'ঘাপলা' শব্দটার সাথে প্রথম পরিচয় আমার গাইবান্ধার পলাশবাড়িতে। একঝাঁক মুক্তমনা তরুন যখন ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়নে কাজ করছে, সদ্য শেখা কম্পিউটার জ্ঞানকে সম্বল করে।
পাইলট প্রজেক্ট শেষ। আমি তখন রীতিমত স্টুডেন্ট। নতুন কম্পিউটর নিয়েছি। গেম খেলি, ছবি দেখি, গান শুনি ইচ্ছেমতন। ইচ্ছে হল, দেখিই না কী হয়! আর কিছু না হোক টু-পাইস ইনকাম ত হবে!
একটা লিংক পেয়ে গেলাম। তিন মাসের প্রজেক্ট। ল্যাবটব অপারেট করতে হবে প্রথমটায়। তারপর কাজ ভাল করলে টিম লিডার। সরাসরি প্রমোশন? নো চান্স। এসব খোঁজ মোবাইলেই।
এরপর এক বিকেলে বেড়িয়ে পড়া। রংপুর গাইবান্ধা দুরত্ব, হস্তরেখাসম।
পরদিন।
লম্বা লাইন। ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে বাছাই করে নেয়া হবে।
রুমে ডেকে নিয়ে কী করছে? এত দেরী! যাচ্ছেতাই শব্দগুলোর উপর দিয়ে আমার ভাজ করা ঠোট আর জিভ আলতো ঘুরে এলো একবার। ধুর! কী কুক্ষনেই না এলাম! শালা মাথায় কী না কী ভর করল- আর অমনি ছুটে এলাম! চলেই যাব নাকি! পরক্ষনেই মনে হল, নাহ! এসেই যখন পড়েছি, ফিরে গিয়ে আর কাজ নেই। দেখি, ধৈর্য্য টেকে কতক্ষণ!
ইন্টারভিউয়ে এলাম সবার শেষে। প্রশ্নকর্তা আমার দিকে একবার চেয়ে দেখলেন। জিগেস করলেন, বাইরে আর কতজন? বললাম- আমিই শেষ।
তখন বেলা গড়িয়ে এসেছে। উনি হাই তুলতে তুলতেই আমার পরিচয় পর্বটা সেরে নিলেন। আমি যেই লিংক ধরে এখানে এলাম তার ইশারাতেই কীনা উনি একপ্রকার নিঃসন্দেহ হলেন- আমার ওপর নির্ভর করা যায়।
আমাকে তবুও ফর্মাল কিছু করতে হবে। এই যেমন, টাইপিং স্পীডটা কেমন এই যা।
আমাকে একটা ফাইল ওপেন করে বাংলা-ইংরেজী মিশেল কিছু একটা টাইপ করতে দিয়ে উনি বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। আমার মতই হয়ত হাঁপিয়ে উঠেছেন এতক্ষনে। রিফ্রেশ হতে গেলেন।
আমি রুমে ঢুকে প্রথমেই একটা জিনিস দেখে ফেলেছিলাম। উনি একটা ডকুমেন্ট সেইভ করে রাখছেন কোথাও।
আমি এই প্রথম একটা ট্রায়াল অভিযান চালালাম। 'রান'এ গিয়ে রিসেন্ট লিখে এন্টার! আরেব্বা! এতো দেখি----!
একটা একটা করে ফাইল ঘাটছি। আর আবিষ্কারের উত্তেজনায় কাঁপছি। দেখছি কে কেমন পরীক্ষা দিলো। অনৈতিক এ ধরনের কাজের জন্য তিনি আমাকে হয়তো কিছু করবেন না, তবে যার ভরসায় তিনি আমার উপর নিঃসন্দেহে ফ্রেশ হতে গেলেন আমাকে একা রেখে, তাকে হয়ত জাতে নেবেন। নিতান্ত বিনম্র হলে ক্ষোভটা ঝাড়বেন ভদ্রভাষায়।
একটা সুবিধেমতন মোটাতাজা ফাইলের পরীক্ষার্থীর লেখায় 'কন্ট্রোল এ'। তারপর 'কন্ট্রোল সি'। ব্যাস! কাহিনি খতম! এরপর ফিরে এলাম নিজের ফাইলে। বগের পা ফেলার মত আঙ্গুল চালাচ্ছি। এতক্ষনে উনি এলেন বলে।
আর দেরি করলাম না। 'কন্ট্রোল ভি'। আমার শেষ পেরেক, ঠুকে দিলাম ঠাসঠাস।
উনি বললেন, সময় শেষ!
আমি বললাম, আমারও শেষ প্রায়।
উঠে পড়লাম। বললাম, আসি তবে-ধন্যবাদ।
এই নিয়ে পরে হাসাহাসি। আমার কপি-পেষ্ট মিশন। কে একজন বলে উঠল 'ঘাপলা'!
ঘাপলা শব্দটার আবিধানিক অর্থ কী?
প্রতারণা? অথবা জালিয়াতি?
একটু রুঢ় শোনায় কেমন জানি। আর একটু সফট কিছু হলে মানিয়ে যেত বোধহয়।
ফাঁক?
হবে হয়তোবা।
কোনো একটা কিছুতে একটু ফাঁকিবাজির অপকৌশল অবলম্বনকে 'ঘাপলা' বলে চালিয়ে দেয়া যেতে পারে।
ত, আসল কথায় আসি।
সিনেমা বাজারে নতুন ছবি এলে আর সবাই মেতে উঠে গল্প কাহিনীতে। শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে আসে। অনীহা তৈরি হয় অজান্তেই। ফলশ্রুতি এই দাড়ায়, ঐ জমজমাট ছবিটা আর দেখাই হয় না শেষ পর্যন্ত। পরে একসময় ফাঁকজোকে যদি দেখার সুযোগ মেলে তবে দেখে নিই অবসরে।
সবাই ফেইসবুক আর ব্লগ নিয়ে এমন মেতেছে যে, আমার দিনকেদিন এই ব্যাপারগুলো একটা নিছক হেয়ালির মতই মনে হল। আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম, ওদিকে তাঁকানোর আগেই। দীর্ঘদিন ফেইসবুক আইডি-ই ওপেন করলাম না। না দেখলাম ব্লগারন্য।
একদিন ঐ না দেখা ছবি দেখে নেয়ার মত করেই কীনা ফেইসবুকে ঢু মারলাম। পরিচিত জনা কয়েক ফ্রেন্ড লিস্টে অ্যাড করলাম। আমার ওয়াল ভরে উঠল তাদের আপলোডকৃত ছবিতে ছবিতে।
আমিও আপলোডাইলাম। বসে রই, লাইক কমেন্টের সংখ্যা গোনার চেষ্টা করি। ফলাফল হতাশাজনক!
লাইকের তাৎপর্য তখনও তেমন একটা বুঝি না। তবে এটুক চট করেই বুঝে গেলাম, কিছু কিছু পেইজের অ্যাডমিন আছে যারা লাইক ভিক্ষায় যতরকম ফন্দিফিকির আছে স-ব অ্যাপ্লাই করে।
কিছু কিছু ভাললাগা শুরু হয়ে গেল। এমন কিছু ভাললাগা, যাদের আমি সঠিক চিনি না। হয়ত আমার পরিচিত কোনো ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ড লিস্টে আছে। আমার সেই ফ্রেন্ড-এর 'লাইকের' সুবাদেই তার লেখাজোকা আমার ওয়াল অব্দি পৌছাচ্ছে হয়ত। আমি সরাসরি তাকে একখানা রিকোয়েস্ট পাঠালাম।
একদিন দুইদিন তিনদিন। এইভাবে অনেক দিন। ফেন্ড রিকোয়েস্ট ক্যানসেল করে আবার উপরি রিকোয়েস্ট পাঠালাম। কিন্তু নাহ! বান্দা অনড়। আমার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপই যেন নেই তার! সাবস্ক্রাইব করে দেখলাম তার অগনিত বন্ধু। শেষে মেসেজ পাঠালাম। এবারে কাজ হল।
সে পস্ট ভাষায় জানিয়ে দিল, বেশিরভাগ মানুষ তাকে গালাগালি করে বিধায় সে বেছে বেছে অ্যাড করে। আমার মত আরও হাজার খানেক রিকোয়েস্ট নাকি ঝুলা খাইতেছে তার ব্যানারে!
আত্মসম্মানবোধে বিঁধে গেল ব্যাপারটা। জেদ চেপে গেল মনের মধ্যে। আবার মেসেজ করলাম। প্রতিউত্তর এলো। জানলাম, উনি বিশেষ গুরুত্ব দেন ব্লগ থেকে আসা ফেসবুকিদের। আমি কোনো ব্লগে লিখিনা। আর আমার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড মাত্র একজন, তাও সে সদ্য অ্যাডেড।
'মিউচুয়াল' ব্যাপারটা তখনও বুঝতাম না। কি করলে মিউচুয়াল হওয়া যায় তাও জানিনা। অতএব শেষ ভরসা- ব্লগ।
কী মনে করে এ্যাড্রেসবারে ব্লগস্পট ডট কম লিখে এন্টার দিলাম। যে পেইজটা এল তাতে সাইন ইন করতে বলে। আমার ইয়াহু আইডি দিলাম, সাথে পাসওয়ার্ড। বোকার মত কাজ করেছি যে তা একটু বাদেই বুঝলাম। ফলাফল, ফেইল মারল আমার লগ ইন।
ব্লগের খোঁজে কিছুক্ষন এদিক সেদিক ঘুরলাম। যেখানেই গেলাম, দেখি খালি ইংলিশ আর ইংলিশ। নাহ! পোষায় না কিছুতেই। আমার চাই বাংলা। যেখানটায় আমি লিখতে পারব আমার মনের স-ব, আমার ভাষায়, আমার নিজের মত করে। ভাষার দূর্ভেদ্যতা আমাকে আটকে রাখবেনা এতটুকুও। যা মনে আসে তাই যেন প্রকাশ পায় ঠিক ঠিক।
ফিরে এলাম ফেইসবুকে। আমার কিছু বন্ধুদের দেখি এটাসেটা শেয়ার করে। একদিন বড় করে 'না' লেখা দেখে ঢুকে পড়েছি কেবল। দেখি, নাগরিকব্লগ। এইত সেই বাংলা ব্লগ!
এতদিনে এটাই ত খুঁজেছি! লেখাজোকা পড়লাম কিছু। বেশ লাগল। এবার নাগরিক হতে চাই, নগরদ্বার ঘুরে আসুন -এসব দেখতে দেখতে কালো হয়ে এলো চারপাশ। হঠাৎ বিদ্যুৎবিভ্রাটেই আমার নাগরিক হওয়া হয়ে উঠল না আর।
এরপর আবার ফেইসবুকে যখন বসলাম, বড় করে 'স' লেখা দেখে যথারীতি ক্লিক। সচলায়তন। এটাও বাংলা ব্লগ সাইট। ইয়াহু আইডি দিয়ে ট্রাই মেরে রীতিমত গলদঘর্ম। শেষে চিন্তা করলাম একটা জিমেইল আইডি ওপেন করে ওটা দিয়ে ট্রাই মেরে দেখি ত একবার!
খালি হাতেই ফিরে এলাম। জিমেইল এ্যাকাউন্ট খুলে নিলাম ধাপাধাপ। তারপর ফেইসবুকে এসে দেখি কেউ একজন শেয়ার করেছে একটা লেখা। কি নিয়ে লেখা মনে নেই, তবে মুল উদ্দেশ্য ছিল আই ডি-টা ওপেন করা। 'বাধ ভাঙ্গার আওয়াজ' লেখাটায় চোখ আটকে গেল একটুক্ষন। এরপর আর দেরি নয়। লেগে গেলাম কাজে। আইডি ওপেন করার সময় জিমেইল অ্যাড্রেসটি যথারীতি কপি পেষ্ট। ব্যাস! আইডি ওপেন!
এখন আর আমায় লগ ইন করার সময় কীবোর্ড চাপতে হয় না, অ্যাড অন ম্যানেজারই সে দায়িত্বটা নিয়েছে- সে'ই মনে রাখে ওসব! সুক্ষ্ম ঘাপলা!
লগ ইন করে হতাশ! অন্যের লেখায় কমেন্ট করতে পারছি না। শর্ত জুড়ে দেয়া আছে যে! কমপক্ষে সাত দিন, অথবা তারও বেশি! সয়ে নিলাম, যা আছে-। এবং সেই সাথে একটা লেখাও জুড়ে দিতে গিয়ে দেখলাম আমার অভ্র ইনস্টল করা নেই। বাংলা লিখতে পারছি না। খোজ লাগালাম অভ্রের। পেয়েও গেলাম। ইনস্টল করে নিলাম। আর সেই সাথে মনে পড়ল ইউনিজয়কে। ভোটার তালিকা তৈরির সময় ইউনিজয়ে কাজ করে করে একটা অভ্যেস গড়ে উঠেছিল। সেই অভ্যাসটা আবার বিজয়ে ফিরিয়ে আনতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। এবার আবার ইউনিজয়ে ফিরে এলাম। অনেকদিন ধরেই মনে মনে খুঁজছিলাম একে।
ফেইসবুকে বেশিরভাগই ইমেজ আপলোডায়। স্ট্যাটাসিয়ান হতে একটু সময় নেয়। স্ট্যাটাসের মজাটা দেরিতে আসে বোধহয়!
ফেইসবুকে আর সবাই বাংলা লিখত। নানারকম স্ট্যাটাস দিত। আমার ইউনিজয় ছিল না বলে এতদিন স্ট্যাটাসিয়ান হয়ে ওঠা হয়নি। কমেন্টগুলো লিখতে হত ইংরেজি ফ্রন্টে বাংলা ভাষায়। কী এক অদ্ভুত মিশেল! যাক, এতদিনে মুক্তি এলো তাহলে!
ইউনিভার্সিটি ছুটিতে মেজ চাচা যখন বাড়ি ফিরত, তখন বাড়িটা আর বাড়ি থাকত না। পুরোনো আমলের নষ্ট রেডিওটা আবার বেজে উঠত। গুলতিতে পাথরের পরিবর্তে মার্বেল উঠত। একবার মেজ চাচা সাথে আনলো ক্যাসেট প্লেয়ার। আর সেই সাথে ধ্রিধধ্রিম দুটা ইয়া বড় স্পিকার। বাবার রিনরিনে ক্যাসেট প্লেয়ারে বেজে ওঠা 'গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গা মাটির পথ' আমি ভুলে গেলাম ক্ষনিকেই। চাচা বলল, এই শোন-
আমি শুনলাম, রবি চৌধুরির 'পাগল মন','সবটুকু কেড়ে নাও-ভালবাসা কেড়ে নিও না' কিংবা খালিদ হাসান অথবা তপন চৌধুরীর ব্যান্ড ধ্রিধধ্রিম। সেই সাথে আমি হিন্দি গানের কলিতেও একটু একটু ঠোট আওড়াই, নিজের অজান্তেই।
এরপর নচিকেতা এলো। ২৪৪১১৩৯ এলো। আমার মুগ্ধতা ছড়িয়ে যায় দিনকেদিন। এবি(আইয়ুব বাচ্চু)-জেমস-হাসান-কানিজ-বিপ্লব-বাপ্পা-প্রিতম----শায়ান, আরও আর-ও অনেকে। ধীরে ধীরে ব্যান্ড এর প্রতি আমার উৎসাহটা কমতে থাকে একটু একটু করে। একটু শান্ত ধারার গান শোনার আগ্রহ বেড়ে চলে। আমি আবার একদিন মনের অজান্তেই বাজিয়ে শুনি- আমার ছোটবেলার সেই রিনরিনে সুর- গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গা মাটির পথ। অথবা 'ভ্রমর কইও গিয়া, শ্রীকৃষ্ণ বি-চ্ছেদের অনলে/অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে ভ্রমর কইও গিয়া-'। আমাকে আবার টেনে আনে লঘুতাল রবীন্দ্রসংগীত, অথবা হালকা সুরের কিছু গান। রুচিবোধটা বোধ হয় এরকমই!
ব্লগে এসে অনেক ব্লগারের অদ্যপান্ত লেখা পড়ে আমার কেন জানি তাই মনে হয় মাঝে মাঝে। শুরুতে ধুমধরাক্কা লেখাগুলো হঠাৎ করেই অনিয়মিত হতে থাকে ধীরে ধীরে(অনেকেরই/সবার নয়)। উৎসাহটা বোধহয় ঐ গানের মতই, ফিরে ফিরে আসে যায়।
সময়ের পরিক্রমায় এমন একদিন আসবে, আমিও হয়ত তাঁদের মতই অনিয়মিত হয়ে পড়ব। তারপর একদিন হঠাৎ ঢু মারব। ঠিক তাঁদের মতই আবার ভাললাগা পেয়ে বসবে আমাকে- সামহয়্যার ইন ব্লগে।
ফেইসবুক থেকে ভাললাগা কিছু লেখা(অবশ্যই নিজের) কপি পেস্ট করে, আর একটু বকের পা চালিয়ে সুন্দর কিছু একটা উপহার দিতে আকুলি বিকুলি করে মন। কিন্তু ও প্রান্ত থেকে কে যেন টেনে ধরে আমায়। বারবার বলে দেয়, ঘাপলা করে কী লাভ?
সবচে বড় ঘাপলাটা করি তখনই, যখন প্রতিক্ষায় থাকি- কিছু ব্লগারের প্রতীক্ষা। তারা যখন উপেক্ষা করেন খু-উ-ব বেশি, তখন তাদের পোস্টে ঘুরে আসি।
না।
কোনো কপি পেস্ট নয়। অথবা নয় একটা কমেন্টও।
শুধু পড়ে যাই। বলে যাই না- আমি এসেছিলাম।
সে জানুক, সে-ও উপেক্ষিত।
এটাই আমার নীরব প্রতিবাদ অথবা সবচে বড় 'ঘাপলা'!
এই ঘাপলা শব্দটার সঠিক মানে আমি এখনও বুঝিনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৩৩