নেপাল যাবো। জীবনে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। আমার গিন্নি'র দুইজনেরই। তিনি বললেন
- নেপালে'তো পোর্টএন্ট্রি ভিসা। চলো বিমানের টিকিট কেটে ফেলি।
বললাম
- জ্বী না, দেখা গেলো ওমুক ডকুমেন্ট কেন নাই, হেন তেন বলে পোর্টে ভিসা দিলোনা, তখন?
লম্বা লাইন হবে ভেবে, সকাল সাতটার সময় গুলশানে নেপাল এম্বেসীতে গিয়ে বসে রইলাম। কিসের লাইন, গিয়ে দেখি আমরা আট, দশজন মানুষ মাত্র। ফর্মালিটিজ বলতে কিছুই নাই। গিন্নি'রে সাথে নেওয়ার কোনই দরকার ছিলোনা। যে কোন একজন গিয়ে পাসপোর্ট জমা দিলেই হয়। অবশ্য যাওয়াতে মন্দও হয় নাই। কোথাও ঘুরতে যাবার আনন্দটা শুরু হয় প্রস্তুতি পর্ব থেকেই।
প্রস্তুতি দিনে দিনে বাড়তে থাকলো। একদিন অফিস থেকে ফিরলাম, তিনি বললেন
- চলো শীতের কাপড় কিনতে হবে।
বললাম, মার্চ মাসে তুমি শীতের কাপড় কেন কিনবা?
নেপালের ওয়েদার দেখায়ে বললেন
- দেখো টেম্পারেচার। ৮ থেকে ১৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
বঝলাম, ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা বিবাহের পর সব নিজের মাথা থেকে বউয়ের মাথায় চলে গিয়েছে। শীতের কাপড় কিনলাম। দুই একটা ওয়েষ্টার্ণ ড্রেস দেখায়ে তিনি বললেন
- দেখোতো এইগুলা কিনবো? পরা ঠিক হবে?
বললাম
- নিজের ইচ্ছাকে কোনদিন অন্যে কী ভাববো দিয়া প্রভাবিত করবা না।
দিন যতই ঘনায়ে আসছে, উত্তেজনা অতই বাড়ছে। যাবার ঠিক আগের দিন বললাম
- বউ বিদেশ যাবো, একটা নতুন সানগ্লাস নিবো না!
সুন্দর দেখে একটা সানগ্লাসও কিনলাম। এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আগায়ে দিতে সকাল বেলা বন্ধুসমেত বড়কুটুম্ব (শালা) এসে হাজির। ভাগ্নি, শালা, এদের বন্ধুরা সবাই এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আসলো। নিজেকে একটু ভিআইপি ভিআইপি মনে হচ্ছে। টার্মিনালে ঢুকার আগ মুহূর্তে বিদায়ী কথাবার্তা বললাম। "ভাইয়া পৌছাইয়াই একটা ফোন দিবেন" টাইপ মমতা মাখানো দায়িত্ববোধে আমি আপ্লুত।
ইমিগ্রেশন পার হওয়া শুনছি বড় যন্ত্রনা। অথচ কোন যন্ত্রনাই হইলো না! কোন প্রশ্নটশ্ন করলো না। শুধু বললো
- ক্যামেরার দিকে তাকান।
ব্যাস।
প্রথম এয়ারপোর্টের ভিতরে ঢুকলাম। যে সাইনবোর্ড দেখি, দায়িত্ব মনে করে সাথে সাথে পড়ে ফেলি। প্লেনে গিয়ে বসলাম। ভালোবাসা মানে পছন্দের জিনিস ভালোবাসার মানুষটাকে দিয়ে দেওয়া। জানালার পাশে গিন্নিকে বসতে দিলাম। প্রতিটা মুহূর্তে উত্তেজনা। এর পর কী হয়, এরপর কী হয় দেখছি। বিমানের সিট সম্পর্কে একটা উঁচু ধারণা ছিলো। কিন্তু সিট দেখি বাসের সিটের চাইতেও ছোট ও নিম্নমানের! যাই হোক, অপেক্ষা করছি রানওয়েতে বিমান কখন দৌড়াবে। বিমান যখন আকাশে উড়লো, ওমা! কান দেখি বন্ধ হয়ে গেলো! কুমিল্লার ভাষায় এরে বলে হাটকালি। ঢোক গিললাম, কান খুলে গেলো। প্লেন একটু পর পর আরেকটু উপরে উঠে, আর কান হাটকালি মারে। প্রথম দশ মিনিট চলে গেলো এই ঢোক গিলাগিলি খেলতে খেলতেই। কিছুক্ষণ পর দেখি বলতেছে, আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই নেপালে অবতরণ করবো! বিদেশ যাচ্ছি, এত দ্রুত চলে আসলে হয়!
এয়ারপোর্টে এসে দিখি, যারা ভিসা নিয়ে আসেন নাই, তাদের বিশাল লাইন! ভাগ্যিস ভিসা নিয়ে এসেছিলাম, না হয় ত্রিশ মিনিটের বিমান যাত্রায় নেপাল এসে এয়ারপোর্টেই আটকে থাকা লাগতো চার, পাঁচ ঘন্টা। আমাদের'তো ভিসা করা আছেই! চট করেই বের হয়ে গেলাম। হোটেল বুকিং আগে থেকেই করা ছিলো। সিনেমায় আগে দেখতাম, এয়ারপোর্টে অতিথী'র নামের প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ায়ে থাকে। মনে হচ্ছে সিনেমার একটা চরিত্র নিজেই হয়ে গিয়েছি। কারন, ইমিগ্রেশন ক্রশ করে লাগেজ নিয়ে বের হয়েই দেখি, সামনে একজন লোক হাসিমুখে দাঁড়ায়ে আছে। হাতে প্ল্যাকার্ড, এতে লেখা মিষ্টার জাহাঙ্গীর হোসাইন এন্ড মিসেস হোসাইন।
হোটেলের পাঠানো প্রাইভেট কারে করে যাচ্ছি। নেপাল এয়ারপোর্টে নেমে টুরিষ্টরা সবাই আগে থামেলে যায়। থামেল যাবার পথে কাঠমান্ডু শহর দেখছি। মনে হচ্ছে বছর বিশেক আগে দেখা ঢাকা শহর দেখছি। উন্নয়নের ছোঁয়া এখনো লাগে নাই। তবে উন্নয়নের কাজ হচ্ছে। ঢাকা'র মত অত মানুষজন নাই রাস্তায়। কিন্তু কোথয় যেন একটা শৃঙ্খলা আছে। গাড়ীগুলা সুন্দর মত লাইনে লাইনে চলছে। মানুষগুলার চলার মধ্যেও একটা সৌম্য ভাব আছে।
থামেলে হোটেলে গিয়ে পৌঁছলাম। ম্যানেজারের নাম বদ্রি, ইমেইলে কথা হয়েছে আগে। ভদ্রলোক নিজে অপেক্ষা করে বসেছিলেন রিসেপশনে। বললেন
- আগামী দিনইতো আপনারা পোখারা যাচ্ছেন?
বললাম, হুমম। তিনি আমার হাত ধরে খোঁচা দিলেন। এতে খোঁচাখোঁচি'র কী আছে বুঝলাম না। ভদ্রলোক বললেন
- আপনিতো আর সাধারণ মানুষের মত সেখানে যেতে পারবেন না। যত দ্রুত জীপ গাড়ি বুকিং দিয়ে দিবেন অত ভালো। পরে কিন্তু পাবেন না।
তিনি আবার খোঁচা দিলেন। আমি আবারো এর মানে বুঝলাম না। বললাম
- কত পড়বে?
ভদ্রলোক ক্যালকুলেটরে কী যেন হিসাব করলেন। তারপর বললেন
- বিশ হাজার রুপি। ব্র্যান্ড নিউ জীপ।
বউ এবার আর খোঁচা দিলেন না। মুখ খুলে বললেন
- আগে ফ্রেস হয়ে আসি, তারপর এই বিষয়ে কথা বলবো।
ভদ্রলোক বললেন,
- ঠিক আছে, দ্রুত করবেন ম্যাম। পরে দেখা গেলো জীপ আর পাওয়া গেলো না, আপনাদের একদিন এক্সট্রা থাকতে হলো।
রুমে এসে ভ্রু কুঁচকায়ে তিনি বললেন
- তুমি বুঝতেছো না, লোকটার কমিশন আছে এতে! আর তুমি আমি সাধারণ মানুষের মত যাইতে পারবো না মানে? ব্যাটা কিভাবে বুঝলো, তুমি আমি অসাধারণ!
কতক্ষণ পর তিনি বললেন, গুগলে সার্চ দাওতো বাস ফ্রম থামেল টু পোখারা। আবারো অবাক হইলাম, গুগল ভাবনাতো আমার মাথাতেই আসে নাই! দিলাম সার্চ। বেশ কয়েকটা ফোন নম্বর চলে আসলো। সিম'তো এয়ারপোর্টে নেমেই নিয়ে নিয়েছিলাম। দিলাম ফোন। বললাম
- টিকিট কাউন্টার কোথায় আপনাদের?
বললো
- টিকিট কাটতে হবেনা। সকাল ছয়টার মধ্যে কান্তিপাথে চলে আসলেই হবে। আমি নিজে আপনাকে ফোন করে খুঁজে নিবো।
বললাম
- ভাড়া?
বললো
- ছয়শো রুপি।
গুগল ম্যাপে দেখলাম, যেখানে আছি, সেখান থেকে কান্তিপথ দেড় কিলোমিটার। সকাল বেলা হোটেল থেকে বের হইলাম। হালকা কুয়াশা আছে। এর মধ্যেই দূরে দেখি আকাশজুড়ে পাহাড় দাঁড়ায়ে আছে। এ হিমালয় না অন্য পাহাড় জানি না। তবে এই প্রথম মনে হইলো, বিদেশ আসছি, সুন্দর জায়গা দেখতে আসছি। থামেল জায়গাটা মনে হয় স্পেশালি ট্যুরিষ্টদের কথা মাথায় রেখেই ডেভেলপ করা। ফুটপাথ গুলাও বেশ সুন্দর। সকালের কাঠমান্ডু শহর দেখতে দেখতে হাটা শুরু করলাম। গুগল ম্যাপে দেখাচ্ছে কান্তিপথ কাছেই। কান্তিপথ পৌঁছলাম। এরই মধ্যে বাসের ঐ ভদ্রলোক দুইবার ফোন দিয়ে জেনে নিয়েছেন, ঠিক পথেই আমরা আছি। আমাদের বাসে কাছে যাবার আগেই দেখি সাড়ি সাড়ি বাস। সব কয়টা বাসই দেখতে অসাধারণ! যাত্রীদেরকে ডাকতেছে, পোখারা পাঁচশো, পোখারা পাঁচশো। তিনি বললেন
- কী করবা?
বললাম
- বউ কথা দিয়ে দিছি ছয়শো'তে। কথা'র দাম আছে না!
আমাদের বাসে উঠে বসলাম। আমাদের হেল্পারও ডাকতেছে, পোখারা পাঁচশো, পোখারা পাঁচশো...। কন্ডাক্টর ব্যাটা দেখি আমার দিকে লজ্জিত দৃষ্টিতে তাকাইলো। তারে নরম্যাল করার জন্য বললাম
- দাদা বাস এখনি ছাড়বে, নাকি চা খাবার সময় পাবো?
অতিরিক্ত আন্তরিকতায় বললো
- ও প্লিজ হ্যাভ ইউর টি প্লিজ...
নেপালের লোকজন ইংরেজী, হিন্দি দুইটাতেই বেশ সুন্দর কথা বলে। ফুটপাথে গ্যাসের চুলায় চা হচ্ছে। মজার বিষয় হচ্ছে, যে কয় কাপ চায়ের অর্ডার দেওয়া হবে, এতটুকু পানি, দুধ, চাপাতা দিয়ে ইন্সটেন্ট চা বানানো হবে। নেপালের পথে কুকুরগুলা দেখলাম বেশ স্বাস্থ্যবান। আমাদের চা দিয়ে আরেকটু এক্সট্রা চা একটা ওয়ান টাইম কাপে ঢেলে কুকুরকে খেতে দিলো। গরম চা কুকুরটা চুক চুক করে খাচ্ছে। কুকুর মানুষের সবচেয়ে কাছের বিশ্বস্ত বন্ধু। অথচ আমাদের দেশে কী অবহেলায় এই প্রাণীগুলা পথে পথে ঘুরে বেড়ায়!
পোখারা হচ্ছে নেপালের সবচেয়ে সুন্দর শহর। হিমালয়কে খুব কাছ থেকে দেখা যায়। বাস শহর ছেড়ে পাহাড়ী পথে চলা শুরু করলো। পাহাড়ী পথ বাংলাদেশেও আছে, কিন্তু যাওয়া হয় নাই। পাহারের গা বেয়ে প্যাঁচায় প্যাঁচায়ে উঠে যাওয়া, আবার একই ভাবে নেমে আরেকটা পাহাড়ে উঠে পড়া। একটু পর পর তাকিয়ে থাকি, বাসটা যখন পাহাড়ের চূড়ায় উঠবে তখন নীচটা কেমন দেখা যাবে। যাদের পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা আছে, তাদের জন্য হয়ত কিছুই না। কিন্তু যার জন্য প্রথম, তার জীবনে সর্বোচ্চ থ্রিলিং এর একটা বিষয়। সারা শরীরে কেমন যেন একটা নেশা নেশা কাজ করে। সম্ভবত ভয়ের কারনে এড্রেনালিন গ্রন্থি থেকে এক ধরণের হরমোন বের হয়। এই হরমোনের কাজই হরো নেশা ধরিয়ে দেওয়া। তারমানে অতিরিক্ত ভয় পেয়ে মরে যাবার বিষয়টা খুব একটা কষ্টের না। বরং একটা নেশা নেশা ভাব থাকে এতে।
বাস মাঝে একটা হাইওয়ে রেষ্টুরেন্টে থামলো। নেপালে প্রচুর ইউরোপিয়ান, আমেরিকান ট্যুরিষ্ট থাকে। কালো চামড়ার এশিয়ানের সংখ্যা নিতান্তই কম। তবু একজন হোটেল বয় আমাদের কাছে এসে বাঙ্গালী অফার দিলো। শুধু তরকারীর দাম দিলেই হবে, ভাত যত খাও। গিন্নি বললেন আমি ফ্রাইড রাইস খাবো। একটা ঝোল ঝোল আলু তরকারী আমার দেখে এত লোভ লাগলো! আমি নিলাম, আলু তরকারী আর পরোটা। কতক্ষণ পর গিন্নি বললেন
- তোমার পরটা থেকে আমারে একটু দাওতো!
অবাক হয়ে গেলাম। কারন যে মানুষ ফ্রাইড রাইস একমাসের ফ্রিজে থাকা হলেও গোগ্রাসে খায়, তার আজ ফ্রাইড রাইসে অরুচি! বললাম
- ঘটনা কী?
মন খারাপ করে বললেন
- ফ্রাইড রাইসের অর্ধেক চাল, বাকী অর্ধেক নারিকেল!
বাস আবার চলা শুরু করলো পাহাড়ী পথে। নীচের দিকে তাকালে কোথাও ঘন জঙ্গল, কোথাওবা গিরিখাদ। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট ঘর। সে ঘর জসীমউদ্দীনের আসমানীদের ঘরের মত, কোথাও ছাওনি নাই'তো কোথাও বেড়া নাই। কিছুক্ষণ পর দূরে পাহাড়ের গায়ে এক খন্ড ধোঁয়া'র মত কী যেন দেখি ঝুলে আছে। পাহাড়ের গা বেয়ে যখন আরো উপরে উঠলাম, তখন দেখি এমন ঝুলন্ত ধোঁয়া জায়গায় জায়গায় জমাট বাঁধা। ধূসর রঙ্গের একটা এমন কুন্ডলী দেখে চমক লাগলো! বউরে খোঁচা দিয়ে বললাম
- বউ মেঘ! দেখো, দেখো! আমাদের নীচে! মেঘ, আমাদেন নীচে বউ!
বিমানে চড়ে যখন সাইঁ করে মেঘের উপরে উঠে গেলাম, মনে হলো তুলায় বিছানো সাদা চাদরের উপর যেন উঠে গেলাম। কিন্তু পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে আটকে থাকা এই মেঘের মত এত সুন্দর সেই মেঘকে মনে হয় নাই। গ্রামের বাড়ীতে এক ধরণের কুয়াশা দেখা যায়। দূর থেকে মনে হয়, উপরেও পরিষ্কার, নীচেও পরিষ্কার; অথচ মাঝ বরাবর একটা স্তরের মত আটকে আছে কুয়াশা। কিন্তু ঐ দৃশ্য দিয়ে পাহাড়ের কোলে আটকে থাকা মেঘের সৌন্দর্য্য কিছুতেই বুঝানো যাবেনা। চরম সুন্দরের কাছে গিয়ে মানুষে মধ্যে এক ধরণের আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগে। হঠাৎ হঠাৎ মনে হতে থাকলো, পাহাড়ের চূড়া থেকে লাফ দিয়ে এই আটকে থাকা ভাসমান মেঘের চাদরে একটু শুই। যে চোখ পাহারের ভাঁজে ভেসে থাকা বাষ্পের মত মেঘ দেখে নাই, এই চোখ সৌন্দর্য্যের কিছুই দেখে নাই। ক্ষণিক বিরহে প্রিয়ার চোখের পড়ন্তপ্রায় চোখের জলের চেয়েও এই ভেসে থাকা মেঘ বহুগুনে সুন্দর, অতিমাত্রায় সুন্দর।
বাস কোথাও জোরে, কোথাও সামলে নিয়ে আস্তে চলছে তো চলছেই। খেয়াল করে দেখলাম, বেশীরভাগ পাহাড়গুলাই পাথরের। পাথরের পাহাড়ের কোথাও যদি একটু মাটি থাকে'তো তাতেই পেয়াজ, রসুন জাতীয় কিছু একটা লাগানো আছে। দুই হাত মাটির সন্ধানও যেখানে আছে, সেখানে অন্তত একটা মরিচ গাছ হলেও লাগানো। যারা এই পাথরের পাহাড় দেখে নাই, তাদেরকে যতই বলি, বাংলাদেশের মাটি সোনা-ফলা মাটি, তারা বুঝবে না। আমার সোনার বাংলায়, বীজ যেখানে খুশি ফেলে রাখলেই তাতে সোনার ফসল ফলে। দেশপ্রেম কী জিনিস তা বিদেশ না গেলে বুঝা যায় না।
ধীরে ধীরে মাটি'র পাহাড়ও নজড়ে পড়া শুরু হলো। মাটিতে সিড়ি'র মত করে করে সর্পিল ভাঁজ কাটা। এতে ধান সহ আরো অন্য অনেক ফসল লাগানো আছে। পাহাড়ের গা খাড়া থাকে, এতে ফসল লাগিয়ে পানি দেওয়া যায় না। কিন্তু সিড়ি'র মত করে করে খাজ কেটে বাঁধ দিলে এতে ফসল লাগানো যায়, বাঁধ দিয়ে পানি দেওয়া যায়। চাষ করার এই যে বুদ্ধি একে বলা হয় জুম চাষ। অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্ত মনে করতাম, জুম বুঝি ধান, গমের মত একটা ফসল, যা পাহাড়ে হয়।
ঘন্টা আটেক পরে গিয়ে থামলাম পোখারায়। সেখানে বাস থেকে নেমে দেখি খুব ভদ্রভাবে ট্যুর গাইডরা ডাকাডাকি করছে। এর মধ্যে একজনের বয়স হবে পঞ্চাশের মত। আমাদের কাছে এসে বললেন
- স্যার, আমার নিজের একটা হিমালয়মূখী গেষ্টহাউজ আছে। আমার সাথে চলেন, যদি পছন্দ না হয় জাষ্ট টেক্সি ভাড়া'র একশো পঞ্চাশ রুপি দিয়ে দিলেই হবে।
গুড, ভেরীগুড প্রস্তাব। গিন্নি খোঁচা দিলেন।
বললাম
- দেখতেতো সমস্যা নাই!
ভদ্রলোক আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে বললেন
- হুমম চলেন, দেখতেতো সমস্যা নাই!
বললাম
- বাংলা পারেন!
হাসি দিয়ে বললেন
- অল্প।
গেষ্ট হাউস পছন্দ হইলো। হোটেলের মালিক ভদ্রলোক বললেন
- পাশেই ফেওয়া লেক, ঘুরে আসুন।
তখন বিকাল, সহনশীল শীত। গুছানো রাস্তাঘাট। বিদেশ ঘুরতে গেলে যতটা সুন্দর, ভদ্র, রুচিশীল পরিবেশ মানুষ আশা করে, ঠিক অতটাই পরিপাটি পরিবেশ। ওয়েষ্টার্ণ ড্রেস পড়ে এর উপর লম্বা একটা কোট চাপিয়েছেন গিন্নি। দেশে এই লাম্বা কোট পড়লে, তারে বেমানান লাগতো। কিন্তু বিদেশের এই পরিবেশে খুব সুন্দর মানিয়েছে। রাস্তায় প্রচুর বিদেশী। বেশীরভাগই ইউরোপিয়ান বা আমেরিকান। শুধু দোকানের ভিতরের লোকগুলা নেপালী। গিন্নি ফুড়ফুড়া মেজাজে আমার হাতের কনুই ধরে হাটছেন। অতি আবেগে আহ্লাদী হয়ে বললেন
- দেখোতো আমারে ফরেনার ফরেনার লাগতেছে না?
মুচকি হাসি দিয়ে বললাম
- বউ তুমি বিদেশে আসছো, তুমি এইখানে বিদেশিনীই।
বললাম
- বউ ভালোবাসতে পারা ছাড়া আমার আর কোন গুন নাই। থাকলে গান ধরতাম, আমি চিনিগো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী...
হিমালয় পাহাড় দেখলাম, বিকালের কুয়াশায় ঢাকা অবস্থায়। অত ভালো দেখা না গেলেও মনে হলো যেন সামনে অনেকটা জায়গাজুড়ে বিশাল মেঘে অন্ধকার হয়ে আছে। হাটতে হাটতে গেলাম ফেওয়া লেকের ধারে। এই লেকে'র কত যে গুনকীর্তণ শুনেছিলাম এরই মধ্যে নেপালীদের কাছে! অথচ এই লেক আমাদের গুলশানের লেকের চাইতে খুব বড় মনে হলো'না। তবে যেহেতু ছোট ছোট পাহাড়ে ঘেরা লেক, এর সৌন্দর্য্য অস্বীকার করার মত না। লেকের পানি সম্ভবত হিমালয়ের বরফগল পানি, কাকের চোখের চেয়েও পরিষ্কার যদি কিছু থাকেতো এই পানি। পানি'টা কত পরিষ্কার তা একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। লেকের পাড়ের ভিতরের অংশে খেয়াল করলে দেখা যাবে, ছোট ছোট বক্সের মত কী যেন। কাছে গেলে বুঝা যায়, এইগুলা আসলে পানি'র মোটর। পোখারা শহরের মানুষ এই লেকে'র পানিই দৈনন্দিন কাজে ব্যাবহার করে। একজন বললেন, এই পানি খায়ও। লেকে'র মধ্যে নানান রঙ্গের কাঠের নৌকা। শুধু নৌকাগুলার ছবি তুলে দিলেও যে কেউ বলে দিতে পারবে, এই নৌকাগুলা ফেওয়া লেকের নৌকা। এমনই উইনিক এই সাধারণ রঙ করা নৌকাগুলা।
বউরে বললাম
- বউ আমরা যদি ঢাকা শহরের লেকগুলাকে এমন পরিষ্কার রাখতে পারতাম, সাইডে এমন করে হাটা চলার জন্য রাস্তা, বসার জন্য ব্যবাস্থা করতে পারতাম। বিদেশীরা ঠিকই আগ্রহ নিয়ে আসতো।
তিনি বললেন
- নাহ আসতো না, সিকিউরিটি নিশ্চিৎ করতে না পারলে আসতো না।
যুক্তি দিয়ে বললেন
- এই যে দেখো, সন্ধা হয়ে যাচ্ছে, কোথাও কি তুমি মনে করছো জায়গাটা সেফ না?
- ওঁহু
- এই নিশ্চয়তাটাই ট্যুরিস্টরা সবার আগে চায়।
পোখারায় প্রচুর দোকান। সব কয়টা দোকানেই ট্যুরিষ্টদের জন্য টার্গেট করে মালামাল রাখা। কোথাও শো'পিস, কোথাও লাগেজ, কোথাওবা গিফ্টকর্ণার। আর একটু পর পর আছে ট্যুর প্ল্যান করে দিবে এমন ট্যুরপ্ল্যানার। ছোট্ট একটা কাঁচেঘেরা রুমে সুন্দর সুন্দর পোষ্টার লাগিয়ে লোকজন বসে থাকে। পোখারায় কী কী দেখতে হবে, কত টাকার মধ্যে এইসব প্যাকেজের মধ্যে করে দিবে, এইসব বুদ্ধি তারা দেয়। একটা ট্যুর প্ল্যানারের কাছে গেলাম। দেখেই বললো
- ফ্রাম বাংলাদেশ?
- হুমম
- আগামী দিনের জন্য সুন্দর একটা প্ল্যান করে দিচ্ছি। এই দেখুন ব্রাজিলিয়ান এক দম্পতিকে করে দিলাম দশ হাজার রুপিতে। আপনারা আমাদের প্রতিবেশী, তাই মাত্র পাঁচ হাজার রুপিতেই এই প্ল্যান করে দিচ্ছি।
প্ল্যানে কী কী থাকবে তা শুনলাম, এরপর ধন্যবাদ দিয়ে পাশের ট্যুরপ্ল্যানারের কাছে গেলাম। এই ভদ্রলোক আরেক ডিগ্রী উপরে। বললেন
- সস্তায় কোন প্যাকেজ নিবা না, কারন তোমারে এমনভাবে ঘুরায়ে নিয়ে আসবে, তুমি আসলে কিছুই দেখবা না। সব কয়টা প্লেস ডিটেইল দেখাবে। ইউরোপিয়ানরা খুশি হয়ে দশ, পনেরো হাজার রুপি দিয়ে দেয়। তোমরা আট হাজার দিলেই হবে।
- ট্যুরিষ্ট গাইড কে থাকবে?
ভদ্রলোক হাসি দিয়ে বললেন
- এখানে আমাদের যে ড্রাইভার তোমাকে নিয়ে যাবে, সেই ট্যুরিস্ট গাইড। আলাদা করে কোন গাইড নাই।
ভাবলাম, ড্রাইবারই যদি ট্যুরিষ্ট গাইড হয়, তো ট্যাক্সি ড্রাইভার কী দোষ করলো? সরাসরি তার সাথেই কথা বলি! বললাম কথা এক টেক্সিড্রাইভারের সাথে। ড্রাইভার মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললেন
- ট্যুরপ্ল্যানারগুলা আমাদের সাথেই কন্টাক্ট করে। আমাদেরকে তিন হাজার রুপি করে দেয়, বাকী যা রাখতে পারে এইটা তাদের।
ঠিক করে ফেললাম আগামী দিনের ট্যুরিস্ট গাইড। ভদ্রলোক বললেন, ভোর চারটায় তোমাদের হোটেলের নীচে আমার ছোট ভাই রাম থাকবে। এই রামের সাথে পরে এত খাতির হয়ে গেলো! ভদ্রলোক এখনো প্রায়ই নেপাল থেকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করে
- দাদা ভালো?
ভোর ঠিক চারটায় এসে গাড়ি হাজির। শীত মানে প্রচন্ড শীত। মনে হয় চার কি পাঁচ ডিগ্রী সেলসিয়াস হবে। ঘোর অন্ধকারে আমরা গাড়িতে করে যাচ্ছি হিমালয় দেখতে। রাম খুব আগ্রহ ভরে বুঝাচ্ছে
- সূর্য যখন মাটি থেকে দেখা যায়না, তখন পাহাড় থেকে ঠিকই দেখা যায়। তারমানে মাটিতে তুমি দাঁড়ায়ে থাকবা অন্ধকারে, তখনো ভোর হবেনা। অথচ হিমালয়ের চূড়ায় দেখবা কী সুন্দর সোনালী আলো! কতক্ষণ পর দেখবা পাহাড়ের আলো সাদা হয়ে আসবে, আর সোনালী আলোয় তখন মাটিতে ভোর হবে।
অন্ধকার থাকতে থাকতেই কয়েকটা পাহাড় ডিঙ্গায়ে যে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে থামলাম, সেই জায়গাটার নাম সারাংকোট। এই জায়গাটার সামনে ছোটখাটো অনেকগুলা পাহাড় আছে, কিন্তু বড় কোন পাহাড় নাই। তাই তিরিশ কিলোমিটার দূরের হিমালয়কে স্পষ্ট দেখা যায়। প্রচুর ট্যুরিষ্ট। রেলিং দিয়ে সুন্দর করে জায়গাটা বাঁধানো। ধীরে ধীরে বিশাল হিমালয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শিশু হৃদয় হাতি দেখে যেমন পুলকিত হয়, বড় হৃদয় এর চেয়েও কোটিগুনে চমকে উঠলো বিশাল এই পাহাড় দেখে। কবিগুরুর কঠিন একটা গান আছে "অয়ি ভুবনমনমোহিনী" এর ভিতরে একটা লাইন আছে "অম্বরচুম্বিত ভাল হিমাচল / শুভ্রতুষারকিরীটিনী!" সহজ ভাষায় বলতে গেলে, হিমালয়ের কপাল যেন আকাশকে চুম্বন করছে। আর তার মাথায় রয়েছে তুষারের মুকুট। পৃথিবীর সবথেকে উঁচা, তুষারের মুকুট পড়া এই রাজাকে দেখছি আকাশের কপালকে চুম্বন করতে। লেখক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে পারবে, বুঝাতে পাবে না। বুঝতে হলে নিজে গিয়ে দাঁড়াতে হবে এই বিশালতার পাশে।
আমাদের ট্যুরিস্ট গাইড রাম এর মন খারাপ। বললাম
- কী হইলো দাদা?
ভদ্রলোক বললেন
- কিছুইতো দেখতে পাচ্ছো না, আকাশেতো মেঘ!
বললাম
- এর চেয়েও সুন্দর দেখা যায়!
অবাক হয়ে বললো
- তোমরা কিছুই দেখো নাই, আকাশে মেঘ না থাকলে স্টেপ বাই স্টেপ দেখতে পারতা হিমালয়ের রুপ কিভাবে প্রস্ফুটিত হতে থাকে। এ যেন নতুন বউয়ের ঘোমটা খোলার মত একে একে ফুটে উঠা সৌন্দর্য্য।
অতক্ষণে আলো ভূমিতে চলে আসলো। আমরা চললাম পরবর্তী সৌন্দর্য্য দেখতে। খুব বর্ণনা দিলো, শ্বেতী নদী'র। বললো দুধের মত সাদা পানি একটা নদী দিয়ে যায়। গেলাম শ্বেতী নদী দেখতে। দুই পাহাড়ের ভাঁজ দিয়ে বয়ে চলেছে। লোহার খাঁচার ঢাকনা দেওয়া। কিছুই না, দুই হাত চওড়া একটা ড্রেনের মত দেখতে। বরফ গলা পানি এখনো পুরাপুরি হয়ত গলে নাই, তাই শাদা ভাবটা পানিতে এখনো রয়ে গেছে। এরেই এরা কত সুন্দর করে বলে! যেন ট্যুরিস্টরা আকরর্ষণ পায়। ডেভিস ফল নামের আরেকটা ঝর্ণার মত দেখালো। একটা প্যাঁচানো সিড়ির গর্তে ঢুকে দেখতে হয়। এইটাও কিছুই না, বহমান পানি পাহাড়ের ভিতরের সুরঙ্গ দিয়ে কোন একটা জায়গায় গিয়ে পড়ছে।
আরো কয়েকটা মন্দির, মার্কেট আরো কী কী যেন ঘুরে ঘুরে দেখালো। কিন্তু নেপাল হচ্ছে হিমালয়ের দেশ। হিমালয়ের কাছে বাকী সব নস্যি। সকাল এগারোটার মধ্যেই সব দেখে হোটেলে চলে আসলাম। সারা দিন করার মত আর কিছুই নাই। বিকাল বেলা আবার ফেওয়া লেকে গিয়ে বসলাম। প্রথম দিনের মত এত সুন্দর আর লাগছে না। বিদেশ গিয়ে একই জায়গা দুইবার দেখার মত বোরিং কিছু নাই। বললাম
- বউ চলো, শহরের অলি, গলি ঘুরে দেখি।
শহর বলতে তেমন কিছুই না। রাস্তার পাশে দোকানপাট, আর এর ভিতরে হোটেল, গেষ্ট হাউস। বেশ কিছু নাইট ক্লাব আছে। মাসাজ নেওয়ার ব্যাবস্থাও আছে। গিন্নি পরীক্ষা করার জন্য, নাকি উদার ভেবেই জানিনা, বললেন
- মাসাজ নিবা? যাও।
- ওকে তুমি দাঁড়াও
বলে পা বাড়াতে গিয়ে থেমে গেলাম। বললাম
- অন্য কেউ হাত, পা হাতায়ে দিচ্ছে ভাবতেইতো গা গুলায়ে আসতেছে!
তিনি হাসলেন। শহরের আলো, আধারী আলোয় কোথাও নিরাপত্তার ঘাটতি মনে হলো না। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরলাম। ভোর বেলা উঠলাম, ফিরতে হবে কাঠমান্ডু। তখনো অন্ধকার কাটে নাই, গিন্নি অবাক হয়ে ডাকলেন
- এ্যাই, এ্যাই!
বললাম
- কী!
তিনি জানালার ফাঁক দিয়ে দেখালেন, দেখো!
দেখলাম আকাশ পরিষ্কার। হিমালয়ের চূড়ায় পড়েছে সোনালী আলো। আশেপাশে সব অন্ধকার। আকাশে মাথা উঁচু করে সুবিশাল হিমালয়। সূর্যের আলোর রং ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। কী মহোনীয় সেই রুপ! এমন অপরূপ রুপ দেখেই কি কবি বলেছিলেন "কেন এতো রুপ ? রুপ বুঝি জন্মান্ধের খাদ্য"! গিন্নির হাত ধরে কাছে টানলাম। তিনি লজ্জা পেয়ে বললেন
- কী করো!
বললাম
- হিমালয়কে বুঝাচ্ছি, যতই বড় হও, ভালোবাসার কাছে তুমি কিছুই না হে শুভ্রতুষারকিরীটিনী!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৫:৪৩