১) কক্সবাজার থেকে এয়ার টিকিট পাইনি, কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে পেয়েছিলাম। তাই একটা মাইক্রো ভাড়া করলাম, চট্টগ্রাম থেকে বিমান ছেড়ে যাওয়ার আগেই চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে পৌঁছে দিতে হবে এই শর্তে।
সকালে নাস্তা না খেয়েই রওয়ানা দিলাম চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। কক্সবাজার থেকে জ্যাম-ট্যাম ঠেলে বের হয়ে লোহাগাড়ার একটা হোটেলে মাইক্রোবাস দাঁড়া করালাম বাকীদের নাস্তা করার জন্য। আমি দ্রুত হালকা নাস্তা সেরে, পরিবারের বাকী সদস্যদেরকে নাস্তার টেবিলে বসিয়ে বের হলাম, একটা সিগারেট টানতে হবে।
মেইন রোডের পাশে ছোট্ট একটা মুদি দোকান টাইপ, সাথে চা-সিগারেটও চলে। বাকীদের নাস্তা সেরে বের হতে হতে আমার কাজ শেষ হয়ে যাবে। একটা সিগারেট ধরিয়ে একটা চায়ের অর্ডার দিলাম।
টং/মুদি দোকানের পাশে একটা ছোট ঘরের মতন, দোকান না, কম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা। হয়তো রাতে দোকানে থাকে কেউ, তাদের কাঁথা-কম্বল-বালিশও রাখা আছে।
সেখানে হাঁড়জিরজিরা একজন মধ্য বয়সী মহিলা আধশোয়া আধবসা অবস্থায়। পোষাক-আষাক দেখে ভিক্ষাবৃত্তিই পেশা স্পষ্ট। হাতে একটা পুটলীকে এমনভাবে ধরে আছে যেন সেখানে একটা বাচ্চা। কিন্তু বুঝতে পারা যাচ্ছে না সেখানে কোন বাচ্চা আছে কি-না।
একনজর তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে চা'য়ে ব্যস্ত হতে চাইলাম। কিন্তু চোখের কোণ দিয়ে খেয়াল করলাম মহিলাটা আমার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছে। আমি বিষয়টা বোঝার জন্য তার দিকে আবার ফিরে তাকালাম। আমি তাকাতেই মহিলা তার হাতের আংগুল দিয়ে আর চোখের ইশারায় আমাকে ডাকলো।
কি একটা ভীতিকর অবস্থা । আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। তার দুরত্ব আমার থেকে বেশী হলে ২/৩ হাত। সেখানে বসে নিঃশব্দে হেসে হেসে চোখের আর হাতের ইশারায় ডাকাটা ভয়ংকর ।
আমি হতভম্ব হয়ে লাফ দিয়ে হাতের চা ফেলে দিচ্ছিলাম প্রায়। আমার হকচকিয়ে যাওয়া দেখে দোকানীসহ দোকানে বসা স্থানীয় ৪/৫ জন লোক হো হো করে হেসে দিয়েছে। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই তারা বললো, আরে এ কিছু না, এটা পাগলী, কাছে ডাকতেছে না, টাকা চাইতেছে।
একটু বিরক্ত হয়ে মানিব্যাগ থেকে ৫ টাকা বের করে দিলাম।
কিন্তু ৫ টাকা দেয়ার সাথে সাথে তার চোখে মুখে কি একটা আনন্দ খেলে গেল। নিজ জায়গায় বসেই হাসতে হাসতে দোকানের সবাইকে দেখাতে লাগলো ৫ টাকার নোটটা। দেখলাম বুঝলাম মহিলা কথা বলতে পারে না। অথবা হয়তো কথা বলে না। বুঝলাম মানসিক ভারসাম্যও নেই। কিন্তু তার আনন্দ দেখে আমি বেকুব বনে গেছি। ৫ টাকাতেই এতো আনন্দ।
হাসি মুখের আনন্দের প্রকাশ আরও আনন্দ তৈরি করে। আমি আনন্দিত হলাম। হয়তো আরও আনন্দ দেখার জন্য মানিব্যাগ থেকে আরও ৫ টাকা বের করে দিলাম। পরের ৫ টাকার নোটটা পেয়ে মনে হলো সে ধনী হয়ে গেছে। নিঃশব্দে হেসে হেসে গড়িয়ে পড়েতেছে। হাতের পোটলাটা বুকে জড়িয়ে ধরে জায়গা থেকে উঠে দোকানের সবাইকে দেখাচ্ছে। পাঁচ টাকার নোট দুইটাও দেখাচ্ছে আবার আমাকেও আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে। ইশারায় বলা কথাগুলোতে দোকানে বসা লোকগুলো রেসপন্স করছিল, হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করছিলি এই টাকা দিয়ে কি করবি? শাড়ি কিনবি? পোলাও খাবি? ইত্যাদি, ইত্যাদি।
দুনিয়াতে ১০ টাকা পেয়ে কেউ এতো খুশী হতে পারে আমার ধারণাও ছিল না। কল্পনাও করতে পারিনি। আনন্দ দেখে কেমন যেন মায়া মায়া লাগতেছে।
এরমধ্যে পরিবারের সবাই নাস্তা সেরে মাইক্রোবাসে চড়ে বসেছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তাই মাইক্রোবাসের ড্রাইভার হর্ণ বাজিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। যেতে হবে আমাকেও।
কিন্তু মহিলার আনন্দিত মুখ আর উচ্ছসিত আচরণ আমাকে কিছুটা বিহ্বল করে দিয়েছিল। কি করব, কি করব, করতে করতেও কয়েক সেকেন্ড পার হয়ে গেছে। এরমধ্যে মানিব্যাগ আবার আমার হাতে চলে এসেছে, মাইক্রোবাসও হর্ণ দিচ্ছে, দোকানীও টাকা চাচ্ছে।। দোকানীকে টাকা দেয়ার পর হাতে থাকা আরেকটা ৫ টাকার নোট ঐ পাগলীর হাতে দিলাম। হাতে দিয়েই মাইক্রোবাসের দিকে হাঁটা দিলাম। যেতে যেতে পাগলীর অট্টহাসি শুনতে পাচ্ছি, তার অট্টহাসির সাথে দোকানে থাকা অন্য লোকগুলোও হাসতেছিল। মাইক্রোবাসে উঠে দোকানটার দিকে তাকিয়ে দেখি ঐ পাগলীটা দোকানের সামনে হাত পা ছুড়ে ধেই ধেই করে নাচা শুরু করে দিয়েছে। পরে আফসোস হয়েছে কেন এত কম টাকা দিলাম। আরও কিছু দিয়ে তার আনন্দ আরও বাড়াতে পারতাম ।
২) এক সন্ধ্যায় পুরানা পল্টনের এক রাস্তায় কোন একটা অফিসে কাজ শেষ করে ফুটপাতের উপরে থাকা ছোট ভ্যান টাইপ টং দোকানে চা-টা খাচ্ছিলাম। খুব কম টং দোকানে চা-সিগেরেটের সাথে পুরিও বিক্রি করে। ঐ দোকানে পুরির সাথে সাথে সিঙ্গারাও বিক্রি হয়।
আমি রিক্সা নেয়ার আগে কিছু সময় চা আর ধুমপানের অপকর্ম সারছিলাম। সন্ধ্যাও পার হয়ে গেছে, বিভিন্ন অফিস থেকে লোকজন বের হচ্ছে। আর যাচ্ছে কিছু দিনমজুর। তারা মনে হয় আজ আর কোন কাজ পাবে না, তাই বাসায় ফিরে যাচ্ছে ।
হঠাৎ একজন শক্ত সামর্থ্য দিনমজুর আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে খুব অনুনয় করে দুইটা পুরি খেতে চাইলো, বললো খুব খিদা পেয়েছে।
টাকার বদলে কেউ খেতে চাইলে তাকে খাওয়ানো উচিৎ বলেই মনে করি। টাকা চাইলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তাকে মাপতে হয়, বুঝতে হয় সে কি সত্যি সত্যি টাকার অভাবে আছে কি-না। চেহারার গড়ণ, মুখে মাংস আছে কি-না, ড্রেস আপ ইত্যাদি ইত্যাদি । কিন্তু কেউ খেতে চাইলে এসব দেখার দরকার পরে না। তবু শুধু অন্ধকারে খেয়াল করে দেখলাম তার পড়নে একটা শার্ট আছে। শক্ত সামর্থ্য শরীরও আছে। তবে চাইছে শুধু দুইটা পুরী মাত্র। যার একেকটা মাত্র তিন টাকা। কোন ব্যাপার না।
দোকানীকে বললাম দুইটা পুরী দিতে। লোকটা পুরী দুইটা গোগ্রাসে গিলা শুরু করলে মায়া হয়। নরম সুরে কাছে যেয়ে বললাম, আরো খেতে চাইলে নেন, সমস্যা নেই। কিন্তু লোকটা বললো আর খাবে না। আবার তার গোগ্রাসে খাওয়ার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে তার অনেক খিদা আছে। দোকানদারকে বললাম আরো দুইটা পুরী দিতে। কিন্তু লোকটা বাধা দিয়ে বললো, না না লাগবে না, আমি আর খাবো না।
কোনভাবেই আরো পুরী খাওয়াতে না পেরে বললাম, অন্য কিছু খাবেন? কিন্তু সে এবারও নেতিবাচক উত্তর দিলো। বললাম, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার খিদা মেটেনি। বললো, না ভাই, এই দুইটা পুরী খেয়ে দুই গ্লাস পানি খেলে আমি আরও ৬/৭ ঘন্টা আরামছে পার করতে পারবো। একথা বলে দুই গ্লাস পানি খেযে আমাকে দোয়া করে দিয়ে চলে গেলো। কয়টা টাকা দিতে চাইছিলাম, নেয়নি। কোনভাবেই নিল না। "৬ টাকা"
৩) দুইদিন আগের ঘটনা। অফিস থেকে বাসায় যেতে রাত হবে। তাই সন্ধ্যায় অফিস বিল্ডিং এর নীচে নামলাম। একটা দোকানে গরুর দুধের চা বিক্রি করে, আবার গুড়ের অপশনও আছে। গরুর দুধের আর গুড়ের চা, সেইরকম টেস্ট। মাঝে মাঝেই সেখানে চা-সিগেরেট খেতে যাওয়া হয়। তো সেদিন চা খাচ্ছিলাম আর ঘাড় গুজোঁ করে মোবাইলে ফেসবুকিং করছিলাম।
এসময় একটা ৮/৯ বছরের ছেলে এসে হাত পাতলো। হাতে কিসের একটা কাগজ যেন চোখের কোণে দেখলাম। কি যেন বললো, “ আমার মায়ের...” ভালো মতো খেয়াল করিনি। ফেসবুকিং করতে করতেই হাতের ইশারায় মাফ করতে বলে আবার ফেসবুকিং এ মনোযোগী হলাম।
এবার ছেলেটা আমার পাশে বসা আরেকজনের কাছে যেয়ে হাত পাতলো। হাতে ধরা কাগজটা দেখিয়ে যা বললো, তা শুনে আমি একটা কিক খেলাম।
এক্কেবারে হার্টের মধ্যে সজোরে একটা কিক । ঠিক এমনটা আশা করিনি। চট করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখি, কোন ভিক্ষুক না- অন্ততঃ ড্রেস আপে। হাতে ধরা একটা প্রেসক্রিপশন। আর খুব নীচু স্বরে ধীরে ধীরে বলছে “ আমার মায়ের জরায়ুর টিউমার ধরা পড়ছে, চিকিৎসার জন্য কিছু সাহায্য করেন।”
কিকটা হার্টের মধ্যে সজোরেই খাইছি। কিক খাওয়ার কারণ আছে। ভিক্ষা যাদের বৃত্তি, তারা সাধারণের কাছে অস্বস্তিকর কোন বিষয়কে পুঁজি করবে না। স্বাভাবিকভাবেই ঐ দোকানে বসা অন্যরাও তাই দান করার বদলে এভয়েডই করছিল।
ছেলেটার প্রেসক্রিপশনের দিকে তাকিয়েই ডানদিকে তাকিয়ে দেখি কালো বোরকা পরে তার মা দাঁড়িয়ে আছে। কালো নেকাবে মুখ ঢাকা। রোগ বালাই এ তার কোন দোষ না থাকলেও লজ্জা ঠিকই আছে। নিজে চাইতেও লজ্জা পায়, কিন্তু কতটুকু বাধ্য হয়ে সন্তানকে জনে জনে পাঠাচ্ছে চিকিৎসার টাকার জন্য। ভুলেই যেতে বসি আমরা যে চিকিৎসাও একটা মৌলিক অধিকার।
অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকা মা, নীচু স্বরে অসহায়ভাবে সাহায্য চাওয়া কচি মুখটা দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে, এরা সত্যি বিপদে পড়েছে।
এরকম কিক খাওয়ার জন্য অনেকদিনই অপেক্ষা করতে হয়। বাই চান্স যেন মিস না হয়ে যায়, তাই তাড়াতাড়ি মানিব্যাগ বের করে ১০০ টাকার একটা নোট ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ইশারায় বললাম যে যাও এবার অন্যদিকে খোঁজ। ছেলেটা টাকাটা হাতে নিযে একটু অবাক হয়ে একবার আমার দিকে একবার টাকাটার দিকে তাকালো। এরপর দৌড়ে মা এর কাছে ফিরে তাঁর হাতে টাকাটা দিলো। মহিলা টাকাটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলো। এরপর আমার দিকে একবার তাকিয়ে মনে হয় একটা ধন্যবাদ দিলো। তারপর ছেলেকে টেনে নিয়ে গেল অন্যদিকে।
চলে যাওয়ার পর পুরো বিষয়টা আবার ভেবে এবার হাত কামড়ানোর পালা আমার। আরো বেশী কিছু পাওনা ছিল তাদের। সবসময়ই এরকম মনে হয় আমার। প্রয়োজনের সময়ে কিপ্টামী করি। পরে হাত কামড়াই। এরকম সুযোগ পরে আর পাওয়া নাও যেতে পারে ।
কত কত শত সহস্র মানুষ কত অল্পতেই খুশী হয়। আর আমি হাজার হাজার টাকাতেও খুশী না ।
‘‘বিঃদ্রঃ ৫/১০/২০/৫০ টাকা কাউকে দেয়াকে দান খয়রাতের খাতায় ফেলে সত্যিকারের দান-খয়রাতের মতো বিশাল বিষয়কে অপমানিত করবেন না। এরচেয়ে বেশী টাকা আমি নিয়মিত পুড়িয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দেই।
মাঝে মাঝে কিছু লিখতে মন চাইলে যা মনে চায় তা লিখে ফেলি। উপরের লেখাগুলোর কোনটাই দান খয়রাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ না। বরং মানুষের অল্পতে খুশী হওয়ার চিত্রটা গুরুত্বপূর্ণ।”