আমার প্রথম লুঙ্গি পড়ার অনুভূতিটা চমৎকার। গ্রামে থাকার কারনে লুঙ্গির সাথে বেশ ভালোভাবে পরিচিত আমি। গ্রামের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে, ধানের দিনে ধান কাটতে আসা কামলা, সবার পরনে লুঙ্গি। লুঙ্গির যদি আলাদা কোনো গন্ধ থাকতো, তবে চারিদিক লুঙ্গির মুহুর্মুহু গন্ধে ভরে যেত। তো একদিন এক সমবয়সী ছেলেকে দেখলাম, নতুন লুঙ্গি পড়ে, আমাদের সামনে এসে পার্ট নিচ্ছে। যেন মুরুব্বী হয়ে গেছে। আমি সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “ওয়েট, আমিও লুঙ্গি পড়ে আসতেছি।” এক দৌড়ে বাড়িতে চলে আসলাম। সারাবাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ছোট কোনো লুঙ্গি পাওয়া গেলনা। অবশেষে বাবার একটা সাদা রঙের বড় লুঙ্গিই পড়ে নিলাম। সামনের দিকে লুঙ্গির গিটটা ভালোমতো না দিতে পারায়, বিশাল উচু হয়ে গেল পেট। তারপর চলে গেলাম বন্ধুদের মাঝে। ওরা সবাই তো আমাকে দেখে পুরাই থ! লুঙ্গি পড়তে পারায় আমার কাছে মনে হচ্ছে, পাঁচ-ছয়টা গ্রহ-উপগ্রহ জয় করে ফেলেছি। এখন সূর্য জয় করার চেষ্টায় আছি। ঠোটের কোনায় জমে থাকা টিটকারির হাসি ছুড়ে মারছি পার্ট নেয়া লুঙ্গি পরিহিত ছোকরার দিকে। তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি, আমিও পারি! ব্যাটা নচ্ছাড়, তা দেখে আমাকে বলে কিনা, “আয়! তাইলে লুঙ্গি পইড়া পেয়ারা গাছে উইঠা দেখি, কে তারাতারি উঠতে পারে!” আমি তো ভালোমতো লুঙ্গিই পড়তে পারিনা, আর লুঙ্গি নিয়ে পেয়ারা গাছে কিভাবে উঠবো! তারপরেও ভাবের দিকে তাকিয়ে রাজী হলাম। পাশাপাশি দুইটা পেয়ারা গাছ ছিলো। একটাতে আমি, আরেকটাতে ও ওঠা শুরু করলো। আমি মাত্র একটা ডালা অতিক্রম করেছি, ঐদিকে ও গাছের প্রায় মাথায় উঠে গেছে। নিজেকে যুদ্ধের পরাজিত সৈনিক মনে হচ্ছে। দলাপাকানো কান্নারা, গলায় এসে আটকে গেছে। আমাকে দেখে যেন, পেয়ারা গাছে নতুন গজিয়ে ওঠা পাতারাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। একটা পাখি, ওপর থেকে পিচিক করে সাদা রঙ, অথবা অন্য কিছু ছুড়ে মারলো আমাকে লক্ষ্য করে। একদলা সাদা রঙ, আমার নাকের ডগা ঘেসে পড়ে গেল নিচে। নাকের ডগায় লেগে থাকা কিছু একটা মুছতে না মুছতেই সেই লুঙ্গি পড়া বীরের চিৎকার! “ওরে মা রে!! ওরে বাপ রে!!!” একটু দূরে তাকিয়ে দেখি, পেয়ারা গাছের মালিক ওহাব মিয়া, ধান কাটার কাস্তে হাতে দৌড়ে আসছেন! তাই দেখে তড়িঘড়ি করে নামতে গিয়ে, আমার লুঙ্গি গেল একটা ডালার সাথে আটকে। কি বিপদ! ওদিকে ওহাব মিয়া প্রায় এসে পড়েছেন। আমি আর কালবিলম্ব না করে, লুঙ্গি খুলে গাছ থেকে এক লাফে নেমেই দৌড়! ওদিকে লুঙ্গি পড়া পার্টসাহেব, গাছের অনেকটা ওপরে থাকায় নামতে না পেরে চিৎকার করেই যাচ্ছেন “ওরে মা রে!! ওরে বাপ রে!!!” ঘন্টাখানেক পর যখন লুঙ্গি নিতে আসলাম, তখন দেখা গেল, কাঙ্ক্ষিত স্থানে আমার লুঙ্গি নেই। তাই দেখে মায়ের হাতের ধুরুম-ধারুম কিলের সম্ভাবনায় আমার আক্কেল গুরুম! এদিক-সেদিক অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও আর আমার লুঙ্গির কোনো সন্ধান পাওয়া গেলনা। একটা গাছের অনেক ওপরে তাকালে দেখা গেল, একটা লুঙ্গি পতাকার মতো পতপত করে বাতাসে উড়ছে। সম্ভবত সেই ছেলেও লুঙ্গি খুলেই নেমে এসেছিলো। তারপর সেই ছেলের কি অবস্থা হয়েছিলো, তা আর না-ই বা বললাম।
অনেকদিন পর, ওহাব মিয়ার ঝিঙে ফুলেদের মাচাঙের আনাচে-কানাচে দেখা গেল, আমার লুঙ্গির ছেড়া ছেড়া টুকরোগুলোকে ঝুলে থাকতে। অর্থাৎ, আমার লুঙ্গিকে ওহাব মিয়া রশি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
(প্রথম লুঙ্গি পড়ার অনুভূতিটা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। আজকে হঠাত করে মনে পরে যাওয়ায়, চট করে ডায়েরীতে লিখে ফেললাম)