বিবর্তনবাদ তত্ত্ব সম্পর্কে যাদের তেমন কোনো ধারণা নাই – বিশেষ করে মুদ্রার অপর পিঠ সম্পর্কে – তারা এই সিরিজ একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই সম্যক ধারণার পাশাপাশি অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে। তারপর যে কোনো বই-পুস্তক বা লেখা পড়া যেতে পারে। পাঠকদের সুবিধার জন্য এই পর্বে বিবর্তনবাদ তত্ত্বের কিছু মৌলিক বিষয় ও অসারতাকে সংক্ষেপে তুলে ধরা হচ্ছে।
১. বিবর্তনবাদ তত্ত্বের মূল মন্ত্র হচ্ছে স্রষ্টার কোনো ভূমিকা ছাড়াই "এলোমেলো পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন" নামক মন্ত্রের মাধ্যমে সকল প্রকার প্রজাতির বিবর্তন – যেটি আসলে নাস্তিক্য বা বস্তুবাদী দর্শন এবং যার সাথে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনোই সম্পর্ক নেই।
২. বিবর্তনবাদ তত্ত্বের দ্বিতীয় মন্ত্র হচ্ছে অতি সরল একটি অণুজীব থেকে প্রাণীজগত ও উদ্ভিদজগত-সহ সকল প্রকার প্রজাতি ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয়েছে – যেটি আদৌ কোনো প্রমাণিত সত্য নয় এবং প্রমাণ করাও আসলে অসম্ভব।
অতএব, বিবর্তনবাদ তত্ত্বের একদম মূলেই অন্ধ বিশ্বাস, অনুমান, কল্পনা, ও প্রতারণা রয়ে গেছে।
৩. আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা মিলে একত্রে চেষ্টা করলেও জড় পদার্থ থেকে ক্ষুদ্র একটি মশা কিংবা মাছির মতো জীবও সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে না। ভবিষ্যতে সে-রকম কোনো সম্ভাবনা আছে বলেও মনে হয় না। অন্যদিকে সংজ্ঞা অনুযায়ী শূন্য থেকে যেমন বিবর্তন শুরু হতে পারে না তেমনি আবার কোনো জড় বস্তু বিবর্তিত হয়ে জীবে রূপান্তরিত হওয়াও অসম্ভব। ফলে জীবের বিবর্তন শুরু হতেও প্রথম জীবকে সৃষ্ট হতেই হবে। অর্থাৎ আগে সৃষ্টি – পরে বিবর্তন। অথচ সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বোকার মতো হাসি-তামাশা ও বিভিন্নভাবে হেয় করা হচ্ছে এই বলে যে, বিজ্ঞান নাকি সৃষ্টিতত্ত্বকে নাকচ করে দিয়েছে! এটি বিজ্ঞানের নামে একেবারে ডাহা মিথ্যাচার।
৪. মানুষ এবং পশু-পাখিদের দেহে এমন কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে যেগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ধাপে ধাপে বিবর্তিত হতে পারে না। যেমন: পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ, শুক্রাণু, ডিম্বাণু, হৃৎপিণ্ড, নাসারন্ধ্র, পরিপাকতন্ত্র, ইত্যাদি। এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কোনো ভাবেই ধাপে ধাপে বিবর্তিত হতে পারে না। তার আগেই প্রাণীরা মারা যাবে এবং স্বাভাবিকভাবেই কোনো বংশ বিস্তার হবে না। প্রাণীদের ক্ষেত্রে একই সাথে বেঁচে থাকা এবং বংশ বিস্তার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি ফ্যাক্টর।
৫. যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে সরাসরি ডিম পাড়া [অস্তন্যপায়ী] প্রজাতি থেকে সরাসরি বাচ্চা দেয়া [স্তন্যপায়ী] প্রজাতির ধাপে ধাপে বিবর্তন সম্ভব নহে। এই ধরণের বিবর্তনের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ বা এমনকি যৌক্তিক ব্যাখ্যাও নেই।
৬. শিং-বিহীন প্রাণী থেকে শিং-ওয়ালা প্রাণীর বিবর্তন, লেজ-বিহীন প্রাণী থেকে লেজ-ওয়ালা প্রাণীর বিবর্তন, লেজ-ওয়ালা প্রাণী থেকে আবার লেজ-বিহীন প্রাণীর বিবর্তন, চোখ-বিহীন জীব থেকে চোখ-ওয়ালা জীবের বিবর্তন, হাতির বিশাল শুঁড় ও দাঁতের বিবর্তন, ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি’র বিবর্তন কেনো ও কীভাবে হয়েছে সেগুলোর স্বপক্ষে কোনোই প্রমাণ নেই।
৭. পা'র উপর ভিত্তি করে প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরণের প্রজাতি পরিলক্ষিত হয়। কিছু প্রজাতি আছে যেগুলোর আসলে কোন পা-ই নেই। এছাড়াও এক জোড়া, দুই জোড়া, তিন জোড়া, চার জোড়া, ও বহুপদ বিশিষ্ট অনেক প্রজাতি আছে। এই অবস্থায় পা-বিহীন প্রাণীর দেহে পা গজাতে হলে নতুন তথ্য লাগবে। ফলে পা-বিহীন কোনো প্রাণী থেকে এক জোড়া, দুই জোড়া, তিন জোড়া, চার জোড়া, ও বহুপদ বিশিষ্ট প্রজাতি ধীরে ধীরে বিবর্তিত হওয়া বাস্তবে আদৌ সম্ভব নয়।
৮. মাছ থেকে ধীরে ধীরে সরীসৃপ হয়ে কীভাবে পাখির বিবর্তন সম্ভব – তার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। তাছাড়া অসংখ্য জলচর ও উভচর প্রজাতি যে কোথা থেকে ও কীভাবে বিবর্তিত হলো – সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যাচ্ছে।
৯. প্রাণীজগত ও উদ্ভিদজগতের মধ্যে কোন প্রজাতি থেকে অন্যটি বিবর্তিত হয়েছে এবং সেটা কীভাবেই বা সম্ভব – তার স্বপক্ষে কোনোই প্রমাণ নেই। প্রাণী থেকে উদ্ভিদ কিংবা উদ্ভিদ থেকে প্রাণী কীভাবে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হওয়া সম্ভব?
১০. উদ্ভিদ জগতের মধ্যে যেমন বিভিন্ন ধরণের ফল-ফুলের গাছ আছে তেমনি আবার ফল-ফুল-বিহীন গাছও আছে। ফলে একটি ফল-বিহীন গাছ থেকে ফলের গাছ অথবা ফলের গাছ থেকে ফল-বিহীন গাছ মন্থর গতিতে কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে এবং সেটা কী করেই বা সম্ভব – তার স্বপক্ষে কোনোই প্রমাণ নেই। অনুরূপভাবে, ফুল-বিহীন গাছ থেকে ফুলের গাছ কিংবা ফুলের গাছ থেকে ফলের গাছ কিংবা ফলের গাছ থেকে ফুলের গাছ মন্থর গতিতে কীভাবে বিবর্তিত হওয়া সম্ভব – তার স্বপক্ষেও কোনো প্রমাণ বা এমনকি যৌক্তিক ব্যাখ্যাও নেই। প্রত্যেকটি ফল-ফুলের আকার-আকৃতি ও ঘ্রাণ আলাদা। কোনো কোনো গাছে কাঁটা আছে – কোনো কোনো গাছে আবার কাঁটা নেই। তাছাড়া প্রথম ফল-ফুলের বীজ বা গাছ যে কোথা থেকে এলো – সেটা কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অতএব, বিবর্তন শুরু হতেও প্রথম ফল ও ফুলের গাছকে সৃষ্ট হতেই হবে।
১১. তালগাছ পেতে হলে তালের বীজ লাগবে। তালের বীজ পেতে হলে তালগাছ লাগবে। ফলে যে কোনো একটিকে প্রথমে সৃষ্ট হতেই হবে। এখানে যেমন বিবর্তনের কোনো স্থান নেই তেমনি আবার তালের বীজ অথবা তালগাছ ছাড়া বিবর্তন শুরু হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই।
১২. একাধিক প্রজাতির মধ্যে কিছু সাদৃশ্য থাকা মানেই প্রমাণ হয় না যে একটি থেকে বাকিগুলো বিবর্তিত হয়েছে। প্রজাতিগুলোর মধ্যে প্রকৃতিগতভাবেই ‘সাধারণ জিন’ ও আরো কিছু ‘সাধারণ বৈশিষ্ট্য’ থাকতে পারে। প্রজাতিগুলোকে এভাবেই সৃষ্টি করা হয়ে থাকতে পারে।
১৩. বিজ্ঞানের অন্যান্য তত্ত্বের মতো বিবর্তনবাদ তত্ত্ব পুনঃ পুনঃ পরীক্ষা-নিরীক্ষা নির্ভরশীল কোনো তত্ত্ব নয়। যেমন কেউ যদি মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগের কোনো এক জীবাশ্মের অংশবিশেষ দিয়ে নিজের মতো ড্রয়িং করে মানুষ ও শিম্পাঞ্জির মধ্যকার ‘মিসিং লিঙ্ক’ বলে দাবি করে সেক্ষেত্রে তার দাবিকে কিন্তু খণ্ডন করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে আবার যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার এই দাবিকে কোনো রকম প্রমাণও বলা যাবে না। কারণ যাকে মানুষ ও শিম্পাঞ্জির মধ্যকার ‘মিসিং লিঙ্ক’ বলে দাবি করা হচ্ছে সেটি স্বতন্ত্র কোনো প্রজাতির ফসিলও হতে পারে।
১৪. বিবর্তনবাদীদের বিশ্বাস অনুযায়ী একটি প্রজাতি থেকে ভিন্ন একটি প্রজাতি যদি ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয়ে থাকে তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন দুটি প্রজাতির মধ্যবর্তী পর্যায়ে অসংখ্য জীবাশ্ম থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না।
১৫. বিবর্তনবাদকে জীববিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত করে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, এন্টি-বায়োটিক, মেডিসিন, ক্যান্সার, ডিএনএ, ও জীববিদ্যার উপর গবেষণাকে বিবর্তনবাদের নামে চালিয়ে দিয়ে বিবর্তনবাদকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নির্ভরশীল একটি তত্ত্ব হিসেবে দাবি করা হচ্ছে – যেটি আসলে ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা। এগুলো বিবর্তনবাদের পক্ষে কোনো প্রমাণ নয়।
১৬. বিবর্তনবাদের পক্ষে বিগত ১৫০ বছরে যে তথাকথিত প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে সেগুলো মূলত অনুমান, কল্পনা, ও প্রতারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। এগুলোকে আর যা-ই হোক পরীক্ষা-নিরীক্ষা লব্ধ বিজ্ঞানের নামে অন্তত বিশ্বাস করা যায় না।
বিবর্তনবাদকে আসলে বিজ্ঞানের নামে বিভিন্নভাবে অপব্যবহার করা হচ্ছে। কেউ কেউ তাদের নাস্তিক্য বা বস্তুবাদী দর্শনের সাথে আপাতদৃষ্টিতে ‘সমন্বয়’ খুঁজে পেয়ে এই মতবাদে বিশ্বাস করে। কেউ কেউ আবার এই সুযোগে বিবর্তনবাদকে বিজ্ঞানের নামে সত্য হিসেবে চালিয়ে দিয়ে বিশেষ দু-একটি ধর্ম ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার ও ঘৃণা-বিদ্বেষকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টায় আছে। সংশয়বাদী ও সমালোচকদের হাত থেকে বিবর্তনবাদকে যেভাবে পৈত্রিক সম্পত্তির মতো জান-প্রাণ দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে – তা থেকেই তাদের উদ্দেশ্য বোঝা যায়।
ধর্ম যে-সময় পর্যন্ত পাদ্রী-পুরোহিতদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল সে-সময় পর্যন্ত ইতিহাস সবারই জানা। ঘোর অন্ধকার! পাদ্রী-পুরোহিতদের হাত থেকে ধর্মকে মোটামুটিভাবে মুক্ত করার পরই কেবল তারা সভ্য ও মানবিক হয়েছে এবং সেই সাথে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতেও উন্নতি করেছে। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে নিকট ভবিষ্যতে নাস্তিক পাদ্রী-পুরোহিতদের যুগ শুরু হতে যাচ্ছে – যারা বিজ্ঞানের ইজারা নিয়ে আমজনতাকে যাচ্ছেতাই খাওয়াতে চায়। দুটি গ্রুপ আসলে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ আরকি।