপ্রতি ১৮০ টাকা থেকে ২০০ টাকা ভাড়া নিয়ে কার্তিকপুর বাজার পর্যন্ত আসে। এছাড়াও যমুনা পরিবহন অথবা এন মল্লিক পরিবহন গুলিস্তানের যেই স্থান থেকে ছাড়ে, একই স্থান থেকে জয়পাড়া পরিবহন নামক মিনিবাসটিও ছেড়ে আসে দোহারের জয়পাড়ার উদ্দেশ্যে।
যারা প্রাইভেট কার অথবা বাইক নিয়ে আসতে চাচ্ছেন তারা এই বাসের রুটটাকে ব্যবহার করতে পারেন। আসতে সুবিধা হবে। এটি বাবুবাজার ব্রীজ পার হয়ে কদমতলী থেকে নবাবগঞ্জের রুট ধরে টিকরপুর-গালিমপুর হয়ে দোহারের প্রাণকেন্দ্র জয়পাড়া পর্যন্ত আসে। আগে এই বাসটি সরাসরি মৈনট ঘাট পর্যন্ত আসতো। কয়েক বছর ধরে জয়পাড়ার পরে আর আসছে না। লক্কর-ঝক্কর এই মিনিবাসে গুলিস্তান থেকে জয়পাড়া পর্যন্ত আসতে হলে ভাড়া দিতে হবে ৬০ থেকে আশি টাকা। দামাদামি করার সুব্যবস্থা আছে। জয়পাড়া থেকে কার্তিকপুর লোকাল অটো ভাড়া ২০ টাকা। ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকেও আসার একটা পদ্ধতি আছে। মোহাম্মদপুর বেরিবাধের সিএনজি স্টেশন থেকে আটিবাজার, আটিবাজার থেকে সিএনজি অথবা একপ্রকার ছাদহীন টেম্পুতে কোনাখোলা। কোনাখোলা থেকে দোহার-নবাবগঞ্জগামী যেকোনো একটা বাসে উঠে পড়তে হবে। যারা গাবতলি অথবা সাভারের আশেপাশে থাকেন, তারা হেমায়েতপুর থেকে লোকাল সিএনজিতে সরাসরি নবাবগঞ্জ আসতে পারবেন। ভাড়া ১২০ টাকা। অথবা সরাসরি সিএনজি না পেলে হেমায়েতপুর থেকে হযরতপুর, হযরতপুর থেকে পারাগ্রাম, নৌকায় নদী পার হয়ে আরেক সিএনজিতে নবাবগঞ্জ সদর।
এই হচ্ছে যাতায়াতের বর্ণনা।
কোথায় থাকবেন?
ট্যুরিস্টদের থাকার জন্য মৈনট ঘাটের আশেপাশে কোনো হোটেল, রিসোর্ট, বোর্ডিং এখনো তৈরি করা হয়নি। স্থানীয় কোনো বাসিন্দার বাড়ি ম্যানেজ করতে না পারলে দিনে এসে দিনেই ফিরে যাওয়া ভালো।
ছবি : ইনি প্রস্তুত
কোথায় খাবেন?
বেশিরভাগ মানুষেরই ইচ্ছা থাকে পদ্মার তীরে বসে পদ্মার সেই নামকরা ইলিশ খাওয়ার। মৈনট ঘাটে দু'টি ভাতের হোটেল আছে। একটি আতাহার চৌধুরীর হোটেল অপরটি জুলহাস ভূঁইয়ার হোটেল। এই লিখাটি লেখার আগে কিছু তথ্য নেবার জন্য যখন আতাহার চৌধুরীর হোটেলে গিয়েছি, আতাহার চৌধুরী খুব আন্তরিক ভাবেই জানালো তার দোকানের ইলিশ ৬০ থেকে ৯০ টাকা। বড় সাইজের ইলিশ খেতে চাইলে আগেই অর্ডার দিতে হবে। বোঝেনই তো, গরীব মানুষ। চালানপাতির ব্যাপার স্যাপার। এছাড়াও বোয়াল ৮০ থেকে ১০০ টাকা, চিংড়ি ৬০ থেকে আশি টাকা। ভাত ১০ টাকা প্লেট। আর কার্তিকপুর বাজারে শিকদার ফাস্টফুড নামক একটা খাবারের দোকান আছে, ঢাকা হোটেল সহ আরও কিছু ভাতের হোটেলও আছে। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, কার্তিকপুরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি খেতে ভুলবেন না। এখানকার মিষ্টি অনেকে বিদেশেও পাঠায়।
নিরাঞ্জন মিষ্টান্ন ভান্ডার, মুসলিম সুইটস, রনজিৎ মিষ্টান্ন ভান্ডার সহ আরও কিছু মিষ্টির দোকান আছে এখানে। কিছু তথ্য নেবার জন্য আমি যখন রনজিৎ মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী রনজিৎ দাদার কাছে গেলাম, আমাকে কি না কি ভেবে তিনি খুব ভড়কে গেলেন। তিনি বললেন, আমি তো ভাই নিয়মিত ট্যাক্স দেই। তার কথা শুনে আমার খুব হাসি পাচ্ছিলো। পরে সবকিছু বুঝিয়ে বলার পর রনজিৎ দাদা স্বাভাবিক হয়ে বললেন ছানার রসগোল্লা ১৮০ টাকা থেকে ২০০ টাকা কেজি। সাধারণ রসগোল্লা ১৫০ টাকা কেজি। চমচম ও কালোজাম ১৬০ টাকা কেজি। বালুশা ১৪০ টাকা কেজি। জিলাপি ১০০ টাকা কেজি। রসমালাই ৩০০ টাকা কেজি। দধি ১৪০ টাকা কেজি। আসার সময় সহজসরল রনজিৎ দাদা অনেকটা জোর করেই তার দোকানের মিষ্টি খাইয়ে ছাড়লেন।
ছবি : সূর্যাস্তের আগে
এছাড়াও কিছু তথ্য
স্পীডবোটে মৈনট ঘাট থেকে ফরিদপুরের চর ভদ্রাসন যেতে হলে ১৬০ টাকা করে গুনতে হবে জনপ্রতি। ১০ থেকে ১২ জন নিয়ে চলতে পারবে। স্পীডবোটে মৈনট ঘাট থেকে চর ভদ্রাসন যেতে সাধারণত সময় লাগে ১৬ থেকে ১৭ মিনিট। পদ্মায় ঢেউ থাকলে ২০ মিনিট। মৈনট ঘাটের একজন স্পীডবোট চালক মোহাম্মদ আকাশের ভাষ্যমতে ২০ মিনিটের জন্য স্পীডবোট রিজার্ভ করে পদ্মায় ভেসে বেড়াতে চাইলে গুনতে হবে ২০০০ টাকা। কয়েকজন মিলে শেয়ারে ভাড়া করলে ভালো হবে। আর দশ মিনিটের জন্য একহাজার টাকা। ট্রলার রিজার্ভ করে পদ্মায় ঘুরতে চাইলে ১ ঘন্টার জন্য ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা গুনতে হবে। অবশ্যই দামাদামি করে নেবেন। ট্রলারের তথ্য পেয়েছি ট্রলার চালক রুবেলের নিকট থেকে। এছাড়াও ইঞ্জিনযুক্ত ছোট নৌকা নিয়ে ঘুরতে চাইলে ১ ঘন্টায় ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা গুনতে হবে। নৌকা চালক শহিদুল ইসলামের দেওয়া তথ্য এইটা।
ছবি : বর্ষায় পদ্মাপারের নিচুভূমি
সতর্কতা
সাঁতার না জানলে গোসল করার সময় পদ্মার বেশি গভীরে যাবেন না। সিগারেট অথবা খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল অথবা যেকোনো প্রকার ময়লা যেখানে সেখানে ফেলবেন না। পাখি মারা থেকে বিরত থাকুন। যার তার সামনে সিগারেট ফোঁকা থেকে বিরত থাকুন। দোকানদার, নৌকাচালক সহ সবার সাথে মার্জিত ব্যবহার করুন। ভুলেও এদেরকে ছোট করে দেখবেন না। এদের অনেকের বাড়িঘরের অবস্থা আমার চাইতেও ভালো। খেয়াল রাখুন নিজের কোনো আচরণের দ্বারা কোনো মেয়ে বিরক্ত হলো কিনা। কেও মেয়েদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করলে অথবা যেকোনো প্রকার সাহায্যের জন্য মৈনট ঘাটের একটু পাশেই অবস্থিত পুলিশ ফাঁড়িতে যোগাযোগ করুন।
ছবি : উনারা প্রস্তুত, আপনি কবে আসছেন?
তাহলে আর দেরী কেন? কান পেতে শুনুন। অপার সৌন্দর্য বুকে ধারণ করে পরম মমতায় পদ্মা নদী আপনাকে ডাকছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি মৈনট ঘাট আপনার জন্যই অপেক্ষা করছে।