অঞ্জন দত্ত। নামটির মধ্যেই কেমন জানি আলাদা একটা জীবনবোধ জড়িয়ে আছে … লুকিয়ে আছে চারিপাশের আর দশটা পাচটা জিনিসকে আলাদা কিছু দৃষ্টিভংগি দিয়ে দেখবার পর্যবেক্ষন ক্ষমতা। সেটা ভালো গান হোক, ভালো সিনেমা হোক কিংবা থিয়েটার- সব ক্ষেত্রেই উনি নিজের সময়কার কথা বলেছে … কখনো সেটা হয়েছে তার সত্তরের দশকের কোলকাতা, কখনো হয়েছে তার মানিকতলার নোনাধরা বাড়ি ও সেখানকার মধ্যবিত্ততা ও জয়েন্ট ফ্যামিলির পরিবেশ কিংবা তার প্রথম প্রেম, প্রথম সিগ্রেট কিংবা প্রথম যৌন স্বপ্ন দেখা। মদ্দাকথা সবকিছু মিলিয়ে তিনি সবসময় চেয়েছেন একটা সময়কে রিপ্রেজেন্ট করতে। আর সেই উপস্থাপনার ক্ষেত্রে আমি বলল “Dutta VS Dutta” শতভাগ সফল একটি সৃষ্টি।
এই মুভিটিতে অঞ্জন দত্তের জীবনের একটা বড় অংশের রিফ্লেকশান পাওয়া যায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তিনি একথা অকপটে স্বীকার করেছেন। যে চরিত্রটিকে ঘিরে পুরো মুভিটা আবর্ত হয়েছে তার নামঃ রনদ্বীপ দত্ত।খুব ভালো গিটার বাজায়, গানও করে … কিন্ত সে অভিনেতা হতে চেত সব সময়। দার্জিলিং এর সেন্ট পলস স্কুলে পড়াশুনো করে … কিন্তু তার বাবা আড়াই বছর তার স্কুলের মাইনে দিতে পারেনি, তার আনুমানিক পরিমান ছিল প্রায় বিয়াল্লিশ হাজার টাকা। অবশ্য স্কুল কর্তপক্ষ তার মাইনের টাকা টা মাফ করে দেয় কিন্তু স্কুল থেকে রনোর নামটা কাটা যায়। বাধ্য হয়ে তাকে কোলকাতায় ফেরত আসতে হয়।
কলকাতা মানে ছিল রনোর কাছে একটা পৃথিবী … সেন্ট পলসের বোর্ডিং স্কুলের শাসন, বন্ধু বান্ধব, ইংরেজিতে কথা বলার একটা বাতিক, সবকিছু মিলিয়ে এসব ছেড়ে কোলকাতায় এসে একটা পিকিউলিয়ার পরিস্থিতিতে পড়ে রনো। শুধু এগুলোই নয়… বাড়ির পরিবেশ নিয়েও ছিল ঝামেলা। রনোর বাড়িটা ছিল পুরোনো ধাচের, জয়েন্ট ফ্যামিলি … ঝগড়া ফ্যাসাদ, আন টিউনড রেডিওর ঘ্যাড় ঘেড়ে শব্দ- অথাৎ সত্তরের দশকে কোলকাতাকে যেমন ভাবে দৃশ্যায়িত করা যায় আরকি। রনোর বাবা ছিল একজন উকিল, নিজেকে বেষ্ট লইয়ার বলে দাবি করতেন। যদিও তিনি কাবুলি ওয়ালার থেকে ধার করে সংসার চালাতেন এবং তার কোন মক্কেল ছিল না, রুনু মাসি ব্যাতিত। রুনু মাসী ছিল রনোর দুঃসম্পর্কের মাসী, এবং তার সাথে রনোর বাবার একটা অবৈধ শারিরীক সম্পর্ক ছিল। রনোর বোন টিনার সম্পর্ক ছিল ঘেমটি রাও নামে রনোর বাবার দূর সম্পর্কের কাকার ছেলের সাথে, যদিও তিনি বয়সে টিনার বাবার সমান প্রায়। আমার এই ঘেমটি রাও এর সাথে রনোর মায়ের একটা অবৈধ সম্পর্ক ছিল। সুতরাং পরিস্থিতিটা কতটা জটিল বোঝাই যাচ্ছে … এই পরিবেশে রনো নিজেকে একদম মানিয়ে নিতে পারছিলনা।
কলকাতার নতুন স্কুলে রনোর একমাত্র বন্ধু ছিল দই । দই তার মাসীর কাছে মানুষ এক। একদিন সে স্কুলের পরে রনোকে একটা জাগায় নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিল, রনো রাজি ও হয়েছিল যেতে। একটা ঘর … খুব জোরে সেতার বাজছে, সব দেয়ালে বব ডেলান, এলভিস প্রিসলি, বিটলস এর পোষ্টার। কখনো কখনো king crimson এর in the court of the kingson crim বেজে চলেছে এখনো কেউ আওড়াচ্ছে বাদল সরকারের কবিতা। মূলত ওটা অনেকটা ক্লাব টাইপের গান বাজনা, সাহিত্য, নাটক চর্চা হয়। তখন কলকাতায় hippi কালচারের একটা প্রভাব এসেছিল, এদের ক্লাবটা তাদেরই অনুসারী। তো সেখানে একজনের সাথে রনোর পরিচয় হয় যিনি নিজেও ছিলেন মিউজিশিয়ান , যে রনোকে দেখেই আচ করতে পারে তার সমস্যা কি। চলমান সময়টাকে খামচে ধরে তিনি কিছুটা রূপক ভাবে রনোকে বোঝান একটা আলাদা জীবন বোধের কথা। তার কথাগুলোই রনোর মধ্যে একটা আলাদা পরিবর্তন আনে।
কলকাতায় রনোর অনেক জ্বালার মধ্যে একটা জ্বালা নিভিয়ে দেয় একটি মেয়ে… নাম নন্দিতা। অবশ্য তার আরেকটা নামও আছে… ডায়ানা। ডায়ানা দই এর ফ্রেন্ড চেরির প্রেমিকা… কিন্তু সেসব জানা স্বত্তেও ডায়ানার প্রেমে পড়ে যায় রনো। যদিও রনোকে তেমন কোন পাত্তাও দিতনা ডায়ানা। যেদিন ওদের প্রথম পরিচয় হয় সেটা ছিল চেরির জন্মদিনের পার্টি, একটা গান করেছিল সেখানে রনো। আমার খুব খুব খুবই প্রিয় … চারটা লাইন লিখছিঃ
There will be someone dying on the road
There will be someone carrying all the load
And I know that this old world, will never ever care
But I know that I will find you somewhereeeeeee ………
ইতিমধ্যে তখন কলকাতায় নকশাল আন্দোলনের একটা প্রভাব পড়েছিল … অঞ্জন দত্ত সেখানকার কিছু দৃশ্যপট ও তুলে এনেছেন মুভিতে। পাড়ার থেকে অনেক ছেলেকে বিনা অপরাধে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, তার নকশাল করত বলে। কিন্তু দত্ত বাড়িতে কখনো পুলিশ ঢোকনি কারন রনোর বাবা ছিল কংগ্রেসের বড় সমর্থক। রনোদের পাড়ার সবচেয়ে বড় নকশাল নেতা ছিল খোকা নামের একজন ব্যাক্তি, বেশ গম্ভীর মেজাজ, কথায় কথায় মাও সে তুং এর ‘রেডবুক’ বের করে উদ্দৃতি দিত … যাকে রনোর বাবা কিছু টাকা দিয়েছিল ঘেমটিকে মেরে ফেলার জন্য … কারন টিনার সম্পর্কটি তিনি মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু ঘটনা পরিক্রমায় টিনা পালিয়ে বিয়ে করে ঐ নক্সাল নেতা খোকাকেই।
সিনেমার সবচে বড় আকর্ষনটা আমার কাছে ছিল যখন রনো ডায়ানাকে প্রোপোজ করে। মুভিটার মত প্রোপোজের ধরনটাও ছিল পুরো আলাদা, একটা ছেলে এসেছিল ভালোবাসি বলতে। কিন্তু না … সে ডায়ানাকে বলে যে সে জানে ডায়ানা তাকে একদম পছন্দ করেনা। নিজের সমস্ত দোষ ত্রুটি গুলো বলেঃ সে দেখতে খুব একটা ভালোনা, ফাইনাল এক্সামস ফেল করবে, তার বাবা কাবুলী ওয়ালার থেকে ধার করে সংসার চালায়, মা এলকোহলিক … সাবলীলভাবে মেয়েটাকে কথাগুলো বলে যায়। কিন্তু শেষের বাক্য গুলো সত্যিই অসাধারনঃ “But you know what !! I love you… and I will always love you. Where ever you are, who ever you with.. জাস্ট তোমাকে এটুকুই বলতে এসছিলাম। আর আজকের পর থেকে আমি তোমাকে আর কোনদিন ডিস্টার্ব করবনা।“ ডায়ানা কথা কেদে ফেলে কথাগুলো শুনে।
ততদিনে রনোর বেষ্ট ফ্রেন্ড দই নক্সালদের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। একদিন সে রনোর বাসায় এসেছিল আশ্রয় চাইতে… রনো কৌফিয়ত চাওয়া তে সে বলেছিলঃ “তোর মত মানুষদের ভালো থাকার বিনিময়ে গ্রামের লোকেরা খারাপ আছে। না … এই আধা সামন্ততান্ত্রিক, আধা ঐপনিবেশিক শাসনব্যাবস্থাকে মেনে নিয়ে স্রেফ গাজা খেয়ে আমার জীবনের বাকি দিন গুলো কাটিয়ে দিতে পারব না। ”। সেদিন রনো বাবাকে না জানিয়েই আশ্রয় দিয়েছিল দইকে। কিন্তু পুলিশ সে তথ্য পায় … সার্চ করতে আসে রনোদের বাড়ি। কিন্তু রনোর বাবা সার্চ না করতে দেওয়ায় তাকে থানায় নিয়ে যায় দারোগা, প্রচুর মারধোর করে। তারপর বাড়ি এসে সাইভাইক্যাল এটার্ক হয় তার। তিনি আর কোনদিন কারো সাথে কথা বলেননি। রনো মৃণাল সেনের ছবিতে কাজ করবার সুযোগ পায় … মেইন রোলে। ব্যাস।
মুভিটা বেশ পুরোনো, কিন্তু এটা আমি ৩০ বারের উর্ধে দেখেছি। শুধু ভালোলাগে এজন্য নয়, এর কিছু কিছু অংশ আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রোপোজের অংশটা। যাই হোক, যেহেতু আমার ফেভারিট তাই এটা নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হল। লিখলাম। হয়ত অনেকে দেখে থাকবেন মুভিটা, কিন্তু যদি কেউ না দেখেন তাহলে আমি বলব অনেক কিছু মিস করে গেছেন। মুভিটার প্রতিটা লাইনের ভিতরে আর্ট আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:৪৩