somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অচিনপুরের পথে হুমায়ুন আর এই আমি.........

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




স্মৃতি কখনো কখনও মানুষকে কাঁদায়, কখনও করে বেদনার্ত। আমি কাঁদতে পারিনা। এইটা আমার জন্মগত সমস্যা। প্রচন্ড কষ্টে বুক ফেটে যায়, তবু কান্না আসেনা। আর বেদনার্ত হবার মত সময় কোথায় আজকাল ? তবু কিছু স্মৃতি আজও বড় মধুর, বড় শোকের। আর তার মধ্যে আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টেরটি হল হুমায়ুন আহমেদ ও তাঁর জীবন-সংশ্লিষ্ট। ভাবতে খুব খারাপ লাগছে হুমায়ুন মারা গেছেন ৩০ ঘন্টাও অতিক্রান্ত হয়েছে কিনা জানিনা, অথচ আজ আমি তাঁকে স্মৃতির পাতায় ঠাঁই দিয়ে ফেলেছি, যেন মানুষটা বেঁচে ছিলেন স্বল্প সময়ের জন্য, শুধু স্মৃতির পাতায় অম্লান হবার জন্য...... রবীন্দ্রনাথের সেই প্রিয় কবিতার লাইনের মত, "মহাকাল আমার কাজ লইয়া যায়, আমাকে লয় না।"

হুমায়ুনকে নিয়ে আমার স্মৃতিকথন কখনো শেষ হবেনা, তবু কিছু ব্যর্থ প্রয়াস !

আমার হুমায়ুনের পড়া খুব প্রিয় উপন্যাসটি হল 'অচিনপুর' ! আমার যখন প্রচন্ড খারাপ লাগে, মন খারাপ থাকে তখন আমি অচিনপুর পড়তাম। হৃদয়ের ভিতরে কোন গভীর থেকে মানুষের সবচেয়ে বড় ব্যথাটা বের করে আনতে হবে, আবেগে ছিন্নভিন্ন করে দিতে হবে মানুষটার পরিচিত জগত, হুমায়ুন তা খুব ভাল করে জানতেন। আর এভাবেই তিনি আমাকে তাঁর অন্যতম একজন পাঠক হিসেবে দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলেন। আমি নিজেও জানতাম না, কখন থেকে আমি শুধু তাঁর বইয়ের উপর নির্ভর করে আছি, বাংলা গল্পের রস আস্বাদনের জন্য। আমি অন্য অনেক কিছু পড়তাম, অনেক ইতিহাস, অনেক কিছু, তবু ওনার প্রতি ব্যাকুলতা ছিল অন্য রকম, মনে হত এই মানুষটা হয়ত অন্য গ্রহের। অচিনপুরের মত লেখা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে একদিন নিজেই যে অচিনপুরের পথে যাত্রা করবেন তিনি, তাও এত তাড়াতাড়ি তা কখনো বুঝিনি।

কেউ বলেন লেখা, কেউ বলেন গল্প বলার ভঙ্গি, আমি বলি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী, তাঁর নিজের জীবন। এগুলোই কি তাঁর লেখার চেয়ে বেশী উপভোগ্য নয় ? অন্যরকম নয় ? আর কোন লেখক কি এমন অপূর্ব ভঙ্গিতে বাংলাদেশের প্রবাসী মানুষের হৃদয়ের রক্তক্ষরণের ছবি এঁকেছেন নিজের দেখা অভিজ্ঞতা থেকে ? যেই মানুষগুলোর পকেটে থাকে বাংলাদেশ নামের একটি রুমাল, যা তাঁরা মাঝে মাঝে বের করে দেখে, তাতে মাঝে মাঝে চোখ মোছে। আর কোন লেখক কি পেরেছেন নিজের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ সাধারন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ? নাটকের চরিত্রের জন্য আবেগের সৃষ্টি করে মানুষকে তাঁরই বিরুদ্ধে মিছিল করাতে ? যে মিছিলে তাঁর প্রতি বিদ্বেষের চেয়ে মিশ্রিত ছিল বড় বেশী আকুতি, বাঙ্গালীর প্রানের আকুতি।

জ্যোৎস্নার আলো খাওয়ার যে দৃশ্য আমরা তাঁর নাটকে দেখতাম এইগুলো কিন্তু তাঁর ব্যক্তিজীবনের প্রতিচ্ছবি, আলাউদ্দিনের জোছনা খাওয়া দেখেই তাঁর এই আবেগের তাড়না। তাঁর নিজের দেখা সেই মরুভুমির জ্যোৎস্নার বর্ণনা পড়েই শিহরিত হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম সত্যি এমন সৌন্দর্য এই ধরার নয়, এমন অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া তাঁর হাত ধরেই, আর সেখান থেকেই শিখেছিলাম তিনি নিজেও ঐ রকম, তাঁর গল্পের চরিত্রের মতই পাগলা, এগুলো কোন আলাদা বিষয় নয়।

তাঁর নাটক নয়, নাটকের জন্য যে অপার শ্রম, কষ্ট তাঁকে করতে হয়েছে, তা-ই আমাকে মুগ্ধ করত বেশী।

এইসব দিনরাত্রি, অয়োময়, আজ রবিবার, কত্ত না নাটক ছিল তাঁর ! কিন্তু সব মানুষ কি জানে কত কষ্টে আর্টিস্টদের সঙ্গে নিয়ে একেকটি নাটক দাঁড় করাতেন হুমায়ুন ? ঐ প্রতিভা সবার হয় না।

আমি অনেক দিন কাটিয়েছি তাঁর পরিবারের মানুষ আর তাঁকে নিয়ে কাজ করে। এরকম অবাক করা জীবন মানুষের হয় কিনা আমি জানিনা, হয়ত হয়। তবে প্রকৃতি তাঁকে অন্যরকম করে সাজিয়েছিলেন, এই অনুভূতি কতটা অন্যরকম তা বলে বোঝাতে পারব না। আমি আজও মানুষকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিয়ে গেলে হুমায়ুন, তাঁর বাবা, ভাই আর পরিবারের ছবিটা দেখাই। বাংলাদেশ নামটাই যে তাঁর জীবনের সঙ্গে জড়িত একেবারে শুরু থেকে।

তাঁর আগুনের পরশমনি, যার ছোঁয়ায় দীর্ঘদিন পর দর্শক হৃদয় ভিজেছিল মুক্তিযুদ্ধের আবেগে--আমার জীবন ওলট-পালট করে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার ব্যাপক আগ্রহ তার পর থেকেই। আর তাঁর জোছনা ও জননীর গল্প----- হয়ত মুক্তিযুদ্ধের পরিপূর্ণ উপন্যাস হয়নি, তবু ৩০ লক্ষ প্রানের যে দাবি ছিল হুমায়ুনের কাছে তা মিটাতে পেরেছে। তিনি তো সেই ব্যক্তি যিনি পাক-বাহিনীর হাত থেকে মরতে মরতে ফিরে এসেছিলেন। ৭১-এ মুহসীন হলের নিজের রুমে খুলেছিলেন ‘বিসমিল্লাহ হোটেল’ ! কত না স্মৃতি ! মনের কোণে আজ সবই ছিল লুকায়িত, তাঁর চলে যাওয়ায় আজ যেন সব চোখের সামনে ভাসছে।

আমি অনেক বিষয়েই তাঁর বিরোধী ছিলাম, বিশেষত শেষ জীবনে লেখালেখির একটি ভিন্ন ধারা তিনি অনুসরন করছিলেন, যা আমার ভাল লাগেনি। ভাল লাগেনি তাঁর ব্যক্তি জীবনের কিছু স্থূল বিষয়, আর তাঁর দেয়াল উপন্যাসের আঙ্গিকও। তবু জানতাম এই মানুষটাকে উপেক্ষা করে চলা সম্ভব না। আমি যে তাঁকেই দেখতাম, তাঁর লেখালেখি নয়।

সেই সব বিষয়গুলি আজ থাক। ওইগুলো নিয়ে গলাবাজী সারা জীবন করতে পারব, আমি জানি, আমার পক্ষে লজিক আছে, কিন্তু লজিক যার সাথে দেখাব সেই মানুষটাই যে আজ নেই। কার কাছে আমি বলব এই হৃদয়ব্যথা ? কেউ কি বুঝবে ? বুঝবে না।

পিএইচডি শেষ করে হুমায়ুন যখন দেশে ফিরে আসছিলেন তখন তাঁর প্রফেসর বলেছিলেন, হুমায়ুন ভাল থেক, আগলি আমেরিকানদের মনে রেখ। আমি ভাবছি, বিদায়বেলায় হুমায়ুন কি মনে রাখবেন এই আগলি বাংলাদেশীদের ?

নিশ্চয়ই রাখবেন। ভালবাসার প্রতিদান তাঁর চেয়ে ভাল করে আর কেউ কি দিতে পেরেছে ?

আজ থেকে আরও অনেক বছর পর হয়ত আমি মারা যাব। হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই মারা যাব। তবু যতদিন পৃথিবীতে আছি, আমি রাতের ল্যাম্পপোস্টের আলোয়, কুয়াশার চাদরে, বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের মাঝে আর অবিমিশ্র জ্যোৎস্নার আলোয় হুমায়ুনকে খুঁজব। প্রতিটা মানুষ তাঁর জন্য অপেক্ষা করেছে কিনা আমি জানি না। তাঁরা সবাই আজ আপ্লুত, কেউ হিমুর জন্য, কেউ রূপার জন্য, কেউবা মিসির আলীর জন্য, কিংবা বাকের ভাইয়ের জন্য। আর আমার সীমাহিন কষ্ট শুধু তাদের স্রষ্টার জন্য, শুধু মানুষটার জন্য।

শুধু তাঁর জন্য আমি অপেক্ষা করেছিলাম, যেন ফিরে এলেই চান্নিপসর কোন "রাইতে" নুহাশ পল্লীর গাছঘরে বসে তাঁর সাথে দেয়াল নিয়ে ঝগড়া করতে পারি। তর্ক করতে পারি তাঁর জী্বনদর্শন নিয়ে। আমি শুধু মানুষটাকেই ভালবেসেছিলাম, তাঁর সৃষ্টিকে নয়, আজ সেটা বুঝতে পারছি তাঁর প্রস্থানের পর। কিন্তু এই বোঝার মূল্য যে অনেক বেশী দিতে হল আমাকে !

সামনে যখন আকাশ কালো করে মেঘ করবে, আমি আমার প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজব, তখনও আমার বিষন্ন মনে বেজে উঠবে একটি গানের লাইন, যা শুধু তাঁর স্মৃতির জন্যই তাড়িত করবে আমায়......... "তুমি যদি দেখা না দাও, কর আমায় হেলা, কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল বেলা ?"

কোন কোন রাতে অপূর্ব জোছনা হবে। আমি হয়ত আমার ক্যামেরা হাতে স্বর্গীয় ঐ আলো ফ্রেম বন্দী করতে যাব। সেই ঘোর লাগা রাতেও আমার পাশে হয়ত আপনি থাকবেন, গভীর আনন্দে আমার কর্মকান্ড লক্ষ্য করবেন। অথবা আপনি না থাকলেও আমি আপনাকে খুঁজে ফিরব। একদিন আপনার সংগ পেয়ে আজ যেমন নিঃসঙ্গতায় ভুগছি।

হুমায়ুন বড় অভিমানী ছিলেন। নিজের চাওয়া সবসময় পূরণ করতে চেয়েছেন। কখনো হয়েছে কখনও হয়নি। তবু তিনি আমাদের সবাইকে অপূর্ণতায় ভরিয়ে রেখে অচিনপুরের পথে যাত্রা করলেন। আমি তাঁকে বোধহয় কখনো ভালভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি, আমি জানি অনেকেই পারেন নি। হুমায়ুনের মনে তার জন্য ক্ষোভ নেই। তবে আমাদের আরও অনেক কিছু দিতে চেয়েছিলেন, আমরাও অপেক্ষায় ছিলাম তাঁর জন্য। তাই জানি তার মনে অভিমান, আমাদের উপর অভিমান, এই দেশের মানুষের উপর অভিমান।

মাফ করবেন না আমায় জানি। তবু যাবার বেলায় হুমায়ুন আপনি কাঁদবেন না প্লিজ…………!
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×