প্রতি চার বছর পর পর যখন অলিম্পিক গেমস আরো স্পস্ট করে বললে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমস এর আয়োজন হয়, দেখা যায় আমেরিকা যুক্তরাস্ট্র, চীন, গ্রেট ব্রিটেন, রাশিয়ার মতো দেশগুলো ৩০-৪০ টা স্বর্ণ সহ প্রায় একশো মেডেল জিতে নেয়। অথচ আমাদের দেশ এবার দশমবারের মতো প্রতিযোগীতায় অংশ নিলেও একটা মেডেলও কখনো জিততে পারেনি। তাই প্রশ্ন এসে যায়, আমরা কেন অলিম্পিকে মেডেল পাই না? ১৮ কোটি মানুষের দেশে কি মেডেল জয় করার মতো এ্যাথলেট নেই?
এই প্রশ্নের উত্তরগুলো আমরা সবাই জানি, কিন্তু হজম করতে পারি না (কিংবা চাই না)। আমি শুধু পয়েন্টগুলো আবার মনে করিয়ে দিচ্ছিঃ
১) আমরা এ্যাথলেট কম পাঠাই
আমাদের স্বর্ণ জয়ের সম্ভাবনা খুবই কম থাকে, কারন আমরা খুবই কম সংখ্যক এ্যাথলেট পাঠাই। যেমনঃ
আমরা সিডনি অলিম্পিকস (২০০০) গেমস এ মাত্র ৪ জন, এথেন্স অলিম্পিকস (২০০৪) এ-ও ৪ জন, বেইজিং (২০০৮) এ ৫ জন, লন্ডন (২০১২) এ-ও ৫ জন, রিও (২০১৬) অলিম্পিকস এ ৭ জন এবং এবার টোকিও (২০২০) অলিম্পিকস এ ৬ জন প্রতিযোগী পাঠিয়েছি।
যেখানে আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, ব্রিটেন ৩০০-৬০০ এ্যাথলেট পাঠায়। এমনকি পাশের দেশ ভারতও এবার ১২৭ জন এ্যাথলেট পাঠিয়েছে।
স্বাভাবিক ভাবেই বোঝা যায়, এতো কম এ্যাথলেট পাঠিয়ে মেডেলের আশা করা মানে আম গাছে কাঠালের আশা করার সমান।
অবশ্য ব্যাপারটা এমন না যে আমরা ই্চ্ছা করে কম এ্যাথলেট পাঠাই। আসলে আমাদের দেশের এ্যাথলেটরা অলিম্পিকে অংশ নেয়ার নূন্যতম যোগ্যতাও পার করতে পারে না। অনেক সময় তো আমরা কোটায় (universality slots) এ্যাথলেট পাঠাই। এ্যাথেলটরা কেন নূন্যতম যোগ্যতা পার করতে পারে না, তা পরবর্তী পয়েণ্ট গুলো পড়লেই পরিস্কার হয়ে যাবে।
২) আমাদের এ্যাথলেটরা বিশ্বমানের সুযোগ সুবিধা পায় না
প্রায়শই নিউজে আসে, খেলোয়ারদের ক্যাম্প-ট্রেইনিংয়ের অব্যবস্থাপনার চিত্র। নিয়মিত ট্রেইনিং দেয়া হয় না, কোচ থাকে না, ক্রীড়া সামগ্রী ও পরিবহন সুবিধা থাকে না, এ্যাথলেটদের নার্সারিং করা হয় না।
আসলে আমাদের স্পোর্টস ফেডারেশনগুলো দূর্নীতির মহাযজ্ঞ চালায়। দেশে নিজেরা কোন স্পোর্টস ইভেন্ট তো আয়োজন করেই না, যখন ন্যাশনাল স্পোর্টস ইভেন্টগুলো আসে, এরা মেরে কেটে টাকা খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পরে। ফেডারেশনে পদ পেলেই এরা খুশি হয়ে যায়, "এবার তো টাকাই টাকা!"
৩) সরকারের সদিচ্ছার অভাব
খেলাধুলা নিয়ে আমাদের কোন সরকারেরই কখনো সদিচ্ছা ছিলো না। ফুটবলে অবনতি যেমন হয়েছে, অন্যান্য খেলাগুলোতেও আমরা আগাইতে পারি নাই। ক্রিকেটে যা উন্নতি হয়েছে তাতে সরকারের ভূমিকা সামান্যই, বিসিবি স্বাধীন স্বত্বা হিসেবেই কাজ করে। তবে সরকারের সহযোগীতা (অবকাঠামো উন্নয়ন, ঘরোয়া/প্রান্তিক পর্যায়ে টুর্নামেন্ট আয়োজন, রাজনৈতিক প্রভাব না খাটানো ইত্যাদি) থাকলে ক্রিকেটে আরো উন্নত করা সম্ভব।
আর ভারত ও আইসিসির অসহযোগীতা ও আপত্তির কারনে অলিম্পিকে ক্রিকেটের ইভেন্ট থাকছে না। তাই সরকার যদি এ্যাথলেটিক্সে একটু গুরুত্ব ও নজর দিতো, তবে মেডেলের আশা করার সাহস দেখানো যেত।
৪) স্কুলগুলোর অনাগ্রহ
আমাদের দেশের স্কুলে স্পোর্টস বা মিউজিক এর কোন সাবজেক্টই থাকে না। থাকার ভেতর নামকা ওয়াস্তে এক শারীরিক শিক্ষা আছে, সেটাও এখানে মুখস্থ বিদ্যার মতো পড়ানো হয়। পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হয়। বইতে ড্রিল, জিমন্যাস্টিকস, হাই জাম্প, লং জাম্প, সুইমিং, গোলক নিক্ষেপ, বর্শা নিক্ষেপ, স্প্রিন্ট এর মতো বিষয় থাকলেও এগুলো হাতে-কলমে, মাঠে করানো হয় না। এগুলো মুখস্থ করতে হয় এবং পরীক্ষায় চিত্র একে উত্তর লিখতে হয়। স্কুলগুলোর কোন স্পোর্টস টিম থাকে না। বাস্কেটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, হকি কোন টিম করা হয় না। প্রশাসন থেকে কখনো নিয়মিতভাবে স্কুল টূর্নামেন্টও আয়োজন করা হয় না। স্কুলগুলোতে এসব খেলার অস্তিত্ব টিকে আছে শুধু স্পোর্টস ডে তে।
৫) অভিভাবকদের অনাগ্রহ
আমাদের দেশের অভিভাবকেরা সন্তান জন্মানোর সাথে সাথে ঠিক করে ফেলেন ছেলে/মেয়ে বিসিএস ক্যাডার হয়ে ঘুষ খেয়ে দু-হাতে টাকা কামাবে, কিংবা ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার হবে। কেউ কখনো ছেলে/মেয়েকে স্পোর্টস ম্যান বানাতে চান না। উল্টো বিকালে খেলার মাঠ থেকে কান ধরে এনে কোচিং/টিউশনে পাঠান। খেলাধুলা মানেই সময় নষ্ট।
ভালো রেজাল্ট করে ভালো চাকরি করাই যেন জীবনের লক্ষ্য। ছেলে/মেয়ে রোবট হয়ে যাক, সোশ্যাল স্কিল নাই হয়ে যাক, ছেলে ক্যারেক্টারলেস সিম্প/ইভ টিজার হোক, মেয়ে বারোভাতারী/গোল্ড ডিগার হয়ে যাক কোন সমস্যা নেই, রেজাল্ট ভালো তো সন্তান তাদের সোনার টুকরো।
৬) অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
একেতো প্রতিনিয়ত ফরমালিন, কার্বাইড ও ভেজাল খাবার খেয়ে যাচ্ছি, তার উপরে আমাদের খাদ্যাভ্যাস মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত না। একজন এ্যাথলেট কখনোই এমন খাবার খেয়ে সেরাদের সেরা হতে পারে না।
৬) রক্ষনশীল সমাজ
আমাদের দেশের হিপোক্রেট রক্ষনশীল চিন্তাভাবনার কারনে অনেক অলিম্পিক ইভেন্টে মেয়েদের অংশ নেয়া সম্ভব না। Artistic swimming, Balance beam, Floor exercise, Uneven bars, Vault, Water polo এর মতো অনেকগুলো ইভেন্টে আমাদের মেয়েরা অংশ নিবে না (সমাজ নিতে দিবে না)
আমেরিকা/চীন কিভাবে এতো সফল?
অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশি মেডেল জয়ীদের তালিকায় আমেরিকা যুক্তরাস্ট্র এবং চীন সবসময় প্রথম তিনেই থাকে। কিন্তু কিভাবে?
কারন আমেরিকায় স্কুল-কলেজ গুলোতে স্পোর্টস এর উপর ভীষন গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রতিটা স্কুলে স্পোর্টস ক্যাটাগরিতে আলাদা আলাদা শিক্ষক (কোচ) থাকেন, স্পোর্টস এর বিষয়গুলোতে গ্রেড পাওয়া যায়, নিয়মিত টূর্নামেন্ট হয়।
এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকেই এ্যাথলেট হবার জন্য সময়, শ্রম ও টাকা-পয়সা খরচ করে। তাদের এসব বিষয়ে আলাদা স্কুল/ট্রেনিং সেন্টার আছে। যেহেতু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ধনী পরিবার আছে এবং তারা স্পোর্টস ও এ্যাথলেটিক্সকে অনেক গুরুত্ব দেয়, তাই বাবা-মা সন্তানকে স্পোর্টসম্যান বানাতে দু'বার ভাবেন না।।
চীনে সরকারিভাবে স্পোর্টস ও এ্যাথলেটিক্স এর উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। ন্যাশনাল ক্যাম্প, স্পোর্টস সেন্টার আছে যাতে এগ্রেসিভলি ট্রেনিং ও সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে। একদম ছোট বাচ্চা বয়স থেকেই এদেরকে রাস্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে তোলা হয়। চীন অলিম্পিক ও বিভিন্ন স্পোর্টস ইভেন্টে পদক জয় করাকে জাতীর গর্ব মনে করে। একটা পদক জয়ের জন্য যতকিছু করা সম্ভব, চীন সবটাই করে।
বেইজিং অলিম্পিকের জন্য চীন যেভাবে এ্যাথলেটদের গড়ে তুলেছে, যত রিসোর্স খরচ করেছে, সেটা চিন্তা করাও সম্ভব না।
পাশের দেশ ভারত অলিম্পিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তাদের এ্যাথলেট ও কনটেস্ট্যান্স প্রতিবারই বাড়ছে। তাদের স্কুল পর্যায়ে ও রাস্ট্রীয়ভাবেও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে ও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে (খুবই কম হলেও হচ্ছে)। ফলে ভারত এখন পদকও পাচ্ছে।
আমরা স্কুলগুলোতে খেলায় গুরুত্ব দিবো না, কারন আমরা জানি, খেলাধুলা করে বখাটে ও দুষ্ট ছেলেমেয়ে, কিন্তু "পড়ালেখা করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে"। আমরা শুধু জিপিএ ফাইভ ও গোল্ডেন এ প্লাস দিয়েই স্কুলের সাফল্য বিচার করবো।
আর সরকার খেলাধুলায় গুরুত্ব দিবে না, কারন টাকা নাই। সব টাকা এমপি মন্ত্রীরা কানাডায় বাড়ি করতে, লন্ডনে ছেলে মেয়েকে পড়াতে খরচ করেছেন এবং স্যুইস ব্যাংকে জমা করে রেখেছেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০২১ বিকাল ৪:৩৩