সারাটা বছর অপেক্ষা করে থাকি একুশের বইমেলার জন্য। শুধু বই কেনার জন্যে নয় বরং বইমেলায় ঘোরার জন্য। একুশের বইমেলার আমেজটাই ভিন্ন। অদ্ভুত এক উৎসবমুখরতায় ভরে ওঠে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গন। কিন্তু চিন্তার যথেষ্ঠ কারণ আছে। যতটা সহজভাবে বইমেলাকে উপস্থাপন করলাম ততটা সরল অবস্থা বইমেলার নেই। শুনতে হয়তো খারাপ শোনাবে তাও শ্রুতিকটু কথাটি যে বলতেই হবে আমাকে। অতীতেও বইমেলায় গিয়ে তুমুল জনপ্রিয় নয় এমন লেখকের বই নির্দিষ্ট প্রকাশনার স্টলে গিয়ে খুঁজে পেতে সমস্যা হয়েছে। কিছু প্রকাশনা সৃজনশীলতার নামে দিনে-দুপুরে পাঠক-ক্রেতাদের সাথে মশকরা আসছে। আসলে বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না, একুশের বইমেলা হবে প্রকাশকদের মেলা, একুশের বইমেলা আমাদের সংস্কৃতি চর্চার অংশ, আমাদের প্রাণের মেলা, সৃজনশীল সাহিত্যের প্রাণক্রেন্দ্র এসব এখন বড্ড মিথ্যা বলে মনে হয়। সব কিছু ছাপিয়ে এখানে আসলে কাগজে অক্ষর ছাপিয়ে বাঁধাই করে বই নামক একটি পণ্য বেচা হয়। সেই বই একটি পণ্য এবং সে পণ্য বিক্রি করে প্রকাশক-বিক্রেতাদের মুনাফা লাভ হয়। এটাই সত্য। এটাই একমাত্র সত্য বলে মনে হয় প্রায়শ। তবে সব প্রকাশক এমন নয়। কিন্তু অনেকেই এমন। ব্লগে যেহেতু স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার আমার আছে, এটি যেহেতু কোনো পেপার-পত্রিকা নয় সেহেতু আমি নাম ধরেই অভিযোগ আনতে চাই কিছু প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এতে কেউ আঘাত পেলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত কিন্তু আমাকে বলতে হবে তাদের জন্য যারা জানেন না।
যেসব প্রকাশনার স্টলে বরেণ্য লেখক হূমায়ুন আহমেদের বই পাওয়া যায় সেসব স্টলে অন্য বই কেনা দুরূহ না না অসম্ভব। বিশেষ করে প্রকাশনার স্টলটি যদি হয় অন্যপ্রকাশের। সেখানে "আমাকে এক পিস, আমাকে ৫ পিস, আমাকে সবগুলো একপিস দেন"- এভাবে হূমায়ুন আহমেদের বই বেচা-কেনা হয়। বইয়ের নাম বা লেখকের নাম উচ্চারণের প্রয়োজন পড়ে না। তবে এবারে সেখানে আমার অন্যতম প্রিয় লেখক আতাউর রহমানের 'দুই দু' গুণে পাঁচ' বইটি কেনার জন্য দু'বার গিয়েও পাই নি। দ্বিতীয়বারের অভিজ্ঞতা অন্য প্রকাশের আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। জনপ্রিয় লেখক হূমায়ুন আহমেদের বইয়ের ক্রেতাদের মাঝখান দিয়ে কমান্ডো স্টাইলে স্টলের কাছে গেলাম। দুই তিনবার চিৎকার করে বইয়ের নাম বলার পরে বিক্রেতাদের একজনের মনে আমার জন্যে দয়া জাগ্রত হলো। তিনি বললেন যে তাদের কাছে বইটি নেই। আরেকজন অ-হূমায়ুন আহমেদ ক্রেতা স্টলের পেছনে রাখা বইগুলো থেকে একটি বই দেখতে চাইলেন। বিক্রেতাএবার ততটা সদয় হলেন না। তিনি উত্ত্র দিলেন, "পেছনের বই এখন বিক্রি করবো না।" নাছোড়বান্দা ক্রেতা বেচারা বললেন যে তিনি বইটা একটু দেখতে চান। এবারে বিক্রেতার কণ্ঠে উষ্মা টের পেলাম। "এখন বই দেখবেন। দেখে কিনবেন। সে সুযোগ নেই।" তার শক্ত জবাব।
সলে বিক্রেতাদের হূমায়ুন আহমদের বই বিক্রি করতে করতে কালো ঘাম ছুটে যাচ্ছিল। অন্য বই দেখানোর সময় বা সুযোগ তাদের হাতে ছিল না। তাদের দোষ আমি দিই না। কিন্তু এখানে সৃজনশীলতা, মেধা,মন, উৎকর্ষতার মতো উচ্চমার্গীয় বিলাসী শব্দের খোঁজ আমি পেতে ব্যর্থ হই। এখানে আমার চোখ দেখতে পায় পণ্য কেনা-বেচার হুল্লোড় শুধু।
আর সময় প্রকাশন বা কাকলীতে হূমায়ুন আহমেদের আগের বই এবং সমগ্রগুলো পাওয়া যায়। সেখানে কোনোমতে স্টলের বিক্রেতার সাথে কথা বলার সুযোগ হয় বটে কিন্তু তাদের প্রকাশনার অন্য একজন লেখকের বই আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে তাদের না-বোধক জবাব আসে। ঐ লেখকের বই বেশি চলে না বলে তারা সম্ভবত তার বই পুনর্মুদ্রণ করেন না অথবা বইমেলায় না এনে পুরোন কপিগুলো গুদামে রেখে আসেন। জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই যেসব স্টলে পাওয়া যায় সেসব স্টলের চিত্র হূমায়ুন আহমেদের মতো অতটা ভয়াবহ না হলেও খুব একটা সুবিধাজনক নয়। পাঠক তার পছন্দের বই কেনার জন্য ভিড় করবেন। বিক্রেতাও যে বইয়ের কাটতি বেশি সেটিই ছাপাবেন এবং বিক্রি করতে চাইবেন। এখানে কোনো পক্ষেরই কোনো দোষ দেখি না। কিন্তু সৃজনশীলতা আর সংস্কৃতি-সাহিত চর্চার মতো বিলাসী কথা এখানে মানায় না। বইমেলা সম্পর্কে সেসব কথা শুনতে আমার যথেষ্ঠ আপত্তি আছে। বইমেলা এখন প্রায় বইয়ের দোকানের একটা সমাহার।
ঘটনা এখানে শেষ নয়। কোনো একটি প্রকাশনার স্টল সম্ভবত সময় বা কাকলী বা অন্য কোনো শ্তলে যেখানে হূমায়ুন আহমেদের একটি নতুন বই এসেছে সেখানে আমার এক বন্ধু অন্য লেখকের একটি বই চাইতেই বিক্রেতা সুন্দর মতো তার হাতে থাকা হূমায়ুন আহমেদের নতুন বের হওয়া বইটা ধরিয়ে দিতে চাইলেন। দ্বিতীয় বার বইয়ের নাম বলার পর তার সম্বিত ফিরলো। আসলে এক বই বিক্রি করতে করতে সে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে অন্য লেখকের বই চাইলে স্থিতি জড়তার কারণে তিনি হূমায়ুন আহমদের বইই বাড়িয়ে দেন। হুবহু একই ঘটনা ঘটলো মাওলা ব্রাদার্সের স্টলে। আমার আরেক বন্ধু শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সাইদের বই দেখতে চাইলে প্রথমেই তার হাতে হূমায়ুন আহমেদের একটি বই ধরিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি।
বইয়ের পাঠক বেড়েছে, বেড়েছে প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা। বেড়েছে লেখকের সংখ্যাও। আর তারই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌরাত্ম। বইমেলায় তাদেরই জয়জয়কার। ধুমধাম করে লেখকদের আতকে কথা বলা শুরু করছে। আশেপাশে ভিড় জমে যাচ্ছে। হাঁটাও দায় হয়ে পড়ছে। চলতে ফিরতে দুম করে মুখের সামনে প্রমাণসাইজের ক্যামেরা চলে আসছে। আহা! ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বিকেল বেলায় বইমেলা নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করার পাকা বন্দোবস তারা লাভ করেছেন। সব চ্যানেলে একই কাহিনী। বইমেলায় সব প্রকাশনাকে স্টল দিতে যেখানে হিমশিম খেতে হয় সেখানে রেডিও চ্যানেল, মিডিয়া সেন্টার, বিএসবি ক্যাম্ব্রিয়ান, বসুন্ধরা পেপারের স্টলের বন্দোবস্ত কীভাবে হয় তা আমার ক্ষুদ্র বোধশক্তিতে বোধগম্যতা লাভ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। বইমেলায় রেডিও, টিভি, কাগজ কিংবা অন্য কোনো পণ্যের স্টল থাকার যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের স্টল দেখে অবাক হয়েছি। তবে কানে কানে একটা কথা বলে রাখি। বইমেলার সবচেয়ে বড় বিনোদন হলো অন্য প্রকাশের চার তলার সমান স্টল। আর সৃজনশীলতার বুলি কপচানো সুশীলের বিগ মাউথ পাঠক সমাবেশ হলো বই বেচে পাঠকদে দেউলিয়া করার অব্যর্থ প্রতিষ্ঠান। ৪০০ টাকার নিচে তাদের কয় বোধহয় হাতে গোণা। হাজার টাকার ঊপরে বই না বেচলে তাদের বোধহয় সৃজনশীল প্রকাশনার তকমা লাগাতে অসুবিধা হয়। বইয়ের অধিক দামের কথা জিজ্ঞেস করলে তারা হয়তো ফার্স্ট ক্লাস কাগজ, মনোরম প্রচ্ছদ আর পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ফাঁকা জায়গা বাড়িয়ে পৃষ্ঠা বাড়ানোর অজুহাত দাঁড় করাবেন। সব কথার শেষ কথা হলো বইমেলায় সৃজনশীল সাহিত্যের চেয়ে ডোরেমন বেশি বিক্রি হয়।