somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লাশ কাটা ঘরে

১৩ ই মে, ২০১১ দুপুর ১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ঢাকা মেডিকেলের লাশ কাটা ঘরে দাঁড়িয়ে আছি। এই নিয়ে চার বার আসা হল এখানে। উদ্দেশ্য--পোষ্টমর্টেমের খুঁটিনাটি গলাধঃকরণ করা। আমাদের পায়ের কাছে পাঁচটা লাশ পড়ে আছে। সবচেয়ে ভয়াবহ লাশটা আমার পায়ের একদম কাছে। চোখ-মুখ সম্পূর্ণ থেঁতলানো। চোখের মধ্যে নয়টা কাঁটাওয়ালা একটা লোহার দন্ড ঢুকিয়ে লোকটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। চোখ থেকে জমাট বাঁধা রক্তের বিন্দু টপটপ করে পড়ছে। আমি এবং আমার বন্ধুরা এক ধরনের আতঙ্ক মুখে ফুটিয়ে লাশ কাটা ঘরে দাঁড়িয়ে আছি। সেই আতঙ্ক যতটা না মৃত,বীভৎস্য মানুষগুলোকে দেখে,তার চেয়ে অনেক বেশি আতঙ্ক স্যার একটু পর এসেই পড়া ধরা শুরু করবেন সেই ভয়ে।

স্যার আসার পরে পড়া ধরার পর্ব শেষ করে ডোমদেরকে পোষ্টমর্টেম শুরু করতে বললেন। একটা একটা করে মানুষের পেট চিরে নাড়িভুড়ি উলটে-পালটে দেখা হচ্ছে। মাথার খুলি ফাটিয়ে মগজ বের করা হচ্ছে। প্রচন্ড গন্ধ। গন্ধে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। আমরা নাক চেপে ধরে মানুষ কাটাকুটি দেখছি। স্যাররা মাঝে মাঝে মজার কোন কথা বলছেন মৃত মানুষটির মারা যাওয়ার কারণ নিয়ে। সেই হাসির কথা শুনে আমরাও চাপা স্বরে হেসে ফেলছি। জোরে হাসা যাচ্ছেনা—কারণ এটা লাশ কাটা ঘর! মৃত মানুষদের সম্মান করতে হবেনা??!! সবাই স্যারের লেকচার তুলার চেয়ে মানুষ কাটাকুটির ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমার নিজের ও কিছুটা আফসোস হচ্ছে মুঠোফোনটা বাসায় রেখে আসায়। আহারে! মুঠোফোন নিয়ে আসলে আমিও ভিডিও করতে পারতাম। বাসায় যেয়ে হরর মুভি দেখার চেয়ে এই ভিডিও দেখতে পারতাম! দেখতে দেখতে মানুষের স্বভাবজাত পাশবিক রক্তমাখা উল্লাসে মেতে উঠতাম!

একটু পর একটা মৃত মেয়েকে পোষ্টমর্টেম করার জন্য নিয়ে আসা হল। বেচারি আত্মহত্যা করে মারা গেছে। গলার কাছে কালশিটে দাগ। জিহবা বের হয়ে আছে। আমাদের বয়সী একটা মেয়ে। আমাদের মনে হয় মেয়েটাকে দেখে একটু মন খারাপ হল। সবাই কিছুক্ষণ নির্বাক। কিন্তু তারপরেই আমরা গুজবের মহাড়ায় মেতে উঠলাম। “আরে সুইসাইড করছে ক্যান বুঝস না? নিশ্চয়-ই কারো সাথে লটর-পটর ছিল”! কতটা যন্ত্রনা পেয়ে পেয়ে তিলে তিলে একটা মেয়ে নিজেকে নিঃশেষ করেছে তা ভাবার অবকাশ আমাদের—জীবিত মানুষদের নাই। খুব জানতে ইচ্ছা করে—আজ আমাদের সাথে এই মরে যাওয়া মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকলে সে কি আমাদের মত করেই ভাবত? সব মানুষের ভাবনা চিন্তা কি একই রকম? হতে পারে—কেউ প্রকাশ করে,কেউ করেনা! এই মেয়েটি নিশ্চয় মরে যাওয়ার আগে তার অব্যক্ত কষ্টগাঁথা গুলো কাউকে বলে যেতে পারেনি। তাই আমরা তাকে নিয়ে আজ অনুমানের খেলা খেলার সুযোগ পাই।

লাশ নিয়ে আমাদের পড়ালেখার পর্ব শেষ হলে আমরা ঐ নীল নীল জমাটবাঁধা আতঙ্কের ঘর থেকে বের হই। আমরা লাশ কাটা ঘর থেকে বের হয়েও আমাদের চোখ মুখ থেকে আতঙ্ক আর তীব্র গন্ধের ছাপ দূর করতে পারিনা। লাশ কাটা ঘরের বাইরে অনেক মানুষ দাঁড়ানো। তারা একদল ফ্যাকাশে মুখের ছেলে-মেয়ের দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকায়। লাশ কাটা ঘর থেকে কিছুটা সামনা এগুতেই আমাদের আতঙ্ক,ভয় সব কেটে যায়। আমরা দূর থেকে চটপটিওয়ালা মামাকে দেখি। আমরা আনন্দে চিৎকার করে উঠি!—“ওই যে মামা এসেছে! চল্‌ চল্‌ ফুচকা খাই!” আমরা ফুচকা খাওয়ার জন্য দৌড় দিই। লাশ কাটা ঘরে ছিন্নভিন্ন মানুষগুলো পড়ে থাকে---একা।

আকাশে আজ মেঘ করেছে। কালো হয়ে আছে আকাশ। বৃষ্টি হবে।

বিধাতা,

মানুষকে তুমি অশ্রুর বৃষ্টিতে স্নাত করাও। মানুষকে সত্যিকার অর্থেই শ্রেষ্ঠ জীব হওয়ার সুযোগ দাও। মানুষের মধ্যে মানবিকতা জাগিয়ে তোল বারবার। তোমার সৃষ্টি শুধুমাত্র নিজের স্বজন ছাড়া এখন আর কারো দুঃখে কাঁদে না!

সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৩৮
১২৯টি মন্তব্য ১২৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এসব লুটপাটের শেষ কোথায়!

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:১৮

আধা লিটারের পানির বোতল দোকানদার কেনে সর্বোচ্চ ১২.৫০ টাকায় আর ভোক্তার কাছে বিক্রি করে ২০ টাকা। এগুলো কি ডাকাতি না?

গোপন সূত্রে যতটুকু জানা যায়,
প্রাণ ৮.৫ টাকা কেনা
ফ্রেশ ১০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। চারুকলায় আগুনে পুড়ে গেল ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ ও ‘শান্তির পায়রা’ মোটিফ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:৪৭

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে নববর্ষের শোভাযাত্রা উদ্‌যাপনের জন্য বানানো দুটি মোটিফ আগুনে পুড়ে গেছে। এর মধ্যে একটি ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি ও আরেকটি শান্তির পায়রা।



আজ শনিবার সকালে চারুকলা অনুষদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘোষণাপত্র ও অঙ্গীকারনামা....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:২৬

ঘোষণাপত্র ও অঙ্গীকারনামা
March for Gaza | ঢাকা | ২০২৫

বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম
আল্লাহর নামে শুরু করছি
যিনি পরাক্রমশালী, যিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকারী,
যিনি মজলুমের পাশে থাকেন, আর জালেমের পরিণতি নির্ধারণ করেন।

আজ আমরা, বাংলাদেশের জনতা—যারা জুলুমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডক্টর ইউনুস জনপ্রিয় হয়ে থাকলে দ্রুত নির্বাচনে সমস্যা কি?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:৪১



অনেকেই ডক্টর ইউনুসের পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার কথা বলছেন। এর জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় নির্বাচন। আদালত যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল করেছে সেহেতু ডক্টর ইউনুস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডিসেম্বরে নির্বাচন : সংস্কার কাজ এগিয়ে আনার পরামর্শ প্রধান উপদেষ্টার

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:৪৯


ড. ইউনূস সাহবে কে বুঝি পাঁচবছর আর রাখা যাচ্ছে না। আজ বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সাথে মত-বিনিময়ের সময় ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন কে সামনে রেখে তিনি দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কারের এগিয়ে আনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×