সৃষ্টি,সত্য এবং সুন্দরের প্রতিষ্ঠায়
অক্লান্ত পরিশ্রম করে যারা আমায় উৎসাহিত করেছেন।
অভ্রান্ত সত্যগুলিকে হৃদয়ে পুষে রাখতে অনুপ্রেরনা যুগিয়েছেন। আজ আমার মুখ্য সময়ে তোমাদের স্বরন করছি
" এক "
পিতার দাফন সম্পন্ন করার মাত্র কয়েক দিনের মাধ্যেই তানভীর পুনরায় শহরে ফিরে এল। প্রথম কিছু দিন মন ভার করে রইল।এরপর কিছু দিন ভদ্র ছেলের মত পড়া-লেখায় মনোনিবেশ করল। কিন্তু আরো কিছু দিন অতিবাহিত হলে পিতার মৃত্যু স্মৃতি একেবারে ভুলে গিয়ে পুনরায় ধীরে ধীরে পূর্ব রুপে ফিরে আসতে লাগল। অধিকাংশ সময়ই সে বাসায় থাকেন। কিন্তু যখন ফিয়ে আসে তখন কখনো কখনো মধ্যরাত অতিক্রান্ত হয়ে যায় এবং নেশার ঘোরে চৈতন্য বলতেও তখন আর কিছু অবশিষ্ট থাকেনা।
সেদিন মেঘে ঢাকা আকাশ ভারী হয়েছিল এবং সন্ধার পর হতেই অঝরে বৃষ্টি শুরু হল। রাজন একা ঘরে কিছুক্ষন পায়চারী করল, পরে জানালার সামনে এসে দাড়াল। কিন্তু রাত ন'টা অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও তানভীর যখন বাসায় ফিরলনা তখন আর সে অধৈর্য ন হয়ে পারলনা। উঠে এসে দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে এল। কিন্তু বারান্দায় দাড়িয়ে এক মিনিট কি যেন ভেবে অপেক্ষাকৃত গম্ভীর মুখে সে পুনরায় ঘরে এসে বসল।
ক্রমান্বয়ে রাত বাড়তে লাগল। বারটা-একটা-দুটা। কিন্তু তানভীরের দেখা নেই। রাজনের ঘুম পাচ্ছিল,সে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এরপর কখন যে সে ঘুমিয়ে পরেছিল তার খেয়াল নেই। কিন্তু প্রভাতের সূর্য কিরন পূর্বের পর্দাহীন শার্শীর ভেতর দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে যখন তার ঘুম ভেঙ্গিয়ে দিল তখন সে বিছানায় উঠে বসে দেখল তানভীর ঠিক তার পাশেই শুয়ে গভীর নিদ্রায় সুপ্ত। কখন যে সে ঘরে প্রবেশ করেছে তা তার বোধগম্য হলনা। কিন্তু সে নিদ্রিত তনভীরকে না ডেকে উঠে গিয়ে জানালার পর্দা লাগিয়ে দিল। হোটেলে গিয়ে খাবার নিয়ে এল এবং নিজ হাতে চা তৈরি করল।
সকাল প্রায় দশটার দিকে তানভীরের ঘুম ভাঙ্গল। গতকালের ক্লান্তি এখনো তার সারা দেহে লেগেছিল। উঠে গিয়ে গোসল সেরে এল। গায়ে শার্ট পরে মাথার চুলগুলি আচড়িয়ে খাবার টেবিলে এসে বসল। রাজনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, কাল রাতে ফিরতে একটু দেরী হয়েছিল,তাই উঠতে এত বেলা হল। কিন্তু ডেকে তুললেনা কেন?
রাজন চ'য়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,সেটা কি ভাল হত? নেশা করে অতরাতে কেউ ঘুমালে ভোরে কি তার ঘুম ভাঙ্গে না ভাঙানো যায়?
তার কথার ভেতর যে কিছুটা রাগ ছিল তানভীর তা উপলব্ধী করল। তথাপি মৃদু হেসেই বলল, কি করব বল, এত দিনের অভ্যেস সহজে যেতে চায়না। তাছাড়া বন্ধুরা এমন করে করে ধরে যে মানা করে উঠতে পারিনা। এ দিনটি'ত আর সহজে ফিরে পাব না। সময়ের প্রয়োজনে কে কোথায় হারিয়ে যাব কে জানে? তারপর দীর্ঘ চলতি পথ। হয়ত পার্থিব জীবনে আর দেখাই হবেনা কারো সাথে। তাই যতটুকু পারছি সদব্যবহার করে নিচ্ছি।
কথাগুলো তানভীর সহজ হাসি মুখে বলল সত্য , কিন্তু এই সহজ কথাগুলোর ভেতরে যে অদৃশ্য বেদনাবোধ লুকায়িত ছিল তা রাজনকে মলিন করে তুলল।
এই-ই সত্য। বর্তমান কাল পরিক্রমায় অতিবাহিত হয়ে একদিন তা অতীত হয়ে যায়। কিন্তু আজকের বর্তমান চরিত্রগুলো নান দু:খে-দৈন্যে,শোকে-তাপে,আঘাতে দুর হতে বহুদূরে হারিয়ে গিয়ে ক্রমান্বয়ে এক সময় তা দূর্নিরীক্ষ হয়ে যায়। তখন কেবল প্রতিটি অন্তরে চরিত্রগুলোই অহরহ দাগ কাটতে থাকে। সে দাগ যে কি প্রচন্ড ও ভয়াবহ,তার যন্ত্রনা যে কতদূর পর্যন্ত প্রসারিত রাজন বসে বসে তাই ভাবতে লাগল। কিন্তু কিছুক্ষন পর তার চেতনা ফিরে এলে বলল, সময়ের প্রয়োজনকে'ত আর অস্বীকার করা যায় না। আজ যা আছে কাল তা থাকবেনা এটাই স্বাভাবিক। জীবন চলার পথে আনন্দ যেমন আসে দু:খও তেমনি ঝাঁক বেঁধেই আসে। অদৃশ্য দু:খকে এড়ি্য়ে গিয়ে কেবল আনন্দকে নিয়ে মাতামাতি করলে জীবন হয়ত চলে,কিন্তু দু:খকে এড়িয়ে যাওয়া যা্য না।
তানভীর জাবাব দিল, তা হয়ত যায় না, কিন্তু ভাই যতক্ষন আনন্দ আছে ততক্ষন না হয় সেটুকুই আগে ভোগ করি। জীবনটা খুব-ই সংকীর্ন। এই সংকীর্ন জীবন হতে বর্তমানের আনন্দটুকুকে বাদ দিলে ভবিষ্যতে এর সাক্ষাত পাব কিনা সন্দেহ। অনেকে বোকার মত তাই করে সত্য,কিন্তু পরে তারা ফেলে আসা সেই সামান্য সুখটুকুও পায়না। তখন কপালে আঘাত করে হায় হায় করতে থাকে। কিন্তু ভাই আমি সে দলের নই। আমার আজ যা আছে তা নিয়েই আমি সন্তুষ্ট হতে চাই। কিন্তু যা ভবিষ্যৎ,যা আজো আসেনি,সময়ের দাবিই তাকে আমার জন্যে ভাগ করে দেবে। হয় দু:খ নয় আনন্দ। বলে সে পুনরায় একটু হাসল।
কিন্তু জাবাবে রাজন চুপ রইল। কিছুক্ষন পরে বলল, অস্তোন্মুখ সূর্যকে মায়া দিয়ে মোহ দিয়ে ভূলিয়ে রাখা যায়না জানি। কিন্তু ব্যক্তিকেও যে পারা যায়না তা জানা ছিল না। কিন্তু জিঞ্জাসা করতে পারি কেন তুমি মদ খাও?
তানভীর বলল, কেন যে খাই তা ঠিক বলে পারবনা। প্রয়োজনে নয়-মনের চাহিদা মেটাতেও নয়। কিন্তু খাই,খেতে কেমন যেন একটু ভাললাগে তাই খাই।
শুধু ভাললাগার জন্যে? কিন্তু ভাললাগলেই কি সবকিছু করতে হয়? বাবার টাকা আছে মানি, কিন্তু তাই বলে কি এভাবে তার অপচয় করবে?
তানভীরের খাওয়া ফুরিয়ে এসেছিল,হাত ধুয়ে বিছানায় এসে বসল। সামান্য একটু সময় নিয়ে রাজনের দিকে তাকিয়ে বলল, নিজের প্রয়োজনে ব্যয় করাটাকে আমার ঠিক অপচয় বলে মনে হয়না। কিন্তু সে উৎসও বোধ হয় বন্ধ হতে চলেছে।
কথাটা রাজনের কানে অদ্ভুদ শুনাল। বিস্মিত হয়ে তার পাশে এসে বসে জিঞ্জাসা করল, কেন?
তানভীর অসংকোচে জবাব দিল, কারন মা পছন্দ করেন না বলে। মায়ের ইচ্ছে নয় আমি বাহিরে থেকে লেখাপড়া করি, উপরন্তু বাবাও এখন জীবিত নেই। আমাদের বিষয় সম্পত্তি খুব একটা কিছু না হলেও কম নয়। মা চাচ্ছেন আমিই যেন সেগুলি বুঝে নেই। কিন্তু আমার ইচ্ছে নয় এ বয়সেই এসব ঝামেলায় জড়ানো। তদুপরী একমাত্র লেখা পড়ার ছলেই এ যাত্রায় বেঁচে গেছি, কিন্তু সেও বুঝি আর হয়না। গতকাল মা'র চিঠি এসেছে। তাতেই তিনি সব বিস্তারিত লিখে দিয়েছেন।
রাজন সামান্য ভেবে নিয়ে বলল, তবে তাই কেন করনা? তাছাড়া লেখা-পড়াই যদি না করবে তাহলে এখানে থেকে মাসে মাসে এতগুলি টাকা করচ করে কি লাভ?
তানভীর নিরবে হেসে বলল, লাভের কথ তো তোমাকে পূর্বেই বলেছি, বাড়তি আনন্দ-বাড়তি স্বাধীনতা। তাছাড়া লেখা-পড়াও যে করব না তাওতো বলিনি?
রাজন বলল, কিন্তু তোমার ব্যাপার দেখে তো সেরকমই বুঝায়।
তানভীর একটু গম্ভীর হল। মৃদু কন্ঠে বলল, কেন যেন পেরে উঠছিনা। ইচ্ছে আছে,উপায় আছে,সুযোগও আছে। তবুও কেমন যেন এক প্রকার শিথিলতার বশে হয়ে উঠছে না। অথচ বেশ বুঝতে পারছি লেখা-পড়ায় মনযোগ না দিলে এখানে বেশিদিন থাকা যাবে না।
রাজন বলল,তবে তাই কেন করনা?
তাবভীর জবাব দিল, পারলে তো তাই করি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তোমার মত হতে। কিন্তু এও বেশ জানি তুমি আলাদা। তোমার বিচার সংসারের আর দশজন সাধারন মানুষের সাথে চলেনা। তোমার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে অন্তিম শয়ানে শায়িত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সেখানে নানা প্রশ্নমালা উত্থাপিত হয়। সেখানে হুঙ্কার আছে,নতুনত্বকে বরন করে নেয়ার আনন্দ স্পৃহা আছে-নব সেতু বন্ধনের ব্যগ্রতাও আছে। আছে আনন্দ কল্লোল স্রোত উন্মাদনা। হৃদয়ের অভ্যন্তরীন যে ব্যগ্র সংগ্রাম-মৃত্যুকে অধীগম্য করে চলায় পথকে সহজ এবং সুগম করার যে মানসিক উন্মাদনা,তাও যথেষ্ট মাত্রায় আছে।তাই তোমার আর আমার এত ব্যবধান।
কথা শুনে রাজন কোমল একটু হাসল। বলল, তোমার কথাগুলি যে অভ্রান্ত সত্য, তা নয় । নিজে মদ খাই না, তাই হয়ত এর স্বাদও বুঝিনা। নিজে দু:খকে এড়িয়ে গিয়ে আনন্দ সাগরে ভাসতে সাহস পাইনা, তাই হয়ত এর গুরুত্বও উপলব্ধী করতে পারিনা। কিন্তু বিবেক আমার যাতে বাঁধা দেয়, তা আমি সব সময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি এবং বন্ধুকেও সেই পরামর্শই দেই।
তানভীর বলল,সে আমি জানি।
রাজন বলল, তবে বলি কি আবার লেখা-পড়াটা শুরু কর।চার দিন ধরে ভার্সিটিতে যাওনা, আবার যাওয়া শুরু কর।
তানভীর তেমনি জবাব দিলনা,চুপ করে রইল।
রাজন পুনরায় জিঞ্জাসা করল, কি হল যাবে তো?
তানভীর এবার সামান্য একটু হেসে রাজনের কাঁধ চাপড়ে বলল, দেখি, যেতেও পারি।
" দুই"
সংস্কৃতি ও প্রকৃতি মানুষকে যে আনন্দ দেয় বই মানুষকে সে আনন্দ দেয় না। আবার বই মানুষকে যে আনন্দ দেয় সংস্কৃতি ও প্রকৃতি মানুষকে সে আনন্দ দেয় না। কিন্তু উভয়ের মধ্যে যদিও বহু ব্যবধান তথাপি কোথায় যেন একটা মিল, একটা অন্তরঙ্গতা রয়েছে এবং এগুলিই যে বিনোদনের শ্রেষ্ট মাধ্যম বহু দিন ভেবে ভেবে তানভীর নিজেও এটা উপলব্ধী করতে পেরেছে।
প্রায় অন্ধকার আকাশ ক্রমেই স্বচ্ছ হয়ে আসছিল। কিন্তু বৃষ্টির উন্মত্ততা এতটূকুও কমেনি। সেই উন্মত্ত বৃষ্টি যেন তানভীরকে ক্রমশ আহবান করতে লাগল। বিছানা ছেড়ে উঠে এসে খানিকক্ষন জানালার ধারে দাড়াল। এরপর পায়ের সেন্ডেল খুলে বেড়িয়ে পড়ল পথে। বর্ষন সিক্ত পিচ ঢালা ফাঁকা পথটা তার মনে আজ অদ্ভুদ আনন্দের সন্চার করল। পথের ধারে কদম বৃক্ষটার পানে তাকিয়ে আপন মনে মৃদু হাসল। এরপর নিচে পড়ে থাকা একটি পূর্ন ফোটন্ত কদম হাতে তুলে নিল। আহ কি পরম সুখ! কি আনন্দ! জীবন যদি এমনি ভাবে চলত? উদ্যাম আছে-ক্লান্তি নেই, ভাবনা আছে-দু:খ নেই। সুখের ক্ষুদ্র অনুভুতি যদি বিশাল দু:খকে পরাস্ত করে ঠিক এমনিভাবে শ্রান্তিহীন পথ চলতে পারত! তানভীর জানে তা সম্ভব নয়। তবুও সে দু:খকে পাশ কাটিয়ে আনন্দ খুঁজে বেড়ায়। হোক সে ক্ষুদ্র, হোক সে সামান্য।............. চলবে
© সুজন মাহমুদ
বি:দ্র: আমি নামি কেউ নই, সমাজের সামান্যদের মাঝের একজন। শুধু শখের বশেই কিছুটা লেখালেখি করা, তাই ভুল-ভ্রান্তি মার্জনার দাবী রাখি। আলোচনা কিংবা সমালোচনা অবশ্যই কাম্য, কিন্তু অনুরুধ আমার এই লেখাটি কেউ কপি করবেন না, অথবা অন্য কোন সামাজিক ওয়েব সাইটে শেয়ার করবেননা।
ধন্যবাদ
সুজন মাহমুদ