আগের পর্বঃ Click This Link
লাইরামপি পাড়ার ঢালটা আস্তে আস্তে উঠে গেছে, ওপাশে গিয়ে ধপ করে নেমে গেছে। অর্থাৎ যাবার সময় আস্তে আস্তে কষ্ট হয় আর ফেরার পথে একবারেই কষ্টটা হয়। কয়েকদিনের টানা বর্ষনে পুরা রাস্তা কর্দমাক্ত আর ভয়ানক পিচ্ছিল। সাবধানে চলতে হয়, নইলে আছাড় খাবার সমুহ সম্ভবনা।
লাইরামপি পাড়া থেকে নেমেই ঝিরি পেলাম। ঝিরির পানি সবসময় গোড়ালী ডুবে কি না। এবার বর্ষায় দেখি অনেক জায়গাতেই কোমড় পানি, কোথায় কোথায় বুক পানি। আর সেকি টান। পাড়লে টেনে নিয়ে যায়। চারপাশের লতানো ঘাস গুলো রাতারাতি বিশাল জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। ঝোপ ঝার ভেঙ্গে চলা শুরু হলো। উপরে তাকিয়ে স্তম্ভিত। পাহাড়ের গায়ে গায়ে জুম হচ্ছে। সবুজের অনেক গুলো শেড, আর আকাশে কালো মেঘ পেচিয়ে আসছে। পাহাড়ের গায়ে অদ্ভুত সব ছায়া। এখুনি বৃষ্টি নামবার তোড় জোড়। আমরা দ্রুত পা চালালাম। একটু পড়েই ধুম বৃষ্টি নামলো। আর বৃষ্টির সাথে সাথে ঝিরির পানি বাড়তে লাগলো লাফিয়ে লাফিয়ে। বিস্তৃর্ন পাহাড়ের কোথাও হালকা বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের গা ঘেসে, ঝর্না বা এভাবে পানি নেমে ঝিরি গুলো করে। আমাদের এখানে হয়তো শুকনা দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু ঝিরি ফুলে ফেপে অস্থির হয়ে যায়। কোমড় পানিতে নেমে পথ চলা শুরু। পায়ের নিচে পিচ্ছিল পাথর। ভয়ঙ্কর স্রোত ঠেলে হাটতে শুরু করলাম।
ঝিরির পথটাই কেওকারাডং যাবার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাস্তা। অবশ্য মুংলাই পাড়ার রাস্তা দিয়ে এবং আরেকবার থানছি দিয়ে অপ্রচলিত একটা ট্রেইল দিয়েও গিয়েছি। কিন্তু ঝিরির পথের এই অবস্থা দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কখনো হয়নি। পাহাড়ি ঢলে ফুলে ফেপে একাকার। ২৫জনের দল বার বার ছেড়া ভেড়া লেগে যায়। একদল অনেক এগিয়ে গেল তো আরেকদল অনেক পিছিয়ে। আমরা বগামুখ পাড়ায় এসে একটু বিশ্রাম। পথের আদ্ধেকখানি আসা হয়েছে। বগামুখ পাড়া মারমাদের গ্রাম। একটা টং দোকানে আমরা চিত হয়ে গেলাম। দোকানী দিদি গরম চায়ের সাথে ওভালটিন মিশিয়ে দিলেন। মারমারা একসময় এ অঞ্চলের অসীম প্রতাপে শাষন করতো। ইতিহাসের বইতে মগদের কথা আছে। প্রায়ই নেমে আসতো পাহাড় থেকে। মাঝে মাঝে ঢাকা পর্যন্ত হানা দিত। পুর্তুগীজরা স্বন্দীপে দুর্গ করলে আরো অপ্রতিরোদ্ধ হয়ে যায় মগ (মং)রা। ইতিহাসের বই বলে মীর জুমলা (গুলিস্তানের কামানের আসল নাম মীরজুমলার কামান) পুর্তুগীজদের লোভ দেখিয়ে তাদের পাইরেট কিং গঞ্জালেভসের বিরুদ্ধে নিয়ে যায় আর মগদেরকে লোভ দেখিয়ে দলে টানেন। প্রথমবারের মতো চাঁটগা বা চাঁটিগা বাংলার অংশ হয়ে যায়। মীরজুমলা নাম রাখেন ইসলামাবাদ। যাই হোক বান্দারবানে অনেক অঞ্চলেই মারমা ভাষা মাধ্যমিক ভাষা হিসাবে ব্যাবহৃত হয়। বম, তঞ্চংগ্যা, মুরং অনেক গুলো ভাষা। কিন্তু এক গোত্রের লোকেরা আরেক গোত্রের ভাষা না বুঝলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সবাই মারমা জানে। আমার মারমা জ্ঞান একটা শব্দের। স্কুলে এক মার্মা বন্ধু ছিল হ্লাচিং মং ওর কাছে শিখেছিলাম, মিউ মানে বান্দর।
বগা মুখ পাড়া থেকে বেড়ুনোর আগে সারা গায়ে কষে অডোমস মেখে নিলাম সবাই। বর্ষাকাল জোঁক আর ম্যালেরিয়ার সময়। আর আছে হাতি পোকার অত্যাচার। ছোট ছোট মাছির মতো পোকা।কোন ক্ষতি করে না কিন্তু সাংঘাতিক জ্বালা করে। রোয়াংছড়িতে সিপ্পি আরসুয়াং পর্বতের চুড়ায় উঠার সময় হাতি পোকার অত্যাচার হারে হারে টেরপেয়েছিলাম। এখান থেকে সাইকত পাড়া (বাংলাদেশের সবচেয়ে উচু পাড়া, কাগজে কলমে) যাবার রাস্তা আছে একটা। বগামুখ পাড়া থেকে বেড়িয়ে গতি আরো স্লথ হয়ে গেল। উপরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। পানি বেড়েছে ভয়ঙ্কর ভাবে। মাঝে আরেকবার ঝুম বৃষ্টিতে ভিজেছি সবাই মিলে। পিছের পার্টি অনেক পিছে। একটা বাঁকে বসে সবাই মিলে আড্ডা বাজী করছিলাম পাথরের মধ্যে বসে। হাটু পানিরও কম এখানে। মাসুদ ভাই কি মনে করে যেন ওখানে শুয়ে পড়লেন। এই উচ্চতার পানি, কিন্তু টানতে টানতে তাকে নিয়ে যাচ্ছিলো। মজার খেলা। সবাই কিছুক্ষন হাটু পানিতে অটো সাঁতার দিলাম।
ঝিরি থেকে যেখানে উঠতে হয় ঐ জায়গাটা নিরেট পাথুরে। শ্যাওলা, পাতা আর বৃষ্টিতে ভিজে ভিষন পিচ্ছিল। কিন্তু হতবম্ভ হয়ে গেলাম ঝর্নাটা দেখে। ভয়ঙ্কর গর্জন করে নিচের গর্তে পড়ছে। বর্ষাকালে প্রান পেয়ে কি সেই রুদ্র রুপ। উপর থেকে নিরট পাথরের নিচু নিচু ট্রেইল ধরে রোলার কোস্টারের মতো পানির রেখা। প্রকৃতির রুদ্র সৌন্দর্য সবাই সব ভুলে চুপ মেরে গেল। সিয়াম (আলেক্স) পিছের গ্রুপের সাথে। আর মুন সামনের গ্রুপের সাথে। রাস্তা সব গুলো ট্রেইল একই রকম। ভুল করে একটা পাহাড়ে উঠে দেখি এটা জুম ক্ষেত। দ্রুত সন্ধ্যা নেমে আসছে। বগা লেকের দিকে উঠতে গিয়ে সন্ধ্যার শেষ আলো একদম নিভু নিভু। কিন্তু সব ভুলে থেমে যেতে হলো। পিছে পাহাড়ের বুকে নদীর মতো একে বেকে যাচ্ছে সাদা সাদা মেঘ। কিছু কিছু আমাদের লেভেলে কিছু কিছু অনেক নিচে। স্বর্গিয় একটা অনুভতি হয়।
আলো ডুবে গেলে হেডলাইট জ্বালাতে হলো। চাঁদ মামা আড়ি কষেছেন। মারমা পাড়ার পাশে একটা ঝর্নার মতো আছে। সলিড একটা রক ৪৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে পড়ে আছে। সলিড রক তাই শুকনা মৌসুমেই এই অংশটা পেরুতে কষ্ট। এখন দেখি রকের উপর থেকে গতিময় পানি নামছে। এই অংশ পেরুতে হলো দড়ি টাঙ্গিয়ে।
দূরে বগা লেকে সিয়াম দিদির ঘর, লারামের ঘর, গীর্জার আলো স্পষ্ট হতে লাগলো। পথে একবার ক্যাড়া সাপ (পাতার রঙের হয় খুব ছোট সাপ, বমরা বলে ক্যাড়া, শুনেছি বিষাক্ত) চোখে পড়েছিল। হাউ কাউ করার চেষ্টা করেছিলাম। টুটু ভাইএর ধমকে চুপ করে যেতে হলো। বগা লেকে সিয়াম দিদির উঠোনে ব্যাগ পেক রেখে কাপড় ছাড়ছিলাম। মোজার উপর থেকে একটা গিরগিটি বের হতে দেখে চুপ করে গেলাম টুটু ভাইয়ের ভয়ে। গলায় গামছা ঝুলিয়ে এক লাফে বগা লেক। সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই উবে গেল।
লাইরামপি পাড়ার পর থেকেই ট্রেক শুরু হলো
ঝিরির পথে...
ঝিরির পথে নলখাগড়ার/বেতের জঙ্গলে
সন্ধ্যা বেলায় মেঘের কোলে
মেঘের চাদর ফুরে বগালেকে উঠে আসছে ব্লগার নিরব আর আলেক্স বম
বর্ষায় সবুজ বগা লেক
লাইরামপি পাড়ার পরে ঝুম বৃষ্টি নামার আগ মুহুর্তে
বগালেক
বগামুখ পাড়ার পরে ঝিরির পথে। ফটোগ্রাফার তারেক (সামহোয়ারে নিকঃ নিরব) ভাই।
ঝিরির পথে। ফটোগ্রাফার তারেক (সামহোয়ারে নিকঃ নিরব) ভাই।