আমার এলাকার এক বড় ভাই আছেন, যিনি সম্প্রতি একটা স্টার্টাপ দিয়েছেন। লোকটি ভীষন পরিশ্রম ও মেধাবী এই বিষয়ে আমাদের কোন সন্দেহই নাই। এখানে তার এই স্টার্টাপ জার্নি নিয়েই আমার গল্প লেখার প্রয়াস।
ডিসক্লেইমার
১) এই লেখাটি নিছকই একটি গল্প। হতে পারে আপনার বা আপনার পরিচিতো কারো সাথে সামান্য কিংবা পুরোটা মিলেও যেতে পারে। এটা কাকতালীয় ব্যাপার হিসেবে গণ্য করার বিনীত অনুরোধ করছি।
২) এখানে কাল্পনিক চরিত্র আজাদ ভাইকে নিয়ে লেখা হয়েছে। তাই কেউ নিজের সাথে মিল খুজে পেলে "ব্যাক্তি আক্রমন" হিসেবে না নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা হিসেবে ভেবে দেখতে পারেন।
অধ্যায়-১
প্রথম খন্ডঃ
বছর দশেক আগের কথা, আমাদের এলাকার বড় ভাই কেমিস্ট্রি থেকে পাস করে বের হয়েছেন। তিনি চাইলে দেশের একজন রসায়নবিদ হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে পারতেন। কিন্তু চাকুরি মেলা তো খুব কঠিন। তাই তিনি পরিচিত এক ভাইয়ের মাধ্যমে চামড়াজাত পন্য শিল্পের চাকুরিতে ঢুকে পড়লেন। অক্লান্ত পরিশ্রম আর দারুন মেধার পরিচয় দিয়ে দ্রুত উন্নতি করলেন। যেহেতু এই শিল্প রপ্তানি নির্ভর, তাই বিদেশী ক্রেতা/পার্টনার হ্যান্ডেল করতেন। মেধা ও যোগ্যতার কমতি ছিলো না কখনোই, ছিলো প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস। পেশাগত জীবনে উন্নতি করতে সময় লাগেনি। এই সময়ে এসে এত বেশি আয়-রোজগার করতে শুরু করলেন, যা বছর খানিক আগে কল্পনাও করতে পারেন নি।
দ্বিতীয় খন্ডঃ
এই পর্যায়ে এসে আজাদ ভাইয়ের স্বভাব-চরিত্র ও আচার আচরন ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগলো। তিনি সবখানে, সব জায়গায় শো-অফ করা শুরু করলেন। আজ এতো টাকার ঘড়ি পরেছি, কাল অত টাকার জুতা কিনেছি, বিদেশী ব্রান্ডের জামা-জুতা-অন্তর্বাস ছাড়া পরি না ইত্যাদি ইত্যাদি। আজাদ ভাইয়ের আচরনে অহংকার ফুটে উঠতে থাকলো। এই পর্যায়ে আজাদ ভাই বিয়ে করলেন, দাওয়াত দিলেন। বেশ এলাহী আয়োজন। মিথ্যে বলবো না, খাবারের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। ঘরের লক্ষীর ভাগ্য বলে হয়তো কিছু আছে, কারন আজাদ ভাইয়ের অতি অতি অতি উচ্চ বেতনে জাপানের ওসাকাতে চাকরি হয়ে গেলো্। আমরা খুলনায় বসে মাছি মারি, আজাদ ভাই ওসাকার বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরে বেড়ান। আমরা খুলনার চিপগলিতে বেলপুরি খাই, আজাদ ভাই ওসাকাতে সুশি খেয়ে বেড়ান। আমরা বন্ধুরা আরিফ কাকার দোকানের বোটকা গন্ধের লাল চা খাই, আর ফেসবুকে আজাদ ভাইয়ের লেখা পড়ি, তিনি বিদেশী বান্ধবিকে নিয়ে ওয়াইন খেয়ে বেড়াচ্ছেন। অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়, "কপাল কইরা জন্মাইছে.."
তৃত্বীয় খন্ডঃ
আজাদ ভাই এই পর্যায়ে ফেসবুকে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। আমরা সবাই দেখতে পাই পৃথিবীর এমন কোন বিষয় নেই যা তিনি জানেন না, এমন কোন ঘটনা নেই যা তিনি বিশ্লেষন করতে পারবেন না। মেশিন লার্নিং, হ্যাকিং, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট, কোয়ান্টাম কম্পিউটার, রকেট সাইন্স, আমেরিকার নির্বাচন, ইসলাম ধর্ম, বিদেশী মুভি, ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, কাবাডি পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যেই বিষয়ে ফেসবুকে তার বিশেষজ্ঞ মতামত দেখা যায় না। সব কিছুইতেই তিনি এক্সপার্ট হিসেবে জ্ঞান দেন।
আরো ক্লিয়ারলি বলতে গেলে যেই বিষয়ে লিখলে পাবলিক খাবে, লেখা নিয়ে আলোচনা হবে তিনি সেই বিষয়েই ফেসবুকে লিখেন। আমার বন্ধু ফয়সাল এর মতে, "আজাদ হচ্ছে ফেসবুকের রাখী সাওয়ান্ত।"
আজাদ ভাইয়ের আচরন এই পর্যায়ে উগ্র থেকে উগ্রতর হতে থাকে। তিনি ফেসবুকে গালি ছাড়া লেখা লিখেন না। একটা ইকমার্স এর স্ক্যাম নিয়ে দারুন দারুন লেখা লিখলেও অশ্লীল ভাষা ও গালি তাতে থাকবেই। সকল ভাইরাল বিষয়ে তিনি লেখেন, কোন ভাইরাল কিছু না পেলে ইসলাম ধর্ম নিয়ে খোচা ও চুলকানিমূলক লেখা লিখেন।
পুরনো পন্থা, দেশে ইসলাম ধর্মানুসারী বেশি, এই ধর্মকে খোচা মেরে লিখলে আলো চনা হবেই। এবং তিনিও ভাইরাল হয়ে যাবেন।
বান্ধবী সুফিয়ার মতে, "এই যে আজাদ ভাইয়ের ধীরে ধীরে বদলে যাওয়া, তার অহংকার ও হামবড়া ভাব, টক্সিক আচরন, এটাই হয়তো তার আসল সত্তা, যা এতদিন ঢাকা পরেছিলো। পয়সা ও জনপ্রিয়তার প্রভাবে আসল সত্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।"
অধ্যায় - ২
আজাদ ভাই এই পর্যায়ে ভাবলেন দেশের জন্য কিছু করা দরকার। দেশে হাজারো লাখো বেকার ছেলেমেয়েরা চাকুরি পায় না। কারন তাদের ফেসবুক, টুইটার, লিংকডিন ঠিক নাই। তারা সিভি লিখতে পারে না। তারা ইন্টারভিউতে কথা বরতে পারে না। তাই তিনি সামান্য কিছু ফি নিয়ে তাদের সিভি লেখা শিখিয়ে দিবেন এবং ফেসবুক-লিংডিন ঠিক করে দিবেন।
আগেই বলেছি ফেসবুকে তিনি ভীষন পরিচিত। বড় বড় সেলেবরা তার লেখায় লাভ-ও্য়াউ দেন, কমেন্ট করেন। এইটাই বিজ্ঞাপন হিসেবে যথেষ্ঠ। হলোও তাই। আজাদ ভাই সামান্য কিছু ফি এর বিনিময়ে তরুন সমাজকে পথপ্রদর্শন করতে থাকলেন। বছর খানেক আগে টাকা নিয়ে মোটিভেশন সেমিনার করা মোটিভেশনাল স্পিকারদের তুলোধুনো করা লোকটা আজ একই পন্থায় এগিয়ে চললেন।
অধ্যায় -৩
মানুষ ট্রেন্ডি থাকতে ভালোবাসে। এই শতাব্দীর শুরুর দিকে কম্পিউটার বিষয়ে ভীষন ক্রেজ ছিলো। এই ক্রেজি হাইপ কাজে লাগিয়ে "কম্পিউটার পদ্ধতিতে ইংরেজী শিখুন", "কম্পিউটার পদ্ধতিতে চশমা বানানো হয়" টাইপের বিজ্ঞাপন দেখা গিয়েছিলো। এই কম্পিউটার পদ্ধতির পরে এসেছিলো ইন্টারনেট পদ্ধতি। তারও পরে এসেছে এআই ও মেশিন লার্নিং পদ্ধতি। যে কোন কিছুর সাথে এ.আই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স) ও মেশিন লার্ণিং শব্দ লাগিয়ে দিন, বিক্রি হবে প্রচুর। কেউই এই বিষয়ে তেমন কিছু বুঝে না, কিন্তু সবাই ভাবে এইটা কুউল টপিক।
আমাদের আজাদ ভাই ভাবলেন, এবার তিনি ভার্সিটিতে পড়তে ইচ্ছুক ছেলে-মেয়েদের সাবজেক্ট চয়েজ করানোর উপায় বাতলে দিবেন। এইজন্য তার টিম মিলে দীর্ষ প-নে-রো দিন ধরে একটা সফটোয়ার বানিয়েছেন। যেটা আপনাকে বলতে পারবে আপনার কোন বিষয়ে পড়া উচিৎ। যেহেতু তিনি এআই ও মেশিন লার্নিং এর তকমা জুড়ে বিজ্ঞাপন চালাচ্ছেন, তাই আর স্টার্টাপ নিয়ে মানুষের আগ্রহও দেখা যাচ্ছে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নসমূহঃ
গল্প শুনেই আমার বান্ধবীআলভী আমাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে ফেললো।
-> আজাদ স্টার্টাপ খুললে তোর কি সমস্যা?
♦ কোনই সমস্যা নাই। পরিচিত যে কেউ "বাস্তব জীবনে কার্যকর কিছু" নিয়ে ব্যবসা করলে আমি খুশিই হবো।
-> আজাদ অহংকারি হলে বা টক্সিক হলে তোর তাতে কি? আজাদের ব্যবহার খারাপ হলে তোর সমস্যা কোথায়?
♦ আপনি যখন ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন, তখন আপনার আচরন সংযত হওয়া জরুরী। বিশেষ করে উঠতি বয়তের তরুন-তরুনীকে যদি গাইড করতে চান, নিজের পাবলিক ইমেজ ভদ্র রাখাই কাম্য। আপনি সিভি লেখা শেখাবেন, ফেসবুক-লিংডিন প্রফেশনাল ভাবে সাজানো শেখাবেন আবার নিবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্ম নিয়ে চুলকানিমূলক লেখা দিবেন, অশ্লীল ভাষা ও গালি দিয়ে উগ্র লেখা লিখবেন.. এই দুইটা ব্যাপার একসাথে যায় না।
-> আজাদ সিভি লিখার ব্যবসা করলে তোর আপত্তি কোথায়?
♦ আজাদ ভাই আগে টাকার বিনিময়ে মোটিভেশনাল সেমিনার এর বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছে। টাকার বিনিময়ে কোর্স করানোতে আপত্তি তুলেছে। সেই আজাদ যখন মোটা টাকার বিনিময়ে সিভি লেখা শেখায়, লিংডিন ফেসবুক সাজানো শেখায় তখন বিষয়টা হাস্যকর। সে সেবা হিসেবে সার্ভিসটি দিতে চাইলে ফ্রি কন্টেন্ট তৈরী করে শেয়ার করতে পারতো। কিন্তু মোটা ফি নিয়ে সিভি লেখা শেখানো, ইন্টারভিউ এ কথা বলা শেখানো একটা ভাওতাবাজি। আদতে এর তেমন কোন ইমপ্যাক্ট হয় না। কেননা একটা জুনিয়র পোষ্টের বিজ্ঞাপন দিলে হাজারো সিভি জমা হয়। অত গুরুত্ব দিয়ে সিভির শব্দ চয়ন, ডিজাইন দেখার সময় পাওয়া কঠিন।
-> আজাদ এর এ.আই সফটোয়ার নিয়ে তোর সমস্যা কোথায়?
♦ কনসেপ্টটাই ইলজিক্যাল। বিশেষত আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে। এদেশে পাবলিক ভার্সিটিতে নিজের পছন্দের বিষয় চয়েজ করা যায় না। অর্থাৎ আজাদ এর টার্গেট প্রাইভেট ভার্সিটি, বিশেষ করে প্রাইভেট ভার্সিটির টাকাওয়ালা স্টুডেন্ট। তারা বেশিরভাগই বাবা-মা এর পছন্দের বিষয়ে কিংবা নিজেদের পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে আগ্রহী হয়। দুনিয়া উল্টে গেলেও বিত্তশালী পরিবারের এই সন্তানদের পছন্দকে টলানো কঠিন। তারপরেও ধরে নিচ্ছি এরা আজাদের সফটোয়ার ব্যবহার করবে, তাহলে তাদের ক্যারিয়ারের সফলতার গ্যারান্টি কি আজাদ দিবে? মনে রাখা উচিৎ, আজাদ এর এই সফটোয়ার ১৫ দিনে তৈরী (তার নিজের লেখায় পাওয়া), কোন পরীক্ষামূলক ভার্সন ছাড়া হয়নি, রিসার্চ করা হয়নি, এর কার্যকরতার কোন স্বীকৃতিও পাওয়া যায় নাই।
আজাদের উচিৎ আরো সময় নিয়ে গবেষনা করে, কার্যকরতার প্রমান দেখিয়ে বিজ্ঞাপন চালানো। তারপরেও আমার মনে এই সফটোয়ারের বাস্তব প্রয়োগ হাস্যকর।
ভার্সিটিতে ভালো লাগার বিষয়ে পরেও মাঝপথে অনেকে স্যুইচ করে ফেলে। বহু মেধাবী ছাত্র হিসেবে লেখাপড়া শেষ করেও ভিন্ন পেশায় সফলতা পেয়েছে। তাই বলে বিষয়টা এমন নয় যে ভার্সিটিতে পড়া বিষয়টার জন্য সে যোগ্য না। আজাদের সফটোয়ার ব্যবহার করলে হয়তো আবুল হায়াতকে বলতো, কাগু তোর বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার যোগত্যা নাই, তাই ঢাবিতে নাট্যকলা পড়। আনিসুল হককে বলতো, ভাই তুই বুয়েটের সিভিলে কেন পড়বি, তুই বাংলা সাহিত্য পড়। আজাদের সফটোয়ার হয়তো বলিউডের ক্রিতি শ্যাননকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার যোগ্য ভাবতো না, কিংবা অভ্র কিবোর্ড এর মেহেদী হাসানকে ডাক্তারি পড়ার যোগ্য ভাবতো না।
লেখাপড়ার বিষয় নিজের ভালো লাগা, মেধা, পরিচিতজনদের উপদেশ ও শিক্ষকদের সাজেশন থেকে নিজে উপলদ্ধি করা উচিৎ। কোন সফটোয়ার সেটা পারবে না। সেটা যতই এ.আই, মেশিন লার্নিং হাবিজাবি তকমা জুড়ে দেয়া হোক না কেন।
শেষের আগেঃ
এটা গল্প কিংবা হাবিজাবি লেখা। এটা কোন সাহিত্য না। কোন আক্রমন না, তবে সমালোচনামূলক মতামত ভাবলে লেখকের আপত্তি নেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ২:২৮