একটা গল্প বলি (সূত্র: রেনেটো রোজাল্ডো, আফটার অব্জেক্টিভিজম, কালচার এন্ড ট্রুথ, ১৯৯৩):
ভদ্রলোকের নাম এ.আর. রেডক্লিফ ব্রাউন।গিয়েছেন আন্দামন দ্বীপুঞ্জে, ভারতের দক্ষিণ পূর্ব অংশে।ভদ্রলোক ওখানে একদল দ্বীপবাসীর সাথে থাকা শুরু করলেন যারা শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে।বসবাসের সাথে সাথে চলতে থাকে দ্বীপের অধিবাসীদের জীবানাচার নিয়ে ভদ্রলোকের লেখার কাজ। নানান কিছু লিখলেন তাদের সম্পর্কে।এক পর্যায়ে তিনি লিখলেন তাদের ‘ক্রন্দনাচার বা ক্রন্দনের সংস্কৃতি(Weeping Ritual)’ নামক একটি প্রবন্ধ।সেখানে তিনি লিখলেন, ‘সম্পর্কের বন্ধন এই দ্বীপেবাসীদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।যখন দুই বন্ধু বা আত্মীয় পরষ্পরের সাথে অনেকদিন পর মিলিত হয়, তাদের পারষ্পরিক বন্ধন যে এখনও অটুট 'তা প্রমান' করার জন্য তাদের একটি বিশেষ ক্রন্দন রীতির (Weeping rites) মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।এই রীতিতে তারা পরষ্পরকে সজোরে জড়িয়ে ধরে এবং এমন আবেগের একটা ‘ভান’ করে যেনো প্রচন্ড একটা আবেগ তাদের ‘তাড়িত’ করছে,।যেহেতু আবেগটাকে প্রশমিত করার একটা ‘জোর’ ‘প্রচেষ্টা’ তারা করতে থাকে, আবেগটা শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে প্রশমিত হয় বৈ কি এবং পরিশেষে চোখে কিছু জলকণাও দেখা দেয়’।
উপরের প্যারাটিতে একজন একটা ঘটনার বর্ণনা করেছেন, এবং সেটা অপনি, আমি এবং আম জনতা পড়ছে এবং পড়েছে।কিন্তু আমরা কী পড়ছি? বা আপনি কী পড়েছেন? যা পড়েছেন তাতে কি একবারও আপনার মনে হয়েছে যে ঘটনাটি দু’টি ব্যক্তির দীর্ঘ বিচ্ছেদের যবনিকার পর ‘মিলনের আনন্দাশ্রু’র বর্ণনা,(যেটা আমাদের দেশেও হয়ে থাকে)? অথচ ব্যাপারটি কিন্তু তাই।আমাদের গবেষক ভদ্রলোক ওই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটি দেখেননি।উনি তাই লিখেছেন যা তিনি দেখতে চেয়েছেন। অন্যভাবে বলা যায়, ঘটনাটি যা, তা তিনি দেখতে পারেননি/চাননি এবং তার এই না পারাটা/চাওয়াট পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে তার নিজস্ব মন গড়া কিছু শব্দে ‘প্রমান’, ‘ভান’, ‘জোর’ ‘প্রচেষ্টা’ ইত্যাদি। তাই তার বর্ণিত ঘটনাটি তার নিজস্ব মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গীর একটি আক্ষরিক বর্ণনা যেখানে সত্যিকারের ‘মিলনের আনন্দাশ্রু’র অস্তিত্ব নেই, সত্যিকারের স্বতষ্ফূর্ততার বর্ণনা নেই, আছে ভদ্রলোকের মন গড়া ‘জোর’, ‘ভান’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণ(ব্রাউন সাহেব বিশ্ব বরেণ্য গবেষকদের হাতে প্রবল বেগে মাইনাচ খেয়েছেন সে জন্য)।আমাদের বিয়ের আসরে মেয়েদের হাউমাউ কান্না দেখলে কি লিখতেন কে জানে (হয়তো বলতেন, হে ঈশ্বর, এরা অসভ্যের জাত, মেয়েটাকে জোর করে পিটিয়ে বিয়ে দিচ্ছে !!!)।
খ)এবার আরেকটি গল্প (সূত্র: রেনেটো রোজাল্ডো, আফটার অব্জেক্টিভিজম, কালচার এন্ড ট্রুথ, ১৯৯৩):
এই ভদ্রলোকের নাম হোরাস মিনারস।এই ভদ্রলোক উপরের ব্রাউন সাহেবের আর্টিক্যালটা পড়ে একটা ব্যাঙ্গাত্মক আর্টিক্যাল লিখলেন।তিনি লিখলেন ‘Body rituals of Nacirema’।বাংলা করলে বোধ হয় দাঁড়ায় ‘নাসিরেমাদের শারীরিক রীতি’? তো ভদ্রলোক নাসিরেমাদের শরীর রীতিটা বর্ণনা করলেন এভাবে, ‘‘প্রত্যহ সকালে এরা এক ধরনে শারিরিক কসরত করে।সে শারিরিক কসরতের অনেকটাই চলে তাদের মুখের ভেতর দিয়ে।এ কসরতটি করতে গিয়ে তারা একটি ছোট লাঠি হাতে নেয় এবং লাঠিটির মাথায় থাকে গৃহ পালিত শুকরের লোম সদৃশ এক গুচ্ছ সুঁচালো লোম।এই ছোট লাঠি ও এর মাথার সুঁচালো লোম গুলি এরা এক ধরনের জাদুকরী পাউডারের সাথে মিশিয়ে অনবরতা মুখের ভেতর দীর্ঘক্ষণ ধরে চালান করতে থাকে।’ তার এই রকম আজগুবি ব্যখ্যায় বলাই বাহুল্য সবাই হতবিহবল। তিনি যা বলেছেন তাতে কারও বোধগম্য হলোনা যে এই ‘Nacirema’ টা কারা আর এই রীতিটাই বা কিসের ধারক।তিনি ব্যাপারটিকে ভেঙ্গে দিলেন। Nacirema টাকে উল্টো করে পড়ুনতো কি হয় (American)!!! আর রীতির বর্ণনাটাকে ‘দাঁত মাজা’র সাথে মিলিয়ে দেখুনতো মেলে কি না? রীতিটা আর কিছুই নয় আমেরিকানদের প্রত্যহ সকালে ‘দাঁত মাজা’র বর্ণনা।
তার স্যাটায়ারিক লেখাটার মূল উদ্দেশ্যটা ছিলো একটা ব্যাপারকে বোধগম্য করে তোলা যে ব্রাউনের মতো সমাজের গবেষণায় আমরা যদি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ‘মূল’ জিনিসটাকে না ধরে, না বুঝে নিজেদের আবেগী রঙ ও রস দিয়ে বর্ণনা করি তাহলে American রা উল্টে Nacirema হয়ে যেতে পারে আর তাদের দাঁত মাজার রীতিটাও লাঠির মাথায় শুয়োরের সূঁচালো লোম এর সাথে পাউডার মাখানো শারিরিক কসরৎ হয়ে যেতে পারে।
তাই এই দেখার ব্যাপারটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।আমাদের দেখার মধ্যেই নিহিত আমাদের সামাজিক মতবাদ।ধর্তব্যের প্রশ্ন কোনটি:
১. ‘আমরা কি দেখতে চাই? Do we want to see?’
না কি
২. ‘আমরা কী দেখতে চাই? What we want to see?’
যদি আমরা প্রথমটার উত্তর খুজিঁ, আমাদের পথ অতি বন্ধুর।আর যদি দ্বিতীয়টার উত্তর খুজিঁ তাহলে আমরা পক্ষপাতের দোষে দুষ্ট কারন ‘দেখা’টাকে আমরা আমাদের নিজস্ব আদর্শগত দিক থেকে একটা ছাচেঁ ফেলে আমাদের মনমতো যা দেখতে চাইছি, তাই খুঁজছি, তাই দেখছি, না দেখাটাকে দেখছিনা, দেখতে চাইছিওনা।যা শুধু এক পাক্ষিক সামাজিক মতবাদ তৈরীতেই আমাদের সহায়তা করবে এবং আমাদের মধ্যে বিভাজনের সৃষ্টি করবে। প্রথম প্রশ্নটার উত্তরে বলেছি আমাদের পথ বন্ধুর।কেন? এবং কি ভাবে?
এবার একটু দেশী গল্প
নীচের ছবিটি দেখুন।দৈনিক আমার দেশ এ প্রকাশিত

ছবির নীচে লেখা আছে, ‘পার্বত্য চট্রগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী উপজাতীয় তরুনরা প্রশিক্ষণের মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে’।আচ্ছা কারও কাছে কি এই ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে যে নীচের সারির এই দুধের বাচ্চাগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী তরুণ?ওরা যখন ছবিটা ছাপালো ওদের কি একবারও মনে হলোনা যে মানুষের মনে সহজেই প্রশ্ন আসতে পারে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী তরুণেরা!! এমন ‘পোজ’ দিয়ে ছবি তুললো কেনো?
পাহাড়ে গোপন প্রশিক্ষণ চলছে কি চলছেনা, তার পক্ষে-বিপক্ষে আমার অবস্থান এখানে মূল আলোচনার বিষয় নয়।আমি মূল বিষয়টা যেটা উল্লেখ করতে চাচ্ছি সেটি হলো, মিডিয়া আমাদের কাছে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ‘নাসিরেমাদের বডি রিচ্যুয়াল’ বা ‘দ্বীপপুঞ্জবাসীদের মিলনের আনন্দাশ্রু’ টা কে নিজস্ব স্বার্থে, নিজেদের মনের রং এর মিশেল দিয়ে ব্যখ্যা করছে।আমরা সেই ব্যাখ্যা শুনছি বা দেখছি, আর ‘কী দেখতে চাই’ এর উত্তরের রসদ যে যার মতো জোগাড় করে মস্তিষ্ক প্রক্ষালন করছি পরবর্তী রাউন্ডে রিং এ নামার জন্য।
এবার আরেকটি দেশী গল্প
কয়েকদিন আগে প্রথম আলোতে প্রকাশিত এই রিপোর্টটি বোধ হয় সবাই পড়েছেন, ব্লগেও প্রকাশিত হয়েছে লিঙ্ক
রিপোর্টটির দ্বান্দ্বিক অংশ বিশেষ তুলে দিলাম:
ভূমি বিরোধ তৈরি করা: বাঘাইহাটে হামলা-পাল্টা হামলার কারণ হিসেবে ভূমি বিরোধের কথা বলা হলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই এলাকার ভূমি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকার মতো বিরোধ ছিল না, নেইও। কারণ, পার্বত্য চট্টগ্রামে আশির দশকে যখন বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের (সেটেলার) পাঠানো হয়, তখন বাঘাইহাট ও এর আশপাশে তেমন কোনো জনবসতি ছিল না। দুর্গম এলাকা বলে সেখানে বাঙালিদেরও পাঠানো হয়নি। ফলে আদিবাসীদের ব্যবহূত কিংবা দখলি ভূমিতে বাঙালিদের বসিয়ে দেওয়ার ফলে যে ভূমি বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামে সৃষ্টি হয়েছে, এখানে তা নেই-ই বলা যায়।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ২০০৬ সালে ওই স্থানের পার্শ্ববর্তী গঙ্গারামমুখ এলাকায় ৩২টি বাঙালি সেটেলার পরিবারকে বসতি স্থাপনের জন্য পাঠানো হয়। তখন থেকে সেখানকার ভূমি ব্যবহার নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে আদিবাসীদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন কয়েকটি আদিবাসী পরিবার অন্যত্র চলে গেলে তাদের ব্যবহূত জমিজমা বেহাত হয়। ওই ঘটনার দুই বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে এবারের হামলা হলো।
এখানে যেটা লক্ষণীয়, প্রথমে বলা হচ্ছে ‘খোঁজ নিয়ে জানা গেছে’ ভূমি নিয়ে পার্বত্য চট্রগ্রামের অন্যান্য এলাকার মতো বিরোধ এই অঞ্চলে ছিলোনা, ‘নেইও’।এখন কে এই খোঁজ নিলো (সম্ভবত, প্রথম অলোর রিপোর্টার), কোথায় নিলো, সেসবের কোন উল্লেখ নেই এবং তিনি বলছেন যে ‘ভূমি সংক্রান্ত কোন বিরোধ ছিলোনা এবং নেই’।অপর দিকে পরের প্যারাটিতেই ‘প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রগুলো’র ভাষ্য মতে ‘ভূমি বিরোধ’ এর চিত্রটা স্পষ্ট।এখানে সূত্র বলা হচ্ছে প্রশাসন ও স্থানীয় সোর্স এবং এরা কারা হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
এই যে একটি রিপোর্টে দু’টি পরষ্পর বিরোধী মারাত্মক অসংগতির চিত্র, এই অসংগতি আমাদের কি বলে? এর থেকে এই এরকম কোন চিত্র কি আমরা পাই যে ওখানে পরষ্পর বিরোধী দু’টি মতের সহাবস্থান ঘটেছে?এই দু’টি মতের কোনটি আমরা গ্রহণ করবো? দু’টি ঘটনা আবার ‘মিউচুয়ালী এক্সক্লুসীভ’।অর্থ্যাৎ,হয় ‘ভূমি বিরোধ আছে’ নয় ‘ভূমি বিরোধ নেই’।দু’টোই একসাথে হতে পারেনা। অর্থ্যাৎ ‘ভূমি বিরোধ’ এর উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি একই সঙ্গে দু’টোর সহাবস্থান সম্ভব নয়।এখন আমরা কোনটা গ্রহণ করবো? রিপোর্টটি এই ব্লগের বিভিন্ন আলোচনায় আলোচিত হয়েছে এবং একপাক্ষিক ভাবেই পোষ্ট লেখক তার পছন্দের অংশটুকু নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং আরেকবার আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন যে কিভাবে আমরা সংকটের বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর যুদ্ধে অনিয়মতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে একপেশে মতবাদের প্রজনন করছি।
পাহাড়ের সংকট নিয়ে মিডিয়ায়, ব্লগে, মন্তব্যে অনেক ঝড় বয়ে গিয়েছে।কিন্তু কোথায় যেনো আমাদের মাঝে একটা ফাঁক রয়ে গেছে।আমরা আর সব কিছুর মতো এই ইস্যুটিতেও বিভাজিত হয়ে পড়েছি।বিভাজিত হবার জন্যই যেন এই হতভাগা জাতির জন্ম।আর কর্পরেট বেনিয়ারা মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের এই বিভাজনে পর্যাপ্ত রসদ সরবরাহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।আমাদের এই বিভাজনের সংকট আমাদের জাতীয় সংকট, পাহাড়ের সংকট আমাদের জাতীয় সংকট।এ শুধু আংশিক একটি জনগোষ্ঠীর সংকট নয়।এই সত্যটাকে আমাদের সবার আগে উপলব্ধি করতে হবে।‘বিভাজনের সংকট’ ও ‘পাহাড়ের সংকট’ এই দুই সংকটকে জাতীয় সংকট হিসেবে দেখে, সংকটের সত্যটাকে উপলব্ধি করে সবার আগে আমাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গীটাকে নির্ধারন করতে হবে, যাতে লক্ষ্য থাকবে ‘কান্নার রীতি’ নয় ‘মিলনের আনন্দাশ্রু’টাকেই যেন আমরা অনুধাবন করতে পারি।এই সংকটের যুদ্ধে সবাই দু’চোখ দিয়েই দেখুক।সবার প্রতি এই কামনাই রইলো।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১০ সকাল ৮:১৩