ডিম আগে নাকি মানুষ আগে?
না এমন কোন উদ্ভট প্রশ্ন আমাদের মাথায় খেলে না, অথচ আমরা মানুষের বাচ্চারাও প্রকারান্তরে সেই ডিম থেকেই পয়দা হই। মানুষের ডিম বলে আদতে কিছু নাই জানলেও, আসলে ডিম-হীন মানবী ভাবতেই আমরা সবাই ইইইইই করে উঠি! ডিম নিয়ে তাহলে আমরা চার লাইনের একটা ছড়াও পড়ে ফেলতে পারি।
ডিম দেয় ডিম্ববতী
ডিম পাড়ে ভাগ্য-মতি,
ডিম নাই যার
পোড়া কপাল তার!
মানুষের ডিম অথবা মানবীর ডিম এই শব্দটা লিখে আমি আসলে কাউকে ব্যাঙ্গ করতে চাইছি না। যেহেতু অতিরিক্ত দায় দায়িত্ব নেয়ার মতো ঘাড় আমার নেই, তাই এই লেখায় দয়া করে কেউ দুঃখ, কষ্ট, ইতরামির গন্ধ খোজে নেবেন না। আমরা মানুষের বাচ্চারা জন্ম মাত্র কান্না কাটি করে নিজের দাবী দাওয়া মিটিয়ে ফেলতে পারলেই সুখী হই। এর পরে জগতের যাবতীয় আশ্চর্যের মাঝে ঢুকে গিয়ে নিজের জন্মাশ্চরয নিয়ে জানার আর তেমন একটা ইচ্ছে রাখি না। আমাদের কাছে মেয়ে মানুষ মানে, মাসে একবার অশুদ্ধ রমণী। মেয়ে মানুষ মানে, ঘরে রেখে জিয়িয়ে রাখা প্রাণ, যেখানে সময়ে বীজ ঢেলে দিয়ে বাচ্চা বিইয়ে নেয়াই আমাদের কাজ। ভাগ্যিস মানুষের বাচ্চা পুরোটাই একটা ডিমের ভেতর থেকে পয়দা হয় না, না হলে আমরা জননীকে ডিম তা দেয়া অবধি পুছে চলতাম, আর পরেই বলতাম দেখি সরতো ভাল্লাগে না! মানুষের বাচ্চা বড়ো হতে বড়ো বেশি সময় নেয়, বড়ো বেশি, আর এই সময়টুকুন হাতে থাকাতেই, তার ভেতরে টিপে টিপে আদর মায়া মমতা ঢুকিয়ে দিতে পারেন আমাদের জননীরা।
ব্যক্তিগত কচকচানি বাদ দিয়ে, এবার আমরা সরাসরি চলে যাবো, আমাদের মাতৃ ডিমের সন্ধানে।
স্বাভাবিক বাজার মূল্যে মানুষের ডিম এর দাম ৫০০০ ডলার, ক্ষেত্র ভেদে সেটা ১০০০০ ডলার অব্ধি যায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই স্পেশাল মানবীরা তাদের ডিমের দাম হাঁকিয়ে ৫০,০০০ ডলার অব্ধি নিয়ে যান। ১৯৭০ এর দিকে মানবীর ডিম আদান প্রধান শুরু হলেও প্রথম দিকে সেটা ফ্রি ছিলো, কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে ৪০ বছরের মাথায় এটা হয়ে উঠছে এক বিরাট কমার্শিয়াল মার্কেট!
যখন সে এমনি এমনি ক্ষয় হয়ে যায়, অপেক্ষায় থাকে যুদ্ধজয়ী কোন সংগ্রামীর, কিন্তু দেখা না পেয়ে মুখ লাল করে চলে যায় পৃথিবী থেকে, তখন সে বড়ো বেশি অস্পৃশ্য। এতো বেশি অস্পৃশ্য যে, তাকে ছুঁয়ে দিলেই পাপ লেগে যায়, তার কথা ভাবলেই অনেকের ঘেন্না পায়, তাকে মনে করা হয় এক জ্বলন্ত অভিশাপ। তখন তার জননী হয়ে উঠেন স্বয়ং নরক, তিনি না দেবতার, না আল্লাহ্র। সকল কিছু থেকে তাকে সরে থাকতে হবে, কারণ না বিয়ানো একটা ডিম তিনি এক জগত থেকে চলে যেতে দিচ্ছেন। যেনো এ পাপ তার শুধুই একার, এ দায় আর কেউ নিবে না। অথচ এ দায় নেবার কেউ থাকলেও তাকে সেই অস্পৃশ্য জীবনই যাপন করতে হয়।
যাইহোক, আমরা ডিম্বানুভুতি সম্পন্ন মানুষ, তাই ডিমের ক্ষয়ে যাওয়াতে নানান ভাবে দুঃখ যাপন করি। কিন্তু আমাদের সেই জননী যিনি বয়ে নিয়ে আসেন তার জননী থেকে, যখন তিনি জন্ম নেননি, কয়েক মাসের ছিলেন মায়ের পেটে, তখন তার ভেতরে ঈশ্বর দিয়ে রাখেন এই বীজ। আমরা ডাকনাম হিসাবে তাকে ওগোনিয়া(oogonia) বলে ডাকি। এই ওগোনিয়ারা জননী জন্মানোর পরেই, মায়োসিস এর ভেতরে চলে যায়। সেখানে গিয়ে তারা প্রাইমারী ওওসাইট (primary oocyte) লেভেলে যায়, আর না হলে ধংস প্রাপ্ত হয়। প্রাইমারী লেভেলে গেলেই তারা চিহ্ন বিজ্ঞানের থামুন চিহ্নের সাথে পরিচিত হয়। আর থেমে থাকে। থেমে থাকে ঠিক ততকাল, যতকাল অবধি জননী, জননী হবার উপলব্ধি প্রাপ্ত না হোন। তাকে সেই উপলব্ধি এনে দেবার মুহূর্ত কালে থামুনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়ে ওগোনিয়া প্রাইমারী থেকে সেকেন্ডারি লেভেলে যায়, আর তখন ফেলো-সিল দ্বারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ে একজন মাত্র সেই ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। আর আমাদের জননীদের সেই নিষিদ্ধ সময় শুরু হয়। আমরা মানুষেরা তাকে এখনও ইশারা ইঙ্গিতের ভাষায় ডাকলেও, শিক্ষিতরা আর উপরতলার মানুষেরা বদলে গেছেন বলেই, সেই সময়কে নানান ভাবে ডাকা হয়। বলা হয়, মিন্স, সার্কেল, পিরিয়ড, মাসিক, রেগল ...........
অভারী থেকে বের হয়ে আসা সাহসী ওওসাইট এর সাময়িক এই জার্নিকে বলে অঁভোলশন। অনেক সময় একসাথে ২টা ও চলে আসতে পারে, তবে সেটা অনেক বিরল ঘটনা। এর মাঝে আবার mature হবার ধাপে গিয়ে ৩টা polar body হয়ে বাদ পড়ে যায়। বের হয়েই সে আসে ফেলো-পিয়ান টিউবে, সেখানে এসে যদি দেখা পায় সেই সাহসী স্পারমের সাথে তবে তখনই,সে তার দ্বিতীয় মায়োটিক লেভেল এর কাজ সেরে ফেলে। আমাদের ক্রমোজমিক কাজকারবার, এই সেই ইনি তিনি, মারামারি আদর সোহাগ করে তারা গড়ে তোলে আমাদের। আমরা ডিম থেকে হয়ে উঠি কোষের কারিগর। আর বলি না না ডিম হবে কেনো এই দেখো রক্ত রক্ত জমে জমে আমি হচ্ছি!
মানুষের ডিমই হচ্ছে শরীরের সব থেকে বড়ো কোষ। মুরগীর ডিমে ৮ টা পার্টস আর মানুষের ডিমে মাত্র চারটা!1.corona radiata, 2.nucleus, 3.cytolplsm,4.Zona pellucida । ৫০০,০০০ ডিম নিয়ে মানবীর জন্ম হলেও এক জীবনে অতো ডিম কাজে লাগানো হয় না! ৪০০-৫০০ ডিম দেয়ার ক্ষমতা একজন মানুষের হয় সারাজীবনে। ০.১২ মিমির ডিম থেকে এতো বড়ো শরীর পয়দা করে দুনিয়া জুড়ে ঘুরঘুর করতে আছি ভাবতেই অবাক লাগে।
আর যমজ বাচ্চা আসলে অনেকভাবেই হতে পারে। এটা ঠিক অঙ্কের মত। মায়ের ডিম্বাণুতে অর্ধেক ক্রোমোসোম থাকে, আর বাবার শুক্রাণুতে অর্ধেক ক্রোমোসোম থাকে। দুটো মিলে একটা সম্পূর্ণ মানুষের ক্রোমোসোম হয়। মানে .৫+.৫=১ । এখানে আবার প্রকৃতির বিশাল খেলা আছে। একটা ডিম্বাণুর সাথে শুধুমাত্র একটা শুক্রাণুরই মিলন হতে পারবে। না হলে দেখা যেতে .৫(ডিম্বাণু) +.৫ +.৫ (দুইটা শুক্রাণু) = 1.5 (!) মানে দেড়টা মানুষ! তা তো সম্ভব না। যদি কোনভাবে ডিম্বাণু দুইটা বের হয়ে আসে, ovary থেকে তাহলে দুইটা আলাদা শুক্রাণু দুইটা আলাদা ডিম্বাণুর সাথে মিলে দুইটা বাচ্চা তৈরি করতে পারে। (.৫+.৫)+(.৫+.৫)=২
আবার যদি একটা মাত্র ডিম্বাণু একটা শুক্রাণুর সাথে মিলিত হবার পর যখন কোষ বিভাজন করে বিশাল একটা বাচ্চা তৈরি করবে, তখন কোন রকমে মাথা গুলিয়ে গিয়ে একটা কোষ তৈরি করতে গিয়ে একই রকম দুইটা তৈরি করে ফেলে, তাহলেও যমজ বাচ্চা হবে। মানে .৫+.৫=১ হয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু ঐ ১ বিভাজনের মধ্যমে আরেকটা ১ তৈরি করলো। .৫+.৫=১, ১+১=২।
যাই হোক ডিম থেকে বাচ্চার দিকে যাবার তেমন খেয়াল আমার নেই। আমি আবারও ডিমেই ফিরে আসবো, তবে আর মানুষের ডিম নয় অন্য কোন প্রাণীর, অন্য কোন জননীর।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৪ রাত ১০:১৭