পড়াশুনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সবচেয়ে মজার উপদেশ বাণী শুনেছিলাম মিলিটারি একাডেমীতে এক কোর্সমেট এর বাবার কাছ থেকে। ভদ্রলোক আর্মি ইঞ্জিনিয়ার্সের মেজর, ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপরে অনেক পড়াশুনা করতে হয়, ভালো না করলে মেজর অবস্থাতেই আটকে যেতে হয়। উনি ছেলেকে উপদেশ দিচ্ছিলেন-“মন দিয়ে পড়াশুনা কর, নইলে আমার মতো অবস্থা হবে। পৃথিবীতে দুজন লোকের কখনো প্রমোশন হয়না। এক আমার আর দুই মাসুদ রানার”। উনি হেসে জানালেন। আমি যখন তোমাদের বয়সী ছিলাম তখন মাসুদ রানা পড়তাম। সে ছিল পাকিস্তান আর্মির মেজর। এখন আমি মেজর হইছি। ভদ্রলোক এখনো মেজর। অনেক বছর ওদের সাথে যোগাযোগ নাই। ঐছেলে চাকরীতে যদি থাকে তাহলে, মেজর এর শাপলা র্যাাঙ্ক ব্যাজ কাঁধে ঝুলানোর অনেক দিন হয়ে যাবার কথা। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টালিজেন্সের দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা মাসুদ রানা এখনো মেজর। এখনো তরুন, এবং সমান ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গক্রমে মাসুদ রানা সম্পর্কে আরেকটা মজার ঘটনা বলি। ঘটনাটা হয়েছিল বাংলাদেশের এডভেঞ্চারগুরু বলে পরিচিত আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার এবং ডুবুরী সদ্য প্রয়াত কাজী হামিদুর রহমানের সাথে। উনি একবার স্কুবার যন্ত্রপাতি এবং তার শিষ্যদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুলে প্রাকটিস করছিলেন। একজন সৌম্য বয়স্ক ভদ্রলোক তাদের যন্ত্রপাতি দেখে এগিয়ে এসে খুব উতসাহের সাথে খুটিনাটি জিজ্ঞেস করছিলেন, কোনটার কি কাজ, কোনটা দিয়ে কি করে। আগ্রহী শ্রোতা দেখে হামিদ ভাইও খুব আগ্রহ নিয়ে বোঝাচ্ছিলেন। ভদ্রলোক লাস্টে জিজ্ঞেস করলেন-আপনার সাগর তলে ডুব দেবার আগ্রহ হলো কিভাবে? হামিদ ভাই নিঃসঙ্কোচে উত্তর করলেন, আগ্রহ হয়েছিল মাসুদ রানার বই পড়ে। ছোটকালে মাসুদ রানার বইতে পড়েছিলাম, মাসুদ রানা সাগর তলে ডুব দেয়, দারুন রোমাঞ্চের ব্যাপার। সেই থেকেই শখ ছিল। সেই আগ্রহী ভদ্রলোক উত্তর শুনে অনেক হাসলেন। হেসে জানালেন, উনার নাম কাজী আনোয়ার হোসেন, উনি মাসুদ রানার লেখক।
উপরের গল্প দুটো আসলো এমনি এমনি। মাসুদ রানা ক্লাসিকের পর্যায়ে চলে গেছে, তাকে নিয়ে বলার কিছু নেই। বলার আছে সেবা প্রকাশনী নিয়ে। সেবার সবচেয়ে আকর্ষনীয় জিনিস ছিল তাদের অনুবাদ সাহিত্য। বাংলাদেশের সুশীল’রা নাক উচু করে, কিন্তু সেবা না থাকলে হেনরী রাইডার হ্যাগার্ড, জুলভার্ন, এইচজি ওয়েলস কারো মজাটা টের পেতাম না। পরে একই বই মুল ইংরেজীতে কিংবা কলকাতার অনুবাদ পড়েছি, কেমন ম্যাড় ম্যাড়ে লাগে। অন্যদের কি অবস্থা জানি না, অধ্যাপক কবির চৌধুরী ছাড়া কারো অনুবাদই টাচ করতে পারে নি, কলকাতার গুলো নির্দিধায় বলতে পারি অখাদ্য। প্রতিবার বইমেলায় সেবা থেকে কিশোর ক্লাসিক কিংবা অনুবাদ সিরিজের বইগুলো কিনি। গতকালকেও অনেক গুলো কিনেছি। কিন্তু লাস্ট কয়েকবছর থেকে মনে হচ্ছে সেবা পৃষ্ঠা বাঁচানোর আন্দোলনে নেমেছে। লেখক একই আছে। কিন্তু বইএর সাইজ নিতান্তই রোগা পটকা। সেবা কমদামে বই বিক্রি করে, কিন্তু কালেকশানে রাখার জন্যে দামি কাগজে আর বোর্ড বাঁধাই বই করে তাদের আরেক ব্যানার প্রজাপতি প্রকাশন। কিন্তু ইদানিং তাদের কোন উচ্চবাচ্য চোখে পড়েনা। ছোটবেলার প্রিয় বই কাজী আনোয়ার হোসেনের “রবিনহুড” এরও একই দশা। বই এর পৃষ্ঠা সঙ্খ্যা কমানো, মনে হচ্ছে, সেকারনে ওরা গল্পটাকেও কেটে ছেটে রাখছে। সেবার অনুবাদ এর মজার জিনিস ছিল ওরা সরাসরি অনুবাদ না করে রুপান্তর করে, যে কারনে জুলভার্নের এড্রিফট ইন দ্যা প্যাসিফিক হয়ে যায় সামসুদ্দিন নওয়াব (কাজী আনোয়ার হোসেনের ছদ্ম নাম, উনার ডাক নাম নওয়াব, সুত্র-কাজী মোতাহার হোসেনের আত্মজীবনী) এর নোঙ্গর ছেড়া, থ্রিলীগস আন্ডার দ্যা সী হয়ে যায় সাগর তলে। এবং ক্যাপ্টেন নিমোর চরিত্রটা অচেনা অজানা কোন ডুবো জাহাজের রহস্যময় ক্যাপ্টেন না হয়ে খুব চেনা জানা এক চরিত্র হয়ে যায়। বইমেলা থেকে মবিডিক কিনলাম, রাইডার হ্যাগার্ডের স্টেলা, মুন অফ ইজরায়েল, কুইন শেবা’র ট্রেজার। সবগুলো পড়ে মনে হচ্ছে একটা আস্ত উপন্যাসের ছোট গল্প সাইজের উপন্যাস পড়ছি। এই বইগুলোই ছোটবেলাতে পাঠ্যবইএর আড়ালে লুকিয়ে পড়ে এত মজা পেতাম। সেটা অনেকখানি অনুপস্থিত।
বইমেলায় আমার আরেকটা প্রিয় দোকান সন্দেশ। এমনি সময়েও সন্দেশের আজিজের দোকানটাতে প্রায় সময়ই ঢু মারতাম। ওদের অনুবাদের কোয়ালিটি সেবার মতো জমজমাট না হলেও কলকাতার রদ্দিমার্কা অনুবাদের চেয়ে হাজার গুনে ভালো। ছাপার কোয়ালিটি, কাগজের মান বাঁধাই তুলনামুলক ভালো। ইদানিং সন্দেশে ঢু মারতে ভয় লাগে, ওদের দামের কারনে। হোয়াইট মুঘলস আমার খুব প্রিয় বই। বইটা সংগ্রহে রাখা দরকার। দাম দেখি সাড়ে আটশ টাকা। ওদের অন্যবইগুলো যেগুলো আগে থেকে সংগ্রহে আছে, সেগুলোতে চোখ বুলালাম, কয়েকবছরে দাম মনে হয় লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এটা ব্যাবসায়ীক ব্যাপার কিছু বলার উপায় নেই। উইলিয়াম ড্যালরিম্পল বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় হচ্ছেন বোঝা যায়। কিছুদিন আগে প্রথম আলোর সাহিত্য পাতাতেও তার উপরে অনেক কাজ কর্ম স্বাক্ষাতকার দেখেছি। উইলিয়াম ড্যালরিম্পলের অনেক গুলো বই ছোখে পড়লো, বিশেষ করে দিল্লীতে আত্মজীবনী টাইপ একটা লেখা, টাকা শেষ হয়ে যাওয়া কিনতে পারলাম না। নেক্সট দিন বই মেলায় কিনবো। প্রিয় সাইফাই লেখক আসিমভের আজাজিল এর বঙ্গানুবাদ চোখে পড়লো। মুল বইটা পিডিএফ এ চুরী করে পড়েছিলাম গতবছর। বাংলাতে না পড়লে শান্তি হয় না। একটাই কপি অবশিষ্ট আছে দোকানে, তাও ছেড়া ভেড়া। সেলাই এর সুতো খসে পড়ছে। দোকানদার জানালো ওদের কাছে আর কোন কপি অবশিষ্ট নেই, এমনকি আজিজে বা বাংলাবাজারের অফিসেও নেই। কেনা হলো না।
আমার কবিতা পড়ার অভ্যাস কম। মুল কারন বুঝিনা, আর আধুনিক কবিতা ব্রেনের উপর দিয়ে পিছলে চলে যায় নিয়মিত করে কবিতা কেনা হয় সেটা জসীমুদ্দিনের। শুধু কবিতা কেন, কাব্যউপন্যাস সোজন বাদিয়ার ঘাট আমার সবচেয়ে প্রিয় বইগুলোর একটা, ছোট গল্প, উপন্যাস- জসীমউদ্দিনের তুলনা জসীমউদ্দিনই। আলাদা ভাষারীতি, সহজ সরল মিষ্টি কাহিনী ভালো লাগতে বাধ্য। আর যে কারনেই জসীমউদ্দিনের উপন্যাস অবলম্বনে বানানো বেদের মেয়ে জোছনা এখনও বাংলাভাষার সবচেয়ে ব্যাবসাসফল সিনেমা। জসীমউদ্দিনের বই শুধু একটা দোকানে পাওয়া যায়, পলাশ প্রকাশনী। জসীমউদ্দিনের উত্তরাধিকারীদের কোম্পানী। তাদের ব্যাবসাবুদ্ধী সম্পর্কে আমার দ্বীধা আছে। নিম্ন মানের কাগজ, নিম্নমানের বাধাই আর প্রিন্ট, এবং প্রাগৈতিহাসিক অলঙ্করনে ছাপানো বইগুলো কিনতে হয় শুধু জসীমুদ্দিনের কারনে। বইগুলোর আয়ুও হয় অল্প কবছর, ছিড়ে যায়, পাতা হারিয়ে যায়, আবার কেনা লাগে সংগ্রহে রাখতে। কি সমস্যা দাম বেশী করে একটু ভালো বাধাইতে ভালো কাগজে ছাপালে, যে দাম ওরা রাখে, ঐদামেই পাঠকদের কাছে ভালো কোয়ালিটির বই দিতে পারে। পল্লীকবি আমাদের জাতীয় সম্পদ, যদিও তাঁর বই এর স্বত্ব তার উত্তরাধিকারদের পলাশ প্রকাশনীর কাছে। তারা কেন এখনও খুচরা আলাদা আলাদা বই বিক্রি করতে উতসাহী কারনটা মাথায় ঢোকেনা। জসীমউদ্দিনের কাব্য সমগ্র, উপন্যাস সমগ্র বা জসীমউদ্দিন রচনাবলীর জন্যে আমরা আরো কত বছর অপেক্ষা করবো জানি না। নিঃসন্দেহে জসীমুদ্দিন রচনাবলী মার্কেটে এলে হটকেকের মত বিক্রি হবে। রবীন্দ্ররচনাবলীর কথা বাদ দেই, দুই তিন বছর আগে সত্যজিত সমগ্র (নালন্দা), কিংবা সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী বের হয়েছিল, বই মেলার আটাশ দিনেই তাদের সব কপি বিক্রি হয়ে গেছে বলে শুনেছিলাম।
বই মেলায় এবার আরেকটা মজার জিনিস দেখলাম, বাংলা বইএর প্রচ্ছদ আর অলঙ্করন শিল্পে বিশাল একটা পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। যেটা পজেটিভ, নেগেটিভ ব্যাপার বই এর বাধাই (ছাপা নয়, বাইন্ডিং) এর ব্যাপক অবনতি হচ্ছে। বেশীর ভাগ মানুষই বই পড়ে শুয়ে শুয়ে, প্রকাশক’রা মাথায় রাখতে পারেন। ট্যাব কিংবা বুক রিডার দ্রুত মার্কেট দখল করেছে, কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশে বই ব্যাবসায় খুব বেশী প্রভাব ফেলেছে মনে হয় না। কারন আমাদের আছে ফেব্রুয়ারী মাসের গৌরবের আটাশ দিন।
শেষ কথা ঢাকায় মেলা জিনিসটা খুব জনপ্রিয়, হাড়িপাতিলের মেলা (বানিজ্য মেলা), কম্পিউটার মেলা কিছুদিন আগে টয়লেট মেলাও হয়েছিল। অবাক হয়ে বিশ টাকা টিকেট করে ঢুকে দেখলাম কমোড আর পানির ট্যাপের মেলা, সেটাতেও লোকে লোকারণ্য। কিন্তু শুধু বই মেলার সময়ই বলে মহান গ্রন্থমেলা, পরিবার বন্ধুবান্ধব জমাট আড্ডা আর নতুন বইএর আনন্দ। হরতাল অবরোধ হলে ৩১ দিনের বানিজ্য মেলার সময় বাড়ে, একবারও দেখলাম না, আটাশদিনের বইমেলার সময় বাড়ে।
ওহ আরেকটা জিনিস মনে পড়লো, বইমেলায় ঘাড় বাঁকিয়ে সেলফি তোলার দৃশ্য অনেক বাড়ছে। আগে চোখে পড়ে নাই এই দৃশ্য।