আধো চাঁদের আবছা আলো তখন আকাশের নীলাভ স্তরের উপর একটা লালচে বেড কাভার জড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল। গতকাল এমন লালচে রঙ আমার চোখে পড়েনি। প্রতিদিন এসময়টায় আমি ঐ নদীর ধারের বট গাছের পাশে মানব সঙ্গহীন বসে থাকি। তবে গতকাল এখানে আসা হয় নি। তাই জোনাকীদের সাথে থাকা সবুজ আলোর ঝুলি সমেত দাপিয়ে বেড়ানোর দৃশ্য আমার দেখা হয়নি। ঝিঁঝিঁ দের অর্কেস্ট্রার শব্দ আমার কানে না আসার শূন্যতা বেশ করে তাই টের পাচ্ছিলাম। গত রাতে আমি একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আমার এক বন্ধুর ভাই এর বিয়ে। বন্ধুর ভাইয়ের বিয়ে নয় বরং আমাকে ঐ অনুষ্ঠানে টেনে নিয়ে গিয়েছিল পোলাও কোরমা। অনেকদিন খাইনা। খাবোই বা কি করে??? পকেটে একসাথে ১০০ টাকার বেশি দেখিনা অনেকদিন হল। তার উপর আছে সিগারেটের নেশা। রাতে নদীর জলে ওপারের ল্যাম্পোস্টের আলোয় রূপালি ঝিলিকে কি আর পেট ভরে?? তার জন্য টাকা লাগে টাকা। কিন্তু আজ আমি এখানে ঠিকই এসেছি। একদিন পর এসে মনে হচ্ছে যেন আমি নই ঐ জোনাকীর আর ঝিঁঝিঁরাই উল্টো আমাকে দেখে বেজায় খুশী হয়েছে। তাই জোনাকীর আলোর তেজ আর ঝিঁঝিঁদের অর্কেস্ট্রার শব্দ দুটোই যেন আজ একটু বেশিই মনে হচ্ছে।
একটা কবিতা লিখবো, গত সাত দিনে একটা কবিতাও লেখা হয় নি।। একটা গানও বুনতে পারিনি। ঐ মন্টু মিয়ার গ্যারেজের পাশে ভাঙ্গা ঘরটায় ৫০ টাকা ভিজিটে দেখা ডাক্তার কলিম আমায় নিষেধ করেছেন। আমি উনাকে কলিম চাচা বলে ডাকি। উনি বলেছেন আমার নাকি বেশ সিরিয়াস সাইনাসের সমস্যা আছে পাশাপাশি আমার চোখের পাওয়ারটাও বেড়েছে বলে উনি আশঙ্কা করে আমাকে একজন ভালো চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পরামর্শ দিলেন। চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে এখনও অব্দি যাওয়া হয় নি। যাই হোক কবিতাটা লিখে ফেলি।
আমার বন্ধু কে??
এই বটগাছ??
নাকি ঐ ওপাড়ের কুঁড়ে ঘরটা?
নাকি সেই বীভৎস মুখ যার
ভেতর ফুটে আছে অসংখ্য উজ্জ্বল দাঁত?
যার কপালের টিপ টা শোভা পাচ্ছে নাভিতে।
আমার বন্ধু কে??
আমার বন্ধু এই রাতের হলুদ বুনো ফুল
যার সুগন্ধ নেই, আছে অস্তিত্ত্ব
যা ঘরে শোভা পায় নি আজও
কিন্তু তার নাম এখন অব্দি ফুলই আছে।
ও বড্ডই অবহেলিত
কিন্তু ত্রুটি ওর ভেতর আমি খুঁজে পাইনি।
আমার বন্ধু কে???
সদ্য দেখা আলেয়াটা আমার বন্ধু হতে পারে না
ও আমার জন্য অপেক্ষা করে নি,
ও আমার কথা শোনে নি,
ও বড্ড স্বার্থপর,
নিজেরটা বেশ করে বোঝে।
আমার বন্ধু কে???
আমি জানি না কে আমার বন্ধু।
তবে ঐ মোটা জোনাকীটা যে উড়ছে
ঐ সবচেয়ে উঁচু স্বরে যে ঝিঁঝিঁটা গাইছে
এদের আমি খুব ভালবাসি,
হয়তোবা এরাই আমার বন্ধু।
বেশ আবেগে কবিতাটা লিখে নিজেকে একজন বেশ উঁচুমানের প্রকৃতিবাদি বলে ভাবতে শুরু করলাম। খানিকক্ষন চুপ থেকে ভ্রু দুটো কুচকে কবিতাটা কেটে দিলাম। এটা কোন কবিতা হল??? এটা তো ওই লাবুদের গোয়ালঘরের গরুটাও লিখতে পারতো যদি ওর হাত থাকত। ধ্যাত। কাগজটা একটা নৌকো বানিয়ে ভাসিয়ে দিলাম। কিন্তু নৌকোটা বেশ ভাল বেগেই চলছে। যেন এই কবিতা নিয়ে দূর দুরান্তে পাড় করতে পারলে বেঁচে যায় সে। বেশ অপমানবোধ হল।
একটা সিগারেট জ্বালিয়ে চেয়ে রইলাম ঐ ওপারে থাকা কুঁড়ে ঘরটার দিকে। আমার এখানে প্রতিদিন বসে থাকার প্রধান কারণ এই কুঁড়ে ঘরটা। এটা নিয়ে বেশ একটা ফ্যান্টাসি গত কয়েক মাস ধরেই চলছে। আজ অব্দি ঐ ঘরটা থেকে কাউকে বের হতে দেখিনি। আমার আশা ঐ ঘর থেকে একজন অপরূপা বের হবে, একজন মায়াবী চোখের ললনা। যাকে দেখেই আমি প্রেমে পড়ে যাব। কিন্তু আজ অব্দি একটা কুকুরকেও বেরুতে দেখিনি। তাই তো আশা আরও জোরালো হয়।
প্রতিদিন ওই ঘরে থাকা আমার কল্পনার অনাবিষ্কৃত মেয়েটাকে আজ অব্দি দেখিনি বলেই তো আশা আজো ভেস্তে যায় নি। একটা আশা তো থাকতেই হয়। নাহলে মানুষ আর বাঁচে কি করে?? আজ অনেক রাত হয়েছে।। যেতে হবে। কাল আবার আসবো। ঠিক ঐ আধো চাঁদের আবছা আলোর চাদর বিছানোর আগ মুহুর্তেই আসবো। এক রাশ আশা নিয়ে।। যদি সে কাল ঘরটা ত্যাগ করে বের হয়??