শেয়ালের প্রতিকী ছবি- 'নব্য ছাগু'
কেহ ইহাকে স্যাটায়ার বলিয়া অভিযুক্ত করিলে আমার কুনু দোষ নাই, ইহা কেবল-ই একটা সুখপাঠ্য সাহিত্য মাত্র যাহার কারো সাথে কোন ধরনের যোগাযোগ অথবা সংশ্লিষ্টতা নাই। যদি কেহ সংশ্লিষ্টতা খোঁজেন তাইলে পিলিজ নিজ দায়িত্বে খুঁজিবেন, লেখক কোন দায়ভার গ্রহন করিবেন না।
এক জঙ্গলে খুবই ধূর্ত তিনটা শেয়াল ছিল। ধুর্ততাই বোধ করি তাদের একত্রিত হবার মূল কারন। অন্যান্য শেয়ালদের মত অক্লান্ত পরিশ্রম করে জঙ্গলে খাবার সংগ্রহ করাটা তাদের নিকট ছিল রীতিমত বিরক্তিকর। আর তাই এই বিরক্তি এবং অক্লান্ত পরিশ্রম থেকে পরিত্রান পেতে চুরি বিদ্যাটা তাদের নিকট অধিকন্তু শ্রেয় মনে হয়েছিল, এবং তাহারা ইহাতে বেশ পারদর্শিও ছিল। অন্যের খাবার চুরি করে অথবা খাবার চুরি করতে প্রায়ই তারা জঙ্গলের পাশের গ্রামগুলোতে রাতের বেলা ঢুঁ। কেউ কিচ্ছুটি জানতেও পারত না। অন্যান্য দিনের মত, একদিন রাতে তারা আবারো গ্রামের এক রঙওয়ালার মুরগীর ঘরে হানা দেয়। শেয়ালদের এমন কর্মকান্ডে অতিষ্ট, ওৎ পেতে থাকা রঙওয়ালা শেয়ালগুলোকে প্রচন্ড রকম দৌড়ানি দেয়। বেগতিক অবস্থায়, দৌড়ানি খাওয়া চতুর শেয়ালগুলো গিয়ে পরে রঙওয়ালার নীল রঙের খালে (যেখানে রঙ গোলানো হয়)।
পরিস্থিতি শান্ত হলে, নীল রঙএর খাল থেকে উঠে শেয়ালগুলো দেখে যে তাদের পুরো গায়ের রঙ নীল হয়ে গিয়েছে। শেয়ালকুলে আর কোন মান-ইজ্জ্বত থাকছে না ভেবে, তারা খুব ভেঙ্গে পড়ে এবং মনের দুঃখে নদীর তীর ধরে হাটতে থাকে। মাদী শেয়ালটা কেউ কেউ করে কানতে কানতে বলতে থাকে- শরীরের এই রঙ নিয়ে কিভাবে আমরা শেয়াল সম্প্রদায়ের কাছে ফেরত যাব? যদি তারা আমাদের অস্বীকার করে? ধেঁরে শিয়ালটা হঠাৎ 'হুক্কুউরেকা-হুক্কুউরেকা' বলে চিক্কুর পারতে থাকে। মাদী শেয়াল আর খেকি শেয়ালটা তাকে মনযোগ দিয়ে শোনে এবং সমস্বরে গেবনের শেষবারের মত হুক্কা-হুয়া, হুক্কা-হুয়া গগন বিদারী রব তোলে।
সোজা জঙ্গলে গিয়ে তারা প্রথমে ভাগ-বাটোয়ারার উপর ভিত্তি করে তাদের কিছু চামচিকা তৈরি করে এবং তাদের মাধ্যমে জঙ্গলের সকল পশু এবং প্রেস ডেকে (বাঘ, সিংহ, ভল্লুক, উল্লুক, শেয়াল, বিড়াল, বিটিভি, এনটিভি, আল-জাজিরা, বিবিসি ও অন্যান্য) একটা জরুরী সভার আয়োজন করে। সভায় উপস্থিত সকলেই বিচিত্র এই নীলরঙা প্রানী তিনটিকে দেখে যার পরনাই হতবাক হয়ে যায়। কেউ কেউ মাদী শেয়ালটার প্রেমেও পড়ে যায়। চালাক তিন শেয়াল জঙ্গলের প্রানীকুলের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করতে থাকে। তারা বলে, আমাদের দেখে হতবাক হবার কিছুই নাই। আমরা ঈশ্বর প্রেরিত, ঈশ্বরের বার্তা বাহক। ঈশ্বর আমাদের পাঠিয়েছেন, এই জঙ্গলের দায়িত্ব গ্রহন করে জঙ্গলের সকল পশুকুলকে সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদানের জন্য। আমরা সবার থেকে আলাদা এবং উন্নত, আপনারা আমাদের কথা শুনুন অন্যথায় কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য। তাদের বক্তব্যের মাঝে মাঝে চামচিকারা তাদের জোড়ালো বিশ্বাসের জানান দিতে থাকে আর মারহাবা মারহাবা রব তুলতে থাকে। সকলে ধূর্ত শেয়ালদের কথা মেনে নেয় এবং নীল তিন শেয়ালকে জঙ্গলের রাজা মনোনীত করে। রাজা হবার পর নীল শেয়ালরা খাবার সংগ্রহ করবার মত বিরক্তিকর ঝামেলা হতে মুক্তি নিয়ে শুধু হুকুম করতে থাকে। জঙ্গলের বাকী শেয়ালদের তারা দাস বানাতে শুরু করে। আর যারা তাদের দাসত্ব মেনে নিত না, তাদের উপর নেমে আসত অত্যাচার।
চামচিকাদের কাজ ছিল, রাজার হুকুমে জঙ্গলে একে অন্যের সাথে গ্যাঞ্জাম-কলহ বাঁধিয়ে রাখা আর বিদ্রোহ দমন করা। কেউ রাজার বিরুদ্ধে টু শব্দটি করলে চামচিকা-রা আলাদা-আলাদা হয়ে সেখানে এমন ভাবে ঝাপিয়ে পড়ত যেন তারা জঙ্গলের নিরীহ প্রজা কিন্তু এমন দরদী রাজাগনকে তারা খুব ভালোবাসেন, রাজার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে তারা তা কিছুতেই মেনে নেবেন না। বিদ্রোহীকে তারা মেরে-রক্তাক্ত্ব করে জঙ্গল থেকে বের করে দিত আর তাদের এই বিদ্রোহ দমনে বেশিরভাগ সময় তিন নীলরঙা শেয়ালও ছদ্মবেশে সামিল হয়ে দল ভারী করত।
এভাবেই চলছিল জঙ্গলের রাজনীতি আর রীতি-নীতি। লেজ গুটিয়ে, নীল শেয়ালের ভয়ে বাঘ-সিংহ সকলেই এক ঘাটে পানি খাচ্ছিল, কেউ কেউ জঙ্গল ত্যাগ করেছিল। নীল শেয়ালের অত্যাচারে সব থেকে বেশি সমস্যা হচ্ছিল জঙ্গলের সাধারন-শেয়াল সম্প্রদায়ের কারন তাদের উপরই অত্যাচারের মাত্রাটা ছিল তীব্র থেকে তীব্রতর। কথায় কথায় তাদের উপর নেমে আসত রাজার নানা অবিচার, অত্যাচার।
নীল রাজাদের অত্যাচার হতে রেহাই পাবার জন্য জঙ্গলের বুড়ো শেয়ালটা একদিন জঙ্গলের বাকী শেয়ালদের নিয়ে মিটিং ডাকে। এজেন্ডা-ডিসকাসন-একশন এর মাধ্যমে তারা একটা মিটিং মিনাটসও তৈরি করে ফেলে, যেখানে নীল শেয়ালেরা যে আসলে ঈশ্বর প্রদত্ত কেউ নয় বরং ভন্ড-কপট-প্রতারক এবং শেয়াল সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের অন্যায়-অবিচার নিয়ে গভীর আলোচনা হয়। বুড়ো শেয়ালটা বলে, নীল শেয়ালেরাও আমাদের মত শেয়াল, শুধু তাদের গায়ের রঙটা নীল তোমরা কি তা এতদিনেও বুঝতে পার নাই। যে নীল, গ্রামের নীল চাষীদের কাছে পাওয়া যায়। জঙ্গলের সকল অঘটন, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মারামারি-র জন্য যে তারা দায়ী তোমরা কি বুঝতে পারনা? বাকী শেয়ালেরা নিজের সাথে রাজাকে মেলাতে থাকে, তাদের ছদ্মবেশ মেলাতে থাকে। তারা সমস্বরে বলে উঠে-কথা সত্য! রাজা আর কেউ নয় তারাও আমাদের মত শেয়াল কিন্তু বেশ ধূর্ত। তারা সকলে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা এই নীল শেয়ালের ধূর্ততা জঙ্গলের পূর্বের রাজাদের কাছে এমন ভাবে ধরিয়ে দেবে যে তারা আর পালানোর পথ খুঁজে পাবে না। ফায়ার ফক্সের প্রস্তাবটা ছিল, জঙ্গলের যখন গুরুত্বপূর্ন সভা চলবে সেদিন তারা কেউ সভায় যাবে না বরং পাশে আড়ালে থেকে সকলে মিলে সমস্বরে ‘হুক্কা হুয়া’বলে ডেকে উঠব। সত্যি শেয়াল হলে, তারা অবশ্যই প্রতি উত্তর না করে থাকতে পারবে না।
যথারীতি জঙ্গলরাজের মাসিক সভা চলছে। বাঘ-ভাল্লুক-উল্লুক সকলেই উপস্থিত শুধু শেয়াল সম্প্রদায় ছাড়া। বড়ই গুরুত্বপূর্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে- এবারের ইস্যুটা ছিল জঙ্গলের বিদ্রোহ দমন। জঙ্গলরাজগন তাদের মাল্টি সূত্রে খবর পেয়েছেন যে জঙ্গলে নীল-রাজত্বের বিরুদ্ধে একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছে আর সেটার নেতৃত্ব দিচ্ছে 'ফায়ার ফক্স' নামক একটা শেয়াল। কি করে এই ফায়ার ফক্সকে দমন করা যায় সেই আলোচনা যখন চলছিল তখন জঙ্গলের বাকী শেয়ালেরা সমস্বরে ডেকে উঠে ‘হুক্কা হুয়া-হুক্কা হুয়া'। এত কাছ থেকে এমন হুক্কা হুয়া ডাক শুনে মাদী শেয়ালটা ভেতরটা 'কুই কুই' করে ওঠে। ধেঁরে শেয়ালটা খুব কষ্ট করে নিজেকে, মাদী শেয়ালটাকে আর হুলো শেয়ালটাকে দমিয়ে রাখে হুক্কা হুয়ার প্রতি-উত্তর প্রদান করা থেকে। জংলী শেয়ালেরা ডাকের পর ডাক দিতে থাকে। খুব কষ্ট করে তারা প্রতি উত্তর করা থেকে বারংবার নিজেদের বিরত রাখে, কিন্তু কতক্ষন! দীর্ঘ দিন হুক্কা হুয়া ডাক না দিতে পারা, ধূর্ত শেয়ালেরা একটা সময় আর নিজেদের ধরে রাখতে পারে না।
তিনটাই আকাশের দিকে মুখ উচু করে সমস্বরে ডেকে ওঠে ক্যায়া-হুয়া!!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৪