আমি প্রফেশনাল মুভি রিভিউয়ার নই। সুপ্ত অভিনয় দক্ষতা, নির্মানশৈলী, শটের এঙ্গেল এসব বিচার করার যোগ্যতা নাই। একজন দর্শক হিসেবে ছবিটির রিভিউ লিখছি।
লক ডাউনে বসে বসে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি, তাই ভাবলাম একটু ইউটিউবে ঢুকে ফানি ভিডিও দেখি। ইদানিং আমার মন মেজাজ ভালো করার পদ্ধতি হচ্ছে ইউটিউবে "unexpected meme compilation", "Watch People Die Inside", "People are awesome", "shot on iphone meme" টাইপের ভিডিও দেখা। ইউটিউবে ঢুকেই দেখলাম মিমি মুভিটা ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে। সময় কাটানোর জন্যই দেখা শুরু করলাম। ছবিতে শক্তিশালী অভিনেতা পঙ্কজ ত্রিপাঠি আছে দেখেই বুঝেছি বোরিং লাগবে না।
শুরুর আগে সারোগেসি সম্পর্কে একটু জানিয়ে রাখি, এটা নিয়ে যারা জানেন না, তাদের জন্য সুবিধা হবে।
কোন দম্পতিতে যদি স্ত্রী সন্তান ধারনে অক্ষম বা অনিচ্ছুক হয়, সারোগেসি পদ্ধতিতে স্বামীর শুক্রানু সংগ্রহ করে অন্য কোন নারীর শরীরে প্রবেশ করিয়ে কৃত্রিমভাবে ডিম্বানুর সঙ্গে মিলন ঘটানো হয়। এই পদ্ধতিতে গর্ভধারীনি মহিলা সন্তান জন্মের পর সন্তানের বাবা ও বাবার স্ত্রীর (মা) কাছে ফেরত দিয়ে দেন।
ইন্ডিয়ায় এটি অনেকে উপার্জনের পদ্ধতি হিসেবে নিয়েছে এবং দরিদ্র মহিলারা অর্থের বিনিময়ে সারোগেট মা হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়ে উপার্জন করছেন।
কাহিনীঃ সামার এবং জন নামের আমেরিকান এক দম্পতি ইন্ডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে যুবতী ও ফিট শরীরের এক মেয়ের খোজে। তাদের সন্তানের সারোগেট মা হওয়ার জন্য। কিন্তু দালালদের দেখানো অপুষ্টিতে ভোগা দূর্বল মেয়েদের দেখে তাদের পছন্দ হচ্ছে না। এমনই এক দালাল মোবাইলে যোগাযোগ করে জন এর সাথে। জন ও তার স্ত্রী সামার তখন রাজস্থানে তাদের সন্তানের সারোগেট মা এর জন্য ফিট ও যুবতী মেয়ে খুজে বেড়াচ্ছে। দালালের সাথে জন এর ইংরেজীতে কথোপকথন অল্প অল্প ইংরেজী জানা ট্যাক্সি ড্রাইভার ভানুপ্রতাপ পান্ডে (পঙ্কজ ত্রিপাঠী) শুনে ফেলে এবং তাদের সাথে কথা বলে সারোগেট মা খোজার বিষয়টি জানতে পারে। ভানু জানায় সে নিজেও ১২ বছর ধরে নিঃসন্তান। একপর্যায়ে সে ৫ লক্ষ টাকার চুক্তিতে সারোগেট মা খুজে দেবার জন্য দায়িত্ব নেয়।
এদিকে সামার ও জন হোটেলে একটি মেয়েকে নাচের পারফর্ম করতে দেখে। ড্যান্সার মিমি রাঠোর (ক্রিতি শ্যানন) এর বয়স ও ফিট শরীর তাদের চাহিদার সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। যেহেতু এ্যাথলেট ও ড্যান্সারদের শরীর সন্তান ধারন ও জন্মদানে বেশি সক্ষম, তাই মিমিকে তারা পছন্দ করে ফেলে। এই দম্পতি ড্রাইভার ভানুপ্রতাপকে দায়িত্ব দেয় মিমিকে সারোগেট মা হতে রাজী করানোর জন্য।
এদিকে মিমি রাথোর এর স্বপ্ন বলিউডের নায়িকা হওয়ার। কিন্তু সিনেমায় সরাসরি সুযোগ পেতে আগে তাকে পরিচালকদের চোখে পরতে হবে, এই জন্য মুম্বাইয়ের এক এজেন্ট এর সাথে তার যোগাযোগ হয়, যে ফটোশুট বা মিউজিক ভিডিওর মাধ্যমে মিমিকে বলিউডে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেয়। তবে এই জন্য ৫-১০ লক্ষ টাকা প্রয়োজন, যা মিমির পক্ষে যোগাড় করা সম্ভব না।
ভানুপ্রতাপ বেশ কয়েকদিন মিমিকে এ্যাপ্রোচ করে শেষ পর্যন্ত সারোগেসির পদ্ধতি ও চুক্তি সম্পর্কে বুঝিয়ে বলে। এবং জানায় যে সারোগেট মা হওয়ার বিনিময়ে জন ও সামার তাকে ২০ লক্ষ টাকা দিবে।
নায়িকা হওয়ার জন্য পাগল মিমি ২০ লক্ষ টাকার কথা শুনে পটে যায় এবং সারোগেট মা হতে রাজী হয়ে যায়।
মিমি বাড়িতে জানায় যে সে সিনেমায় সুযোগ পেয়েছে এবং শ্যুটিং এর জন্য তাকে ৯ মাস বাইরে থাকতে হবে। অনেক চেষ্টার পর বাবা-মা কে রাজি করায়। কিন্তু প্রেগন্যান্সির সময়ে থাকার জন্য জায়গা খুজে না পাওয়ায় মিমির বান্ধবী শামা তাকে নিজের বাড়িতে থাকতে বলে। শামার বাবা মসজিদের ইমাম এবং বাড়িতে খুব একটা থাকেন না। তাই মিমি শামার সঙ্গে তাদের বাড়িতে গিয়ে উঠে। এদিকে জন ও সামার প্রেগন্যান্সির সময়ে মিমির ও বাচ্চার খেয়াল রাখার জন্য ড্রাইভার ভানুকে দায়িত্ব দেয়ায় সেও শামার বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করে।
শামা মুসলমান এবং তাদের বাড়ি মুসলিম মহল্লায়, তাই এলাকার সবার কাছে মিমি ও ভানু মুসলমান, শামার আত্মীয় এবং স্বামী স্ত্রী বলে পরিচয় দেয়। মিমি সবসময় বোরকা পরে বাইরে যায় যাতে তাকে কেউ চিনতে না পারে।
প্রেগন্যান্সির সময়ে চেকআপের রিপোর্ট দেখে জন ও সামারকে ডক্টর জানায় অনাগত বাচ্চার ডাউন সিনড্রম আছে। এবং সে মানষিকভাবে অন্যান্য বাচ্চার মতো স্বাভাবিক হবে না। এই কথা শুনে সামার খুব ভেঙে পরে এবং এই বাচ্চা নেয়ার সিদ্ধান্ত বাদ দিয়ে দেয়। সামার ও জন ভানুকে বলে যে একটা ডিজেবল বাচ্চা তারা বড় করতে পারবে না এবং ভানুকে বলে মিমিকে এ্যাবরশন করার জন্য।
ভানুর থেকে এইসব শুনে মিমি ভীষন ভেঙে পরে এবং জন ও সামার এর সাথে কথা বলার জন্য হোটেলে চলে যায়।
বাইরে বোরকা ছাড়া প্রেগন্যান্ট অবস্থায় দেখে সবাই মিমিকে চিনে ফেলে। হোটেলে গিয়ে জানতে পারে যে জন ও সামার আমেরিকা চলে গেছে। এবং তাদের ফোন নম্বরও বন্ধ করে দিয়েছে।
মিমি যে প্রেগন্যান্ট এটা এলাকার সবার মাধ্যমে তার বাবা মা-ও জেনে ফেলে। বাড়িতে তুমুল বকাঝকা করার একপর্যায়ে বাচ্চার বাবা কে প্রশ্ন আসে। চাপের মুখে মিমি মিথ্যে বলে যে ভানু তার স্বামী এবং এই বাচ্চার বাবা। ভানুও ঘরজামাই হিসেবে মিমিদের বাড়িতে থাকতে শুরু করে।
বাচ্চা জন্ম নিলে পুরো এলাকায় সবাই ভানুকে হিরো বানিয়ে ফেলে। এতো ফর্সা বাচ্চা এলাকায় কারো হয়নি। ভানুর কাছে অনেকেই এতো ফর্সা বাচ্চা হওয়ার টিপস নিতে আসে, আর সে আবোল তাবোল উদ্ভট টিপস দিয়ে দেয়।
কিন্তু কয়েকমাস ধরে ভানু নিজের বাড়িতে না যাওয়ায় তার স্ত্রী ও মা রাজস্থানে তাকে খুজতে চলে আসে। এবং মিমির কথা, বাচ্চার কথা জানতে পারে। মিমির বাড়িতে ভানুর স্ত্রী ও মায়ের তুলকালাম কান্ডের মাঝে মিমি সত্য স্বীকার করে।
মিমির বাবা-মা বাচ্চাকে নিজেদের নাতি হিসেবেই মেনে নেয়। মিমি ছেলের নাম রাখে রাজ। নিঃসন্তান ভানুপ্রতাপ দম্পতিও মিমির ছেলে রাজকে নিজেদের সন্তানের মতো আদর করে এবং প্রতি মাসে রাজকে দেখতে রাজস্থানে ছুটে আসে। তালাক প্রাপ্ত দুঃখী শামাও রাজকে নিজের সন্তানের মতই আদর করে। তবে শেতাঙ্গ হওয়ায় অতি ফর্সা গায়ের রং ও সোনালী চুল নিয়ে অনেকেই রাজকে বুলিং করে। মিমি সমাজ ও মানুষের কথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজকে নিয়ে বাচতে শুরু করে। মাতৃত্ব মিমিকে বদলে দেয়, সে বলিউডের স্বপ্ন ভুলে এখন রাজকে নিয়েই স্বপ্ন দেখে।
সবকিছু যখন ঠিকঠাক চলছিলো, তখন চার বছর পর ফেসবুকে মিমি ও রাজের একটা ভিডিও দেখে জন ও সামার বুঝতে পারে রাজ এর ডাউন সিনড্রোম নেই, সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বাচ্চা। এবং সেই রিপোর্টটি ফলস পজেটিভ ছিলো। তারা ভারতে এসে রাজকে নিজেদের সন্তান হিসেবে দাবি করে। কিন্তু মিমি জন্মদাত্রী মা হিসেবে এবং ৪ বছর এতো সংগ্রাম করে রাজকে বড় করায় রাজের মা হিসেবে রাজকে নিজের কাছে রাখার দাবী করে। জন ও সামার আইনী লড়াইয়ের হুমকি দেয়। মিমির আইনজীবি জানায় জন ও সামারের সন্তানের সারোগেট মা হওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করায় আদালতে মিমির দাবি টিকবে না। ডিএনএ টেস্টেও জন পিতা হিসেবে প্রমানিত হবে। আর মামলা চালাতে অনেক টাকা ও সময় লাগবে। ভানু নিজের গাড়ি ও মিমির বাবা নিজেদের বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়।
ছবির শেষাংষে সুন্দর একটা ট্যুইস্ট আছে। শেষটুকু জানতে ছবিটি দেখুন। ভালো কাহিনীর ছবি। অভিনয়ও বেশ ভালো। এটি একটি মারাঠি সিনেমার রিমেক। বলিউডি চাকচিক্য, ভাড়ামি, ওভারএক্টিং নেই।
পঙ্কজ ত্রিপাঠীর অভিনয় দক্ষতা আমাকে আবারও মুগ্ধ করেছে। মুসলমান হিসেবে একজন হিন্দুর গুবলেট পাকিয়ে ফেলা, জোর করে ধরে নামাজ পড়তে নিয়ে যাওয়ার পর নামাজে গুবলেট করে ফেলা, বয়স লুকানো সহ বিভিন্ন কমেডি করে যেমন হাসিয়েছেন আবার আবেগঘন দৃশ্যেও সুন্দর অভিনয়ের পরিচয় দিয়েছেন।
ক্রীতি শ্যানন এই মুভিতে নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন। খুব সুন্দর অভিনয় করেছেন। কোন ওভারএক্টিং ছিলো না। মা হিসেবে আবেগ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। রাজস্থানি হিসেবে হয়তো পারফেক্ট মানাতে পারেননি, কিন্তু ভারতীয় না হলে এগুলো খুব একটা নজরে পরবে না।
ছবিটি ইউটিউবে দেখা যাবেঃ
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০২১ রাত ২:৪৩