প্রথম প্র্ব
বাড়ি ফিরে আনিলাকে ফোন করল সায়ন।
--কিরে ফোন করসিলি?
--হুম।
--তা মহারাণীর ফোন বন্ধ ছিল কেন?
--কিছু ভাল লাগতেসিল না তাই।
--ও।
--কই গেছিলি সন্ধ্যার দিকে তুই? ফোন করসিলাম ধরলিনা?
--বাইরে গেছিলাম।
--তা তো জানিই,কিন্তু বাইরে কই গেছিলি?
--বলা যাবে না। সিক্রেট! তা মহারাণী আমি এখন ফোন্টা রাখি। টাকা শেষ হয়ে গেলে তো আপ্নি আর কল ব্যাক করবেন না কিপ্টুস!
--তোরে কল ব্যাক করার জন্য আমারে কামড়ায় না। ভাগ বেটা!
--ওকে। বাই। ভাগ্লাম। আচ্ছা শোন! শোন নিলু বেগম!
--আবার কি?
--তুই কি জানিস আমি তোকে অনেক পছন্দ করি?
ফোনের ওপ্রান্তে একদম চুপ হয়ে যায় আনিলা। তারপর খুব আস্তে করে বলে,
--সায়ন,প্লীজ এই কথাগুলো আর তুলিস না রে। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এই কথাগুলো বারবার তুল্লে তুই তো জানিস আমাদের মধ্যে রাগারাগি হয়,ঝগড়া হয়,এত সুন্দর বন্ধুত্বটা...
--থাম থাম ভূটকী! লেকচার মারিস না! আমার এত ঠেকা পড়ে নাই যে তোকে পছন্দ করব! এহ! আমি তোকে এক্টু টেষ্ট করলাম। ওকে বান্দরনি! বাই!
আর কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন রেখে দিল সায়ন। আনিলার মনে হল সায়ন হয়ত আবারও ক্ষ্ট পেল! কিন্তু কি করবে সে! একদিন এরকম ক্ষ্টতো আনিলা নিজে কম পায়নি! দিন বাড়ি যায়, চড়ে পাখির ডানায়! তাহলে আনিলার দিন বাড়ি যায় না কেন? কেন দিনগুলো পড়ে থাকে পাঁচ বছর আগের বাংলা কোচিং আর নীহাররঞ্জণ স্যারের কেমিষ্ট্রি মডেল টেষ্টের সেই দিন্গুলিতে? ধুর! আজকে আর পড়াই হবেনা রাত্রে! সায়ন্টা মাথা এলোমেলো করে দিল। এই জন্যেই বিকালে তার ফোন ধরেনি আনিলা। আনিলা আবারও খুল্ল ডায়্রিটা। তার টিন-এজ লাইফ এর কত আবেগ যে এই ডায়রিটাতে লিখে রেখেছিল এক্স্ময়। আর কেঊ জানেনা,জানবেনা। আনিলা ফিরে গেল অতীতে—
১৫/০১/২০০৬ (রবিবার)
অদ্ভূত! আমি হতভম্ব! তাকে একবার দেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ভেবেছিলাম যে চলে গেছে তার সাথে আর কোন্দিন দেখাই হবেনা। তারপরও তার ঐ চশ্মা পরা মুখটা কিছুতেই ভুলতে পারিনি। ক্ত্তদিন স্কুল যাওয়ার পথে তাকে খুঁজেছি মনে মনে। তার বাসা তো আমি যতদূর জানি আমাদের স্কুলের আশেপাশেই কোথাও। কিন্তু তার সাথে নীহার্রঞ্জন স্যারের বাসায় মডেল টেষ্ট দিতে এসে এভাবে দেখা হয়ে যাবে কে জান্ত? এখন আমি কি করব? আমি যে তাকে দেখার পর আর কোন কাজেই আর মন বসাতে পারছিনা। সামনে ম্যাট্রিক। কি করব এখন? এত অস্থির লাগছে কেন?
প্রথমে তো আমি তাকে চিন্তেই পারিনি। কেমন যেন অন্য্রকম লাগল--আগের মত চুপচাপ না,ব্রং অনেক হাসছে,সবার সাথে অনেক কথা বলছে। মডেল টেষ্ট দেওয়ার আগে মানুষ এত টেন্শ্নহীন থাকে কিভাবে? আমি এক্টু অবাকই হলাম। যাই হোক,তাকে তো দেখলাম। ভাল লাগছে খুব। অনেক ভাল লাগছে।
২৪/০১/২০০৬ (মঙল্বার)
এরকম নার্ভাস আমি জীবনেও হইনি। আজকে তার এক ফ্রেন্ড আমাকে হঠাৎ ডাক দিল। ছেলেটাকে বাংলা কোচিং-এ দেখেছি তার সাথেই। আজকেও ছেলেটার পাশে সে দাঁড়ানো ছিল। ছেলেদের সাথে কখনই কথা বলিনা আমি। কিন্তু আমাকেই তো ডাকল,এখন কথা না বল্লে কি ভাব্বে? আমি এগিয়ে গেলাম। তার ফ্রেন্ড আমাকে জিজ্ঞেস বলল,”তোমার নামটা ভুলে গেছি। তুমি কি আমাদের সাথে বাংলা ক্লাস করতে?” আমি থতমত খেয়ে হ্যাঁসূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। খুব অস্বস্তি লাগছিল আমার ওদের সামনে দাঁড়িয়ে থাক্তে। তবুও বারবার চাচ্ছিলাম সে আমার সাথে সাথে এক্টু কথা বলুক,এক্টা কথা বলুক। কিন্তু কিছুই বল্ল না সে,ব্রং অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। আমি ফিরে এলাম আমার বেঞ্চে! তামান্না আর নুস্রাত খুব হাসাহাসি করল ছেলেদের সাথে কথা বল্তে গিয়ে আমার নার্ভাস্নেস দেখে। আমার কেন জানি মনে হয় তামান্না আর নুস্রাত কিভাবে কিভাবে যেন বুঝে গেছে আমি ওকে পছন্দ ক্রি! কিভাবে বুঝল? কি লজ্জা! কি লজ্জা!
এক্দিন সেই দিন্টা এলো কিশোরী আনিলার জীবনে। আজও সেদিনের কথা মনে হলে আনিলা কুঁকড়ে যায় লজ্জায়,নিজের প্রতি ঘৃণায়! আনিলা দ্রুত ডায়্রির পাতা উল্টায়,খুব দ্রুত! কোথায় সেই দিনের কথা লেখা? যে দিনে শান্ত-শিষ্ট,ভদ্র আনিলা, ক্লাসের প্লেস করা ষ্টুডেন্ট আনিলা, বান্ধবীদের মধ্যমনি আনিলা নিজেকে খুব খুব ঘৃণা করেছিল? মনে হয়েছিল সৃষ্টিক্র্তা তাকে এই পৃথিবীটাতে এভাবে না পাঠালেও পারত এবং যে দিনের পর থেকে প্রতিদিন নিজেকে একবার করে ধিক্কার দেয় সে। আনিলা লেখায় লেখায় পরিপূর্ন ডায়্রিটার পাতা উল্টাতে থাকে। খুঁজতে থাকে,খুঁজতে খুঁজতে লেখাটা পেয়েও যায় কিন্তু ঝাপ্সা চোখে লেখাগুলো পড়তে খুব ক্ষ্ট হতে থাকে আনিলার!
২৭/০২/২০০৬ (সোমবার)
ম্যাট্রিক প্রীক্ষার মাত্র দুই মাস আগে কথাগুলো জানলাম নুস্রাতের কাছ থেকে। কাল সারারাত ঘুমাইনি। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে। মা নিশ্চয়ই কিছু এক্টা বুঝতে পেরেছে। আমার এরকম লাগছে কেন? এইসব ফালতু চিন্তা কেন করতেসি? সামনে প্রীক্ষা—এখন কত পড়ালেখা করা দরকার। বারবার নিজেকে আয়নার সাম্নে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছি। এতদিন কখনো মনে হয়নি আমি দেখতে এত্ত খারাপ। প্রশু নুস্রাত বল্ল সে নাকি সামিহাকে অনেক পছন্দ করে। সামিহাকে দুই একবার বলার চেষ্টাও করেছে,কিন্তু সামিহা পাত্তা দেয়নাই! কোচিংগুলোতে তার সব ব্যক্তিত্ব্ই নাকি ছিল সামিহাকে দেখানোর জন্য! যেখানে সামিহা কোচিং করেনা সেখানে সে নাকি অন্য মানুষ হয়ে যায়। ইশ! আমি যদি সামিহা হতাম! নিজের উপর রাগ লাগছে,ক্ষ্ট হচ্ছে—আচ্ছা আমার কি ব্যক্তিত্ব বল্তে কিচ্ছু নাই? সামিহা আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। অনেক অনেক বেশি সুন্দর। অথচ এতদিন ওকে খুব এক্টা সুন্দর লাগেনি আমার কাছে। আজকে লাগছে,কাল ও লেগেছে। কি মিষ্টি গায়ের রং! কি সুন্দর ফিগার! কান্না পাচ্ছে খুব। নিজেকে খুব খ্যাত আর খারাপ মনে হচ্ছে। আল্লাহ আমাকে এত খারাপ করে সৃষ্টি কেন করল? এটা কি আমার দোষ? আমি কাল,আমি মোটা এসব কি আমার দোষ? নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে অনেক!
ডায়রি বন্ধ করে বায়েকেমিষ্ট্রির মোটা ব্ইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে আনিলা। কি হল আজ তার! পুরোনো কথা কেন যে আবার ভাবছে। সব তো সে ভুলে যেতে চায়। সায়ন্কে ফোন করবে নাকি? তাহলে হয়ত মন্টা হালকা হবে! অবশ্য সায়ন্কে ফোন করলে মেজাজ খারাপও হতে পারে। তবুও ফোন তুলে নেয় আনিলা। ঠিক যেভাবে এক্দিন পাঁচ বছর আগে ম্যাট্রিক প্রীক্ষায় গোল্ডেন ফাইভ পেয়ে বাবার উপ্হার দেওয়া মুঠোফোন্টা থেকে তাকে ফোন করেছিল আনিলা। অনেক কষ্টে ফোন নাম্বারটা পেয়েছিল,নুশ্রাত-ই এনে দিয়েছিল। জীবনের সবচেয়ে বড় ভু্ল্টা সেই কিশোরী মেয়েটা সেদিন্ই করে ফেলে আবেগে—যেটা থেকে আজও মুক্তি পাওয়া হলনা তার। সেই পাঁচ বছর আগে সে ফোন ধরার পরে দুরুদুরু বুকে দুই-এক্টা কথার প্রেই জ্ঞিজ্ঞেস করেছিল আনিলা—
-আচ্ছা তুমি কি সামিহাকে চেন?
-চিনি। কিন্তু তোমাকে এখনো ঠিক চিন্তে পারলাম না।
-আমি মানে আমাকে তুমি ঠিক চিনবেনা। আমি আনিলা।
-আনিলা? উম...নাহ! তোমাকে চিনিনা আসলেই!
গলার কাছে জমাট বাঁধা কান্নাটা গিলে ফেলে আনিলা বলেছিল,
-আচ্ছা বাদ দাও। তুমি কি সামিহাকে পছন্দ কর?
-হ্যাঁ অনেক অনেক বেশি। তুমি কি সামিহার ফ্রেন্ড?
-হ্যাঁ।
-ওকে বলো ওর মত সুন্দ্র মেয়ে সায়ন আর এক্টাও দেখেনি! ভবিষ্যতেও দেখবেনা! আমার কাছে ওকে এক্দম পুতুল মনে হয়!
-আচ্ছা বল্ব!
টল্মলে পানির ফোঁটাটা গালে গড়িয়ে পড়ার আগেই ফোন রেখে দিয়েছিল কিশোরী আনিলা। আজ্ও সে অবাক হয় সেদিন সে কিভাবে ওই আঘাতটুকু সামলে নিয়েছিল! এরপর ব্হুবার সায়নের মুখ থেকে সামিহার অসামান্য রূপের কথা শুন্তে হয়েছিল তাকে। কিন্তু প্রথম্বারের মত ক্ষ্ট আর কোন্দিন্ও পায়নি আনিলা।
আনিলা এখনো জানেনা কে সবচেয়ে বেশি বদলেছে আজ পাঁচ বছর প্র—সে না সায়ন?
(চলবে)
তৃতীয় প্র্ব
শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৪৭