মহান আমেরিকা, গ্রেট আমেরিকা! খুব বেশী দিন আগে না ধরুন একশত বছর ও হয় নি, কিছু দুর্দান্ত সাহসী শিকারীর জন্ম হয়েছিল। মুলতঃ ফ্লোরিডা, লুইজিয়ানার মত দক্ষিনের জলাভুমি অঞ্চল রাজ্যে এদের সাহসিকতা দেখা যেত। এরা ছিল অসীম সাহসের অধিকারী !!! ভয় কাকে বলত এরা জানত না। সে সময় কুমিরের চামড়ার চাহিদা খুব বেড়ে গিয়েছিল, কারন টাকাওয়ালাদের পায়ের জুতো, প্যান্টের বেল্ট, অথবা মানিব্যাগে এই কুমিরের চামড়ার খুব চাহিদা ছিল। কুমির শিকার চাট্টিখানি ব্যাপার না। পৃথিবীতে সব প্রানীর বিবর্তন হয়েছে, বলা হয়ে থাকে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে কুমিরের পূর্ব পুরুষ যেমন ছিল আজো তেমনি একই হিংস্রতা নিয়ে এই প্রজাতিটি বেচে আছে। তো এহেন কুমির শিকার করতে মারাত্মক সাহসী পুরুষদের দরকার হয়। শুধু সাহস থাকলেই তো হবে না, সাথে থাকতে হবে বুদ্ধি। পানির কুমিরকে ডাঙ্গায় টেনে বন্দুকের গুলি মেরে হত্যা করা! পানি থেকে কুমিরকে ডাঙ্গায় উঠানোর জন্য কুমিরকে “টোপ” ইংরেজীতে যাকে বলে “বেইট” দেইয়া হত। এই টোপ হিসাবে ব্যাবহৃত হত ছোট ছোট কালো মানুষদের বাচ্চাদের।
নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম শুনছেন? রাইটার। অনেকেই হয়ত শুনেন নি। আচ্ছা “টেনিদা”র নাম শুনেছেন? এইবার হয়ত অনেকেই বলবেন হ্যা শুনেছেন। সেই বিখ্যাত ডায়লগ যার মুখে অহরহ উচ্চারিত হত "ডি-লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক" সেই টেনিদার স্রষ্টা নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়। অনেক আগে সেই নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের টোপ নামে একটা গল্প পছড়িলাম। গল্পটার প্লট এত ভয়াবহ ছিল যে সেটা আর মাথা দিয়ে বের হয় নি, গত দুই তিন দিন যাবত যখন এ্যালিগেটর বেইট নিয়ে অন্তর্জালে হাতড়াচ্ছিলাম মাথার মাঝে টোপ গল্পটা হানা দিয়ে যাচ্ছিল। শেষে অনেক ঝামেলা করে সেই গল্পটা যে বইতে আছে সেটা বের করলাম, বের করে আজকে অন লাইনে সার্চ দিয়ে দেখি অন লাইনেও সেটা আছে।
টোপ গল্পটা মুলতঃ একজন রাজাবাহাদুর এন আর চৌধুরীর গল্প। যিনি লেখককে তার বাঘ শিকার বাহাদুরি দেখানোর জন্য তার ষ্টেটে নিমন্ত্রন করলেন। প্রথম দু’দিন সারা রাত শিকারের অপেক্ষায় থেকেও বাঘের আর দেখা মেলে না, শেষ রাতে রাজা বাহাদুর মদ খেয়ে লেখককে নিয়ে শিকারের মাচায় উঠলেন, কিছুক্ষন পর কপিকলের সাহায্যে রাজাবাহাদুর টোপ নামিয়ে দিল, সে টোপ খেতে এক সময় বাঘ চলে আসে এবং টোপে থাবা চালিয়ে দেয়, রাজা বাহাদুর অব্যার্থ লক্ষ্যে গুলি চালিয়ে সে বাঘ কে হত্যা করে, এদিকে আবার কপিকলের সাহায্যে টোপ টাকে টেনে তোলা হল, লেখক অজ্ঞান হবার আগে প্রচন্ড আতংকে লক্ষ্য করেন টোপ আর কিছুই না সকালে রাজা বাহাদুরের উঠানে খেলারত তার হাউজ কীপারের কয়েকটা বেওয়ারিশ ছেলে দেখছিলো তার একটা। (গল্পটা চাইলে পড়ে আসুন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প – টোপ। )
এই টোপ গল্পটার প্লট এত অভিনব লাগছিলো যে আজ থেকে অন্তত বিশ বছর আগে পড়া গল্পটা মনের মাঝে গেথে আছে। এত দিন পর এলিগেটর বেইট নিয়ে যখন কিছু প্রবন্ধ অন লাইনে পড়ছিলাম, তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই মাথায় প্রশ্ন আসছে নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায় কি তার টোপ গল্পের প্লট কি তবে এই এলিগেটর বেইট কাহিনী শুনে পেয়েছিল?
১৮৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৩তম সংশোধনে অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে কাগজে-কলমে আমেরিকায় দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও, বাস্তবের চিত্রটা ছিল একদমই আলাদা। নামেই দাস প্রথার বিলোপ হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে আমেরিকায় দাস প্রথা ভালোই চলছিলো বিলোপের আড়ালে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিককার ঘটনা এগুলো সাদা চামড়ার ভদ্রলোকরা এই ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করলেও এক পর্যায়ে কিছু মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইতিহাসের নিষ্ঠূরতম দিকটি বেড়িয়ে আসে। এনিয়ে যারা কাজ করছে এমন একজন রিসার্চারকে অরল্যান্ডোর কাছাকাছি অবস্থিত ষ্ট্যানফোর্ড শহরের বাসিন্দা জানায় এই “এ্যালিগেটর বেইট” বা “গেটর বেইট” এর ব্যাপারে সে তার দাদার কাছ থেকে শুনছে। তারা নিগ্রো বাচ্চাদের মায়েরা যখন দিনের বেলায় কাজ করত অথবা অন্য কোন কাজে একটু এদিক ওদিক যেত তখনি ওত পেতে থাকা কুমির শিকারীরা বাচ্চা গুলোকে চুরি করত।
১৯২৩ সালে প্রকাশিত টাইম ম্যাগজিনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাচ্চা গুলোর বয়স থাকত এক বছর বা এর আশেপাশে, বাচ্চাগুলোকে চুরি করেই এক টানে জলাভুমিতে কোন নির্জন স্থানে মুরগীর বাচ্চার মত রেখে দিত। রাত হলেই বাচ্চাগুলোর হাতে বা গলায় দড়ি দিয়ে বেধে অগভীর জলায় নামিয়ে দিত। প্রানের আতংকে শিশুগুলো চিৎকার দিতে থাকত। এক পর্যায়ে এই সব বাচ্চার চিৎকার বা দাপাদাপিতে কুমিরগুলো গভীর পানি থেকে তীরের দিকে আসত। ওদিকে বীর কুমির শিকারী সুবিধা জনক স্থানে বন্দুক নিয়ে বসে থাকত। কোন কোন ক্ষেত্রে বাচ্চাটার কপাল ভালো হলে কুমির এসে বাচ্চার সামনে থেমে যেত আর শিকারী গুলি করে কুমিরটাকে হত্যা করত।
তবে সব বাচ্চার কপাল এত ভালো হত না, কোন কোন কুমির এক টানে দৌড়ে এসে বাচ্চাটাকে কামড় দিয়ে মুখের মাঝে নিয়ে যখন খেতে শুরু করত তখন কিছুটা স্থির হলেই শিকারী গুলি করার সুযোগ পেত আর গুলি করে কুমিরটাকে মেরে ফেলে তারা দামী চামড়া সংগ্রহ করত। হতভাগ্য শিশুটি তখন হয়ত আধা খাওয়া অবস্থায় কুমিরটির মুখের মাঝে থাকত। শিকারীদের ভাষায় কুমির শিকারের জন্য এই সব নিগ্রো শিশুদের “পিকানিন্নিস” বলা হত। এরা মানুষ নামের তুল্য ছিল না।
আবার এই সব “পিকানিন্নিস”দের অনেক সময় পাওয়া কঠিন হয়ে যেত সেক্ষেত্রে ব্যাবসায়িক ভিত্তিতে তাদের সরবরাহ করার জন্য তাদের মা বাবাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হত, শিশুটির মুল্য বাবদ তার মা বাবাকে দুই ডলার দেয়া হত।
বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এই বিষয়টিকে আড়াল করার চেষ্টা করা হলেও, একাধিক সূত্রে ইতিহাসের পাতা থেকে এসব তথ্যের যথার্থতা নিশ্চিত করা গেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম একটি সূত্র হলো, মিশিগানের ফেরিস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অবস্থিত জিম ক্রো মিউজিয়াম। সেখানে সংরক্ষিত বিভিন্ন হাউজ আর্টিফ্যাক্টস (পোস্টকার্ড, নিকন্যাক, প্রোডাক্ট প্যাকেজিং ইত্যাদি) দেখলে বোঝা যায়, বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আমেরিকান পপ কালচারে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্বরতা কতটা গভীরভাবে মিশে গিয়েছিল। ফ্লোরিডার এক বাসিন্দার বাড়ীতে একটা ছবি পাওয়া যায় যেখানে দেখা যায় নয়টি “পিকানিন্নিস”। নীচে লেখা “এলিগেটর বেইট”।
১৯০৮ সালের ১৩রই জুন ওয়াশিংটন টাইমসের প্রতিবেদনে দেখা যায় সেখানে কিভাবে নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কস জুওলোজিক্যাল গার্ডেন এর রেপটাইল কীপাররা দুটো “পিকানিন্নিস” ব্যাবহার করে উইন্টার ট্যাংক থেকে সামার ট্যাংকে স্থানান্তর করে। হেড কীপার স্নাইডার কিভাবে তার সহকারী টমি কে নিয়ে দুটো পিকানিন্নিস বা এলিগেটর বেইট ব্যাবহার করে ২৫ টি কুমিরকে তাদের শীত কালীন আবাসস্থল থেকে গরম কালীন নিবাসে স্থানান্তর দর্শকদের সামনে করছে তার বেশ সুন্দর বর্ননা দেয়া আছে। দুটো মানব শিশুকে (যদিও সেকালে এদের মানব শিশু বলা হত না, এরা ছিল পিকানিন্নিস) ব্যাবহার করে ২৫ টি হিংস্র কুমিরকে কিভাবে প্রলুদ্ধ করে বোকা বানানো হয় তার বেশ রসিয়ে বর্ননা দেয়া আছে।
এই সব গেটর বেইটসদের নিয়ে আবার গান বানানোও হতঃ
[Chorus]
Hush-aby, don’t yo’ cry,
mammy’s little piccaninny’s gwine to get a present mighty soon,
When de stars am a-peepin’ and de moon it am a-creepin’
den yo’ mammy’s gwine to sing ‘dis tune,
Shut yo’ eye bye and bye,
mam will whip yo’ if yo’ cry,
Someone am a-comin’ thro’ de gate;
Go to sleep, don’t yo’ peep,
listen to me tell yo’,
yo’s mammy little alligator bait.
সময় পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু মানুষের নির্মমতা কি কমেছে? হয়ত এখন আগের মত খোজা করন বা এ্যালিগেটর বেইট হিসাবে শিশুদের ব্যাবহার করা হয় না, কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে কি নির্মমতা কি উঠে গেছে? আমার কাছে মনে হয় যত দিন যাচ্ছে সভ্য হবার নামে আমরা আরো নির্মম হচ্ছি। হয়ত ধরন টা পরিবর্তিত হয়েছে।
এই লেখাটা লিখতে গিয়ে কেন যেন অনেক অনেক আগে রিচার্ড কনেলের লেখা “দ্য মোষ্ট ডেঞ্জারাস গেম” গল্পটার কথা মনে পড়ে গেল। যেখানে গল্পের নায়ক রেইনসফোর্ড জাগুয়ার শিকারে গিয়ে এক রাশিয়ান জেনারেল জ্যারফের হাতে পড়ে তার নির্জন দ্বীপে। সেখানে জেনারেল জ্যারফ এর কাজই হল যে বা যারাই জাহাজ ডুবিতে তার দ্বীপে আশ্রয় নেয় তাকে সে খাবার দিয়ে চাঙ্গা করে কয়দিন পর জঙ্গলে ছেড়ে দেয় কথা থাকে তিন দিন যদি সে জেনারেলের হাত থেকে বেঁচে থাকতে পারে তবে সে মুক্তি পাবে। তবে আজ পর্যন্ত কেউ জেনারেল জ্যারফের শিকার হওয়া থেকে বেচে থাকে নি। শেষ পর্যন্ত রেইনসফোর্ড অবশ্য জ্যারফ কে হত্যা করতে সমর্থ হয় তবে সে এক দারুন কাহিনী। কেন যেন খুব ইচ্ছা করে এই সব পিকানিন্নিস গুলো যদি ওই সব অমানুষ শিকারীগুলোকে কুমিরের বেইট বানিয়ে নিজে শিকারী হয়ে বসে থাকতে পারত তবেই যথার্থ বিচার হত।
চাইলে কেউ এক নজর ছোট্ট ইউটিউব থেকে ঘুরে আসতে পারেন
ছবিঃ অন্তর্জাল। সূত্রঃ লেখার বিভিন্ন স্থানে নীল রংয়ের শব্দগুলোতে লিংক দেয়া আছে যেখান থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০২০ রাত ১২:৩৫