(১)
প্রিয় দর্শক, সবাইকে আমন্ত্রন জানাচ্ছি মহাপ্রভু ঈশ্বরের বিশেষ কর্মসূচী নিয়ে আমাদের লাইভ অনুষ্ঠান "সবই উপর ওয়ালার ইচ্ছা" দেখার জন্য। প্রথমেই জানিয়ে রাখি গতকাল গভীর রাতে এক বিশেষ বার্তায় ঈশ্বর আমাদের জানিয়েছেন তিনি আজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উজ্জ্বলপুর গ্রামে তাঁর বিশেষ নিদর্শন নিয়ে হাজির হবেন। দীর্ঘদিন ধরে জনসাধারণের দাবির মুখে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ নিয়ে তিনি আবির্ভূত হচ্ছেন। আমরা এসেছি ঈশ্বরের এ বিশেষ কর্মসূচি সরাসরি সম্প্রচার করতে। বাংলাদেশের প্রায় সকল সরকারি বেসরকারি টেলিভিশনে এ বিশেষ ঘটনার সম্প্রচার হচ্ছে। দর্শক, আজ আপনারা যে ঈশ্বরের প্রমাণ দেখবেন তিনি হচ্ছেন পৃথিবীর সব ফর্সা মানুষদের ঈশ্বর। অবশ্য শ্বেত রোগীরা উনার আওতার বাইরে। তাদের জন্য আলাদা ঈশ্বর আছেন।
আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মহাপ্রভু ঈশ্বর আমাদের মাঝে দেখা দিবেন। তিনি একটি উজ্জ্বল বর্ণের শীতল পোশাক পরে আসবেন। হাতে থাকবে সিংহের কেশরি দিয়ে পাকানো লাঠি। যা ঈশ্বরকে সঙ্গ দেবে। তাঁর আগমন উপলক্ষে আজ গ্রামে কোন লোডশেডিং নেই। সারাদিন দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস বইবে এবং সূর্য থেকে আরামদায়ক রোদ ঝরে পড়বে। গ্রামের মানুষদের মধ্য থেকে নির্বাচিত দশ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ঈশ্বরের আগমনের পূর্ববার্তা পেয়েছেন। বাকিরা এ সম্পর্কে আগে থেকে কিছু জানেন না। যারা এখন টেলিভিশন দেখছেন, তারা জানতে পেরেছেন এবং তাদের কাছ থেকে ধীরে ধীরে সবাই জেনে যাবেন।
আজকের এ বিশেষ কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে দু’জন নি:সন্তান রমণীকে সন্তান দান, একজন অত্যাচারী জনপ্রতিনিধির ভয়ংকর পরিণতি, দু’জন দরিদ্র বিধবার দারিদ্রতা দূরীকরণ ও ক্ষরাক্রান্ত ফসলের খেতের জন্য বৃষ্টির ব্যবস্থা করা। শেষে স্থানীয় জনগণের মনোনীত তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলের সাথে একান্ত বৈঠকে মিলিত হবেন। বৈঠকে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের সংকট নিয়ে আলোচনা এবং এ বিষয়ক জটিলতার সুরাহা হবে। প্রিয় দর্শক, আমরা এখন স্থানীয় ধোপখোলা মাঠের ঠিক মাঝখানে অবস্থান নিয়েছি। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন সাদা মেঘের কুন্ডলি পাকিয়ে কিছু একটা আকাশ থেকে নামছে। অনেকেই হয়তো বুঝতে পেরেছেন, ইনিই মহাপ্রভু ঈশ্বর। মাঠের চারপাশে এতক্ষণে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। সবাই আগ্রহচিত্তে ঈশ্বরের অবতরণ উপভোগ করছেন। মাঠের পূর্ব এবং উত্তর পাশ থেকে স্বাগত সংগীত গেয়ে ঈশ্বরকে বরণ করে নিচ্ছেন একদল তরুণ তরুণী।
দর্শক, কাংখিত সে মুহূর্ত আমাদের সন্নিকটে। ঈশ্বর এখন আমাদের নাগালের মধ্যে। এইমাত্র তিনি মাটিতে পা রাখলেন। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন দীর্ঘকায় সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ঈশ্বরকে। দেখছেন তাঁর চুলগুলো উড়ন্ত মেঘের মতো। চওড়া কপালের পুরোটা মসৃণ মাটির হাঁড়ির তলার মতো। গলা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ঢিলেঢালা চওড়া পোশাকে আবৃত। হাত কিংবা পায়ের পাতা দেখা যাচ্ছে না। সিংহকেশরী পাকানো লাঠির অর্ধেকের মতো দেখা যাচ্ছে। আপনারা হয়তো জানেন আজকের এ কর্মসূচীকে শ্যামলা ও কালো বর্ণের মানুষরা বয়কট করেছেন। তারা এ ধরনের কার্যকলাপকে হাস্যকর বলে তাচ্ছিল্য করেছেন এবং তীব্র সমালোচনা করে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। যাই হোক, আমরা এখন ইশ্বরের সাথে চলে যাবো গ্রামের সবচেয়ে পুরোনো বট গাছের নিচে। যেখানে দু’জন নি:সন্তান ফর্সা রমণী সন্তানের আশায় প্রার্থনারত অবস্থায় আছেন। তারা প্রতিদিন সকালে এখানে এসে সন্তান লাভের জন্য প্রার্থনা করে থাকেন।
আমাদের সামনে প্রার্থনারত দু’জন রমনীরই একই চাওয়া। ল্যাংড়া, খোঁড়া, বোবা, কানা যে রকমই হোক না কেন, একটা সন্তান হলেই চলবে। উনারা এসব বলতে বলতে কান্না করে চলেছেন। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন তাদের চোখ বেয়ে জল পড়ছে এবং প্রার্থনার বুলিতে ঠোঁট দু’টো কাঁপছে। চারপাশে শত শত লোকের ভিঁড়। উপস্থিত দর্শকদের মধ্য থেকে অনেকেই ঈশ্বরের প্রতি আহবান জানাচ্ছেন দু’টি 'যে কোন রকমের শিশু'র জন্য। এ দু’রমনীর স্বামী ফর্সা নয় বলে তারা এখানে উপস্থিত নেই। দর্শক, ঈশ্বর ধীরে ধীরে সামনে এগুচ্ছেন। এখনই হয়তো তাঁর নির্দেশে দু’টি 'যে কোন রকমের শিশু'র জন্ম হবে। আপনারা নিশ্চয় শিশু দু’টির আগমন প্রক্রিয়ার ধরন দেখতে উন্মুখ হয়ে আছেন। আমরাও আপনাদের মতো চরম উৎকন্ঠায় আছি। ঈশ্বর যদি তার ক্ষমতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হন, তাহলে উপস্থিত জনগণ ঈশ্বরের প্রতি যে কোন ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারেন। অনেকের মাঝে সেরকম প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে। বটগাছের ঠিক গোড়ার দিকে বাম পাশে একদল যুবক দেশীয় অস্ত্রে সজ্জ্বিত হয়ে আছেন। প্রথম ধাপেই যদি ইশ্বর ব্যর্থ হয়ে যান, তাহলে হয়তো অপ্রীতিকর কোন ঘটনার জন্ম হতে পারে। নিশ্চয় ঈশ্বর এসব বিষয়ে অবগত আছেন।
আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রার্থনারত রমনীদের ঠিক সামনে ঈশ্বর তাঁর অবস্থান নিয়েছেন। তিনি চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। প্রার্থনার শব্দ এখনো শোনা যাচ্ছে। দর্শক, আপনারা টেলিভিশনের সামনে থেকে কোথাও যাবেন না, চোখের পলকও ফেলবেন না। সামান্য গাফিলতির কারণে এ অন্তিম মুহূর্ত দেখা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। আমাদের ক্যামেরা ঈশ্বরের প্রতি স্থির আছে। কোন একটি ক্ষুদ্র ঘটনাও বাদ যাবে না। সবকিছুই সম্প্রচার করার যাবতীয় ব্যবস্থা নেয়া আছে। নিরবিচ্ছন্ন মনযোগ দিয়ে নিজেকে সক্রিয় রেখে আমাদেরকে সাহায্য করুন।
প্রিয় দর্শক, দেখতে পাচ্ছেন ঈশ্বর তাঁর হাতের লাঠিটি কিঞ্চিত উর্দ্ধে তুলে ধরলেন। তিনি বিশেষ কোন নির্দেশ প্রদান করছেন। দেখুন বটগাছের পাতাগুলো চঞ্চল হয়ে উঠলো, আমরা সবাই আচমকা আলোকিত হয়ে গেলাম এবং তুমুল করতালি...! দর্শক, খেলা জমে উঠেছে। নিশ্চয় দেখতে পেলেন কাংখিত সে দৃশ্য। প্রথমে দু’টো শীতল পাটি এবং সাথে সাথে পাটির উপর যাদুর মতো দু’জন নবজাতকের অস্তিত্ব দেখতে পেলাম সবাই। আমরা যেন যাদু দেখছি। ঈশ্বর যেন দুর্দান্ত এক যাদুকর। অবিশ্বাস্য এ দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার মতো নয়। বিরল, দুর্লভ, অসম্ভব যাই বলি না কেন, ঈশ্বর প্রমান করলেন তাঁর সক্ষমতা, তাঁর অস্তিত্ব এবং তাঁর কার্যকারিতা। দীর্ঘ বর্ণনা না দিয়ে আমরা বরং দেখি নবজাতককে কোলে নিয়ে দু’মায়ের ঘরে ফিরে যাওয়ার দৃশ্য। পরম মমতায় সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে চলেছেন তারা। সুদীর্ঘ সময়ের প্রার্থনার অবসান ঘটিয়ে মহাপ্রভু ঈশ্বরের দয়ায় তারা মা হতে পারলেন। কয়েকজন মানুষ ঈশ্বর জিন্দাবাদ বলে স্লোগান দিচ্ছেন। আপনারা সে চাঞ্চল্য শুনতে পাচ্ছেন। অবশ্য বেশিরভাগই এখনো কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে ঈশ্বরের পিছু পিছু এগিয়ে চলছেন। অনেকেই ঘোরে আক্রান্ত হয়ে কী করি কী করি অবস্থায় আছেন। এসব কিছুতে ঈশ্বরের আগ্রহ নেই। তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন কর্মসূচীর পরবর্তী ধাপে।
এখন আপনাদেরকে নিয়ে যাবো গ্রামের অত্যাচারি মাতবরের কাছে। যিনি এ মুহূর্তে একটি সালিশ পরিচালনা করছেন। এ মাতবর এলাকায় অনেক কুকর্মের সাথে জড়িত। তার স্বার্থে কেউ ব্যাঘাত ঘটালে অকথ্য নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়। সুদের টাকার জালে আবদ্ধ করে অনেক অসহায় মহিলাকে তার সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করেছে এ ঘৃণিত মাতবর। বছরের পর বছর এ অত্যাচারি মাতবরের ধ্বংস চেয়ে ঈশ্বরের কাছে হাত তুলেছে হাজার হাজার গ্রামবাসী। আজ ঈশ্বর নিজে উপস্থিত থেকে মাতবরের দৃষ্টান্তমূলক ভয়ংকর বিণাশের ব্যবস্থা করবেন। এর মাঝে বলে রাখি এ গ্রামের মাটি বেশ উর্বর। ধান, পাট, সরিষাসহ প্রায় সব ধরনের প্রচলিত শাক সবজির চাষ করেন গ্রামের কৃষকরা। এছাড়াও নারিকেল, সুপারিসহ বিভিন্ন ফলের ব্যাপক ফলন হয় এখানে। আমরা যে রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছি তার ডানপাশে দেখছেন কুমড়ার ঝাড়। বাম পাশে পুকুরে মাছের প্রজেক্ট।
দর্শক, এ অবস্থায় এসে আমাদেরকে থামতে হচ্ছে। ঈশ্বর তাঁর গতিপথ পাল্টে কুমড়ার ঝাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমরা উনার সাথে আন্ত:সংযোগ ঘটাতে সক্ষম হয়েছি। তিনি জানিয়েছেন এক চোর এসেছেন মাত্র একটি কুমড়া চুরি করতে। ধরা খাওয়ার ভয়ে শুকনো গলায় ঈশ্বরকে ডেকে যাচ্ছেন। অপরদিকে কুমড়ার মালিকও বাড়িতে থেকে তার ফসল রক্ষার জন্য ঈশ্বরের সাহায্য কামনা করে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দু’জনের ডাকেই সাড়া দিবেন। চোরের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে একটি কুমড়াকে কপি করে পেস্ট করলেন। কপিকৃত কুমড়াটি চোরের হাতে তুলে দিলেন। তবে এখানে অন্য একটি ঘটনাও ঘটেছে। ক্যামেরার জুমে দেখতে পাচ্ছেন দু’টো ছোট কুমড়ার প্রাণ কেড়ে নিলেন ঈশ্বর। তিনি কেন এক জোড়া উদীয়মান কুমড়ার প্রাণ হরণে আগ্রহী হলেন, তা আমরা ভালো বলতে পারবো না। হয়তো সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষার জন্য এ কাজ করেছেন। আমাদের চোখের সামনে কুমড়ার বাচ্চা দু’টো নিস্তেজ হয়ে চুপসে গেলো।
(২)
নয়নাভিরাম অপরূপা গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা চলে এলাম সে অত্যাচারি মাতবরের সালিশকেন্দ্রের সামনে। এ যেন রাষ্ট্রের ভেতর আরেকটি রাষ্ট্র, প্রশাসনের ভেতর আরেকটি প্রশাসন। রাষ্ট্রের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে তুচ্ছজ্ঞান করে নূন্যতম বিচারিক বুদ্ধি না নিয়ে প্রায় একযুগ যাবৎ নিজের মতো করে গ্রামের মানুষদের বিচার করে যাচ্ছেন এ মোড়ল। আজকের সালিশে এক পক্ষ থেকে খেয়েছেন আট হাজার টাকা, আরেক পক্ষ থেকে খেয়েছেন বিশ হাজার টাকা। যার কাছ থেকে বেশি টাকা খেয়েছেন, তার পক্ষে রায় দেয়ার সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন নীতি আদর্শহীন এ মাতবর। কিন্তু সেটা ঘটার আগেই বড় ঘটনা ঘটে যাবে। পৃথিবীর মাটিতে ধুলিস্মাৎ হয়ে যাবে এ অন্যায় মানুষের দেহ।
দর্শক আপনারা প্রস্তুততো? ঈশ্বর খুব বেশি সময় নিচ্ছেন না। তিনি সালিশের দর্শকদের কাতারে দাঁড়িয়ে মাতবর নিধনের নির্দেশ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ ফাঁকে জানিয়ে রাখি, যাদেরকে ব্যবহার করে এসব নিদর্শন সৃষ্টি করা হচ্ছে, তারা আজকের কর্মসূচী সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ঈশ্বরের বিশেষ নির্দেশে তাদের কাছে সব অজ্ঞাত রাখা হয়েছে। প্রিয় দর্শক, মাতবরের ভয়াবহ পরিণতির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ঠিক এ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে তার কন্ঠস্বর সরু হয়ে যাচ্ছে। তিনি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। ক্যামেরায় দেখতে পাচ্ছেন কিভাবে শরীর থেকে চামড়া খুলে পড়ছে। ইতোমধ্যে পুরো শরীরের চামড়া খুলে গেছে। সুনির্দিষ্টভাবে সূর্য তার প্রতি অস্বাভাবিক তাপমাত্রা সরবরাহ করছে। মাংস দগ্ধ হচ্ছে এবং খসে খসে পড়ছে। উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে অনেকে ভয় পেয়ে চলে যাচ্ছেন। মাতবরের আত্মা এখনো ধ্বংস হয়নি। তার আত্মার চিৎকারে পুরো এলাকা ভারী হয়ে উঠছে। দর্শকদের মধ্যে যারা ভায়োলেন্স পছন্দ করেন না, দয়া করে টিভি সেটের সামনে থেকে সরে যান। পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে। মাথা থেকে শুরু করে বুক পর্যন্ত সমস্ত মাংস খসে পড়েছে। মাথার খুলি এবং গলা, বুকের হাঁড়গোড় অর্থাৎ কংকালটা টিকে আছে। এতক্ষণে কংকালটা বড় হতে হতে কোমর পরিমান চলে এসেছে। অনেক চেষ্টা করেও মৃত্যু যন্ত্রনায় লাফালাফি কিংবা গড়াগড়ি করতে পারছেন না। তাকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। ফলে মৃত্যু যন্ত্রনা আরো বেড়েছে। যার কারণে মাতবরের চিৎকারের শব্দও কয়েকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। উপস্থিত মানুষের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তারা কিছু দূরে গিয়ে উল্টোদিকে ফিরে কানে আংগুল দিয়ে দাঁড়িয়ে, বসে কিংবা শুয়ে আছেন। দর্শক, আপনাদের সাথের কেউ যদি টিভি সেট থেকে সরে থাকেন, তাহলে তাকে ডাকতে পারেন। মাতবরের শাস্তি শেষ হয়ে গেছে। তার পরিবার এসেছে কংকাল নিয়ে যেতে। একটু আগে যা ঘটেছে, তাকে এক কথায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের শাস্তি বলা যায়। এর বেশি বর্ণনা দেয়ার মতো মানসিক অবস্থা এ মুহূর্তে আমার নেই।
মাতবরের পরিণতি দেখে আমাদের যার যে অবস্থা হোক না কেন, ঈশ্বরকে আগের চাইতে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী দেখা যাচ্ছে। পরপর দু’টো প্রমান সফলতার সাথে দেখিয়ে দিলেন। উপস্থিত জনগণের মাঝে কারো কৌতুহল মিটে গেছে, কারোবা আবার কৌতুহল বেড়ে গেছে। তবে সবাই উপভোগ করছে বেশ! এতে কোন সন্দেহ নেই। এ পর্যায়ে আমরা নিবো টানা দু’ঘন্টার বিরতি। এ দু’ঘন্টা সময়ে ঈশ্বর তার কিছু রুটিন ওয়ার্ক করবেন। এখন আপনাদেরকে নিয়ে যাবো স্টুডিওতে। সেখানে ঈশ্বরের বিশেষ কর্মসূচী নিয়ে আলোচনা করার জন্য উপস্থিত আছেন দু’জন দেশ বরেণ্য বুদ্ধিজীবী। আমরা ফিরে আসছি ঠিক ঠিক দু’ঘন্টা পর। ততক্ষণ পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন। শুভ দুপুর।
(৩)
বিরতির পর
পড়ন্ত বিকেলে আবারো সবাইকে আবারো স্বাগত জানাচ্ছি। মহাপ্রভু ঈশ্বরের বিশেষ কর্মসূচীর এ পর্যায়ে উপস্থিত মানুষের সংখ্যা কিন্তু অনেক বেড়ে গেছে। দুপুরের পর হতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ এখানে ভিঁড় জমিয়েছেন। আপনাদের জন্য সর্বশেষ আপডেট হচ্ছে ঈশ্বর তার কর্মসূচী কিছুটা ছোট করেছেন। দু’জন দরিদ্র বিধবার দারিদ্রতা দূরীকরণের সিগমেন্ট বাতিল করা হয়েছে। তার মানে বুঝতেই পারছেন, এ দু’মহিলার অভাবক্লিষ্ট জীবনের সমাপ্তি হচ্ছে না। ঈশ্বরের সময় স্বল্পতার কারণে তাদেরকে দরিদ্র থেকে যেতে হচ্ছে। দর্শক আপনাদের সুবিধার্থে আমাদের একটি ক্যামেরা হেলিকপ্টারে করে উপর থেকে কিছু দৃশ্য দেখাচ্ছে। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন ঈশ্বর সবার সামনে, তাঁর পেছনে লাখ ছুঁই জনতা। জনস্রোত এ গ্রাম ছাড়িয়ে পাশবর্তী দু’গ্রাম মাড়িয়ে তারও অনেকদূর চলে গেছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে নেমে এসে শোডাউন করছেন মহাপ্রভু ঈশ্বর।
এ বিশাল মিছিল নিয়ে ঈশ্বর চলছেন গোয়াল ডগির দিকে। একই সাথে অনেকগুলো ফসলী জমি পাশাপাশি থেকে যখন বিস্তৃর্ণ ফসলের এলাকা সৃষ্টি করে, এখানকার স্থানীয় ভাষায় তাকে ডগি বলা হয়। গোয়াল ডগিতে প্রায় ত্রিশ হাজার একর জমি আছে। এ ডগিতে পড়েছে তিনটি গ্রামের সীমানা। আধুনিক সেচ ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টিহীন এ সময়ে ফসলের জমি শুকিয়ে মাটি ফেটে টাইলসের টুকরার মতো হয়ে গেছে। প্রতিটি ফাটল প্রায় ছয় সাত ইঞ্চি চওড়া এবং এরচেয়েও বেশি গভীর। ঈশ্বর এখন এ বিস্তৃর্ণ ফসলী এলাকার জন্য বৃষ্টির নির্দেশ দিবেন। দর্শক আপনারা দেখুন কীভাবে হাতের লাঠিটি একটু উপরে তুলে বৃষ্টির নির্দেশ দিচ্ছেন ঈশ্বর। এবার দেখুন বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য।
উপরের ক্যামেরা থেকে বৃষ্টির দৃশ্য থেকে বিস্মিত হচ্ছেন? হওয়া্ই কথা। এ ডগিতে শ্যামলা, কালো, ফর্সা সব ধরনের মানুষের জমি আছে। কিন্তু বৃষ্টির পানি পড়ছে কেবল ফর্সা মালিকদের জমিতে। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। দর্শক ভালো করে দেখুন। চওড়া গভীর ফাটগুলোয় পানি জমে ডুবে গেছে। ধীরে ধীরে পানির পরিমান বাড়ছে। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে জমির মালিকের দেয়া সীমানা অতিক্রম করে বৃষ্টি পড়ছে, আবার কোথাও নির্ধারিত সীমানার ভেতরে সমান্তরাল কিছু যায়গা বাদ দিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বুঝতেই পারছেন বিষয়টা কী? 'আইল ঠেলাঠেলি' বলে একটা বিষয় আছে। এখন সুবিধা হলো। দখলকৃত জমি পুনরুদ্ধার করা যাবে। কিন্তু ঈশ্বরের আজকের কর্মসূচীকে শ্যামলা ও কালো বর্ণের মানুষরা বয়কট করার কারণে সংকট দেখা দিতে পারে। যাকে অস্বীকার করেছে, তার নির্ধারিত সীমানা স্বীকার করার প্রশ্নই উঠে না!
উপস্থিত জন সাধারণের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অনেকেই খুশিতে তীব্র করতালিতে গোয়াল ডগি মুখরিত করে রেখেছেন। কেউবা আবার এতদিন ধরে বৃষ্টি ঠেকিয়ে রেখে ফসলের ক্ষতি করার জন্য ঈশ্বরকে দুষছেন। কেউ বলছেন স্বৈরাচার ঈশ্বর নিজের ক্ষমতা প্রমাণের জন্য কেবল গোয়াল ডগিতে বৃষ্টি দিলেন, অথচ পুরো দেশের সব ফসলী জমি বৃষ্টির অভাবে ফেটে গর্ত হয়ে গেছে। সে যাই হোক, ঈশ্বরতো তার ক্ষমতা প্রমানে সফল হলেন। এ মুহূর্তে এটাই জরুরী বিষয়।
(৪)
প্রিয় দর্শক, দীর্ঘ সময় ধরে ঈশ্বরের বিভিন্ন কর্মকান্ড স্বচক্ষে দেখলেন। প্রমান দেখানোর পালা শেষ। এবার স্থানীয় জনগণের মনোনীত প্রতিনিধিদের সাথে ঈশ্বরের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আমরা চলে যাচ্ছি গ্রামের ফর্সা লোকদের উপাসনালয়ে। যেখানে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনায় অংশ নিবেন একজন স্কুল শিক্ষক, একজন মুদি দোকানদার ও একজন দিনমজুর। ঈশ্বরের পক্ষ থেকে কেবল ঈশ্বরই থাকবেন। আলোচনায় বসার আগে গ্রামবাসীর সাথে প্রয়োজনীয় পরামর্শ সেরে নিচ্ছেন মনোনীত প্রতিনিধিগণ। আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আলোচনা শুরু হবে।
দর্শক, আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। আমরা এখন সরাসরি তা সম্প্রচার করছি। আপনারা দেখতে থাকুন।
ঈশ্বর: আমার অস্তিত্ব, সক্ষমতা এবং সক্রিয়তার প্রমাণ দিলাম। এরপরও কেন আমার সৃষ্ট বান্দারা আমার প্রতি আনুগত্য দেখাবে না? বিষয়টি আমাকে বিচলিত করে তুলছে।
শিক্ষক: আমরা সমুদয় প্রমাণ পেলাম। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়। আপনি এতো ক্রিয়েটিভ এবং অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়েও মানুষের আনুগত্য নিয়ে বিচলিত কেন? এটা বেশ অসুন্দর বিষয়। এসব আমরা মেনে নিতে পারছি না।
মুদি দোকানদার: আপনার এতো ক্ষমতা, এতো কর্তৃত্ব মানুষের আনুগত্য প্রকাশের কাছে অসহায়। এটাতো দারুন ব্যাপার। তার মানে আপনি মানুষের চেয়ে কম শক্তিশালী। আমরা মানুষরা বরং একের প্রতি অপরে বিনয়ী ও শ্রদ্ধাশীল হবো। এ শিক্ষাটা অন্তত পেলাম।
দিনমজুর: সন্তানহীনরে মুহূর্তে সন্তান দিতে পারেন, কুমড়ারে কপিপেস্ট করে চোর মালিক উভয়ের মন খুশি রাখতে পারেন, নিজ অনুসারীদের জমিতে মানচিত্র মেপে বৃষ্টি নামাতে পারেন, কেবল মানুষের আনুগত্য আদায় করতে পারেন না! এটার মীমাংসা কে করবে?
আমরা দেখতে পেলাম দিনমজুরের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ঈশ্বর উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে গোঙাতে গোঙাতে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। প্রিয় দর্শক, তার মানে ঈশ্বর চলে গেলেন। কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে। এই মাত্র তিনজন আলোচক দরজা খুলে বের হলেন। বাইরে অপেক্ষমান জনতাকে আলোচনার ফলাফল জানাচ্ছেন।
দর্শক, আলোচকদের সিদ্ধান্তে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করছেন। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন হৈ হুল্লুড় শুরু হয়ে গেছে। কেউ বলছে ঈশ্বরতো তার সবকিছু প্রমাণ করে গেছেন, কেউ বলছে এসব কিছু প্রমাণের কী অর্থ আছে? কেউ বা ঈশ্বরকে গ্রামের নির্যাতিত মাতবরের সাথে তুলনা করছেন। বাক বিতন্ডতা ক্রমেই বেড়ে চলছে। পরিস্থিতি আসলেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। বিভিন্ন মতের লাখ খানেক লোকের মতবিরোধ এখন চরমে। কোথাও কোথাও হাতাহাতি শুরু হয়ে গেছে। অনেককে পালিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। কিছু লোক লাঠি হাতে তিনজন আলোচককে ধাওয়া করছেন। চারিদিকে ধর ধর আওয়াজ হচ্ছে।
প্রিয় দর্শক, নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা এখানেই আমাদের সম্প্রচার বন্ধ করছি। আগামীকাল সকাল ৯টায় পুরো অনুষ্ঠানটি পুনপ্রচার করা হবে। যারা আজ দেখতে পারেননি, তারা আগামীকাল দেখার সুযোগ পাবেন। এখনকার মতো বিদায় নিচ্ছি, শুভরাত্রি।