আমি চাই আমার এক্টা দিন,অন্তত এক্টা দিন একদম আমার মনের মত হোক। হয়ত অনেকেই ভাববে এটা আবার কেমন কথা হল? আমরা সবাই তো নিজের মত করেই দিন কাটাই। কিন্তু আসলেই কি তাই? কোন এক্টা দিন সারাটা সময় কি আমরা নিজের মত করে থাকতে পারি? শেক্সপীয়ার তো সেই কবেই বলে গেছেন,পৃথিবীটা এক্টা অভিনয় মঞ্চ আর আমরা সবাই অভিনেতা। আমরা আসলে সবাই এক জন আর একজনের সাথে অভিনয় করেই বেঁচে আছি। মন খারাপ থাকলেও হাসির অভিনয়,ভাল থাকার অভিনয়,ভাল ‘একজন’ হওয়ার অভিনয়!
তাই আমি চাই আমার একটা দিন,মাত্র এক্টা দিন নিজের খুশি মত কাটাতে। যে দিনে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ নিয়ে কলেজ দৌঁড়াতে হবেনা। আমি চাই এরকম এক্টা সকাল আমার জীবনে আসুক যেদিন আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজের হাতে চা বানিয়ে চায়ের মগ হাতে নিয়ে ছাদে চলে যাব। আর তখন কেউ আমাকে বলবে না—“এক একা এত সকালে ছাদে যেওনা,দোতালার বখাটে ছেলেটা ছাদে থাকতে পারে।“ আমি সেদিন সকাল বেলাটা উপভোগ করব আমার মত করে। আমি ছাদে বসে অন্ধকার আর আলোয় মিশে থাকা আকাশ দেখব। তারপর যখন পাখির কিচিরমিচির শুরু হবে আমি ছাঁদ থেকে নিচে নেমে আসব। অন্তত একটা দিন আমি চিন্তা করবনা আমাকে আইটেম দিতে হবে,পরীক্ষা দিতে হবে। আমার মাথার ভেতর একটা দিন আমি কোন রকম চাপ নিতে চাইনা। সবসময় রেগুলার থাকতে চাওয়া আমার হয়ত একটা দিন ক্লাস মিস দিতে খুব খারাপ লাগবে। তাতে কি? দিনটা যে আমার! আমার স্বপ্ন দিন! আমি আমার মনের মত করে গড়ে নিব।
ছাঁদ থেকে নেমে আমি খুব সুন্দর মিষ্টি সবুজ রঙ্গা এক্টা শাড়ী পরব। খুব সুন্দর করে সাজব। কপালে বড় একটা সবুজ টিপ পরে ঠোঁট রাঙ্গিয়ে নিব হাল্কা করে,সজল চোখে মাখিয়ে দিব কাল কাজল। তারপর আমার দার্শনিক টাইপ ঝোলা ব্যাগটা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হব। আমি সেদিন কারো কাছে জবাবদিহি করতে চাইনা আমি কোথায় যাচ্ছি। কারণ অনেকদিন অনেককেই বলেছি আমাকে এই ব্যস্ত জীবন থেকে এক্টু মুক্তি দাও,চলনা আমরা ঘুরে আসি কোথাও থেকে। কিন্তু আমার বাসার শত ব্যস্ত মানুষগুলো তাদের ব্যস্ত জীবন থেকে মুক্তি পায়নি। মুক্তি পাইনি আমি নিজেও। হয়ত তারা যখন ছুটি পেয়েছে আমি তখন ছুটি পাইনি। তাই আজ আমি নিজেই নিজের কাছে ব্যস্ততা আর অভিনয় থেকে ছুটি নিয়ে নিলাম। সেদিন আমি শুন্তে চাইনা—“তুমি একা যেওনা,গাড়ি নিয়ে যেও,safety first”। আমি একা যেতে চাই। শান্তি পেতে চাই। অভিনয় থেকে মুক্তি পেতে চাই। মুক্তি পেতে চাই কলেজ যাওয়া,ক্লাস করা, পরীক্ষা দেওয়া,বাসায় ফেরা,বাসায় ফিরে ফেইসবুক আর ব্লগে বসা,বন্ধুদের স্ট্যাটাস এ কমেন্ট করে মুচকি হাসা,তারপর ভাত খেয়ে ঘুম দিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা,পড়ায় মন না বসা,মুঠোফোন নিয়ে এসএমএস দেখা,রাতে টিভির মনোযোগী ছাত্রী হওয়া,তারপর মাথার মধ্যে একগাদা পড়ার চাপ নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া,মাঝরাতে আইটেমের পড়া শেষ হয়নাই দেখে আবার চমকে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা---এইসব ঘ্যানঘ্যানে রুটিন জীবন থেকে একদিন মুক্তি চাই আমি! কারন আমি যে বড্ড বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি! বড্ড বেশি ক্লান্ত!
আমি সেদিন সারাদিন একা থাকতে চাই। বাসার সামনে ধানমন্ডি লেকের ধারে কিছুটা সময় চুপচাপ বসে থাকতে চাই। আমি জানি লেকের পাড়ে অনেক রকম মানুষ আসে। কেউ হয়ত আমার দিকে তাকিয়ে শীষ বাজাবে,কেউবা করবে রুচিহীন মন্তব্য। আবার কেউ হয়ত শাড়ি পড়া একাকী তরুণীকে দেখে ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়েও থাকতে পারে! তবে আমি অন্যদিনের মত ভীত চোখে তাদের দিকে তাকাব না,আমি ত্রস্ত পায়ে উঠেও চলে যাবনা। আমি কিছুক্ষণ ঠায় বসে থাকব সেখানে। চুপচাপ!
এরপর হয়ত এক্টা রিকশা ভাড়া করে হুড ফেলে ঘুরব একা একা কিংবা চলে যাব চারূকলার কাছে। সেখানে বসে ফুচকা বা চটপটি খাব। অথবা পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে বইয়ের পাতা উল্টাবো কিছুক্ষণ। বাড়ি ফেরার আগে শাহবাগের ফুলের দোকান থেকে কিন্ব রক্তলাল গোলাপগুচ্ছ,যা এতদিন ইচ্ছে থাকার পরও কেনা হয়নি টাকা বা সময়ের অভাবে। শাহবাগ পুলিশ বক্সের কাছে ওভারব্রীজের নিচে ফুলের মালা গাঁথা মহিলাটির ফুটপাতে গড়াগড়ি করা শিশুটিকে এক্টু আদর করে দিব পরম মমতায়,তার দু’একটা ছবিও তুলব—যা কোন্দিন করা হয়নি সবসময় সাথে থাকা বন্ধুদের চক্ষুলজ্জার ভয়ে!
বিকেল গড়ানোর আগেই বাড়ির দিকে রওয়ানা দিব আবার—এবার আর রিক্সা নয়,বাসে করে। বাসস্ট্যান্ডে নেমে কিছুটা পথ আবার ও হাঁটতে হবে বাড়ি ফেরার জন্য। সেইটুকুও আমি আমার মতই হাঁটব,কোন তাড়াহুড়ো করে না,ধীরে ধীরে—আমার চারপাশের মানুষগুলোকে দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরব আমি। আমার মন নিশ্চয়ই সেদিন থাকবে অনেক অনেক ভাল!
এরপর পাখি নীড়ে ফিরে এল...
স্বপ্নের দিন কাটিয়ে আমি যখন বাড়ি ফিরে আসব—তখন হয়ত বাসায় কেউ থাকবেনা! প্রতিদিনের মত তালা খুলে আমাকে ঘরে ঢুক্তে হবে। শুন্য ঘরে একলা আমি কলিংবেল বেজে ওঠার অপেক্ষা করতে থাকব। আমার হয়ত তখন আমার স্বপ্নের দিন কাটানোর কথা খুব কাছের কাউকে বল্তে ইচ্ছা করবে! কিন্তু কাকে বলব আমি! আমার সাথে যাওয়ার যেমন কারো সময় নেই,আমার কথা তো শুনারও কারো সময় নেই! আমার মন এক্টু এক্টু করে আবার খারাপ হতে থাকবে। আমার নিজেকে খুব একা মনে হবে। আমি এই একা সময়টাতে নেটে বসে সময় কাটাতে পারি,ভাত রান্না করে খেতেও পারি,পড়ালেখা করতে পারি কিন্তু আমি কিচ্ছু করব না। এসব করলে যে আমার স্বপ্নদিন অন্যদিনের মতই যান্ত্রিক হয়ে যাবে! আমি জানি,নিজের একাকীত্বের কথা চিন্তা করে আমার তখন আমার খুব কান্না পাবে। আমি বালিশে মুখ গুঁজে বাচ্চা মেয়ের মত কাঁদব ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আমার কারও উপর যেন খুব অভিমান হবে। হয়ত এই যান্ত্রিক পৃথিবীটার উপর--যা আমার বাবা-মা,বড় ভাই সবাইকে অনেক ব্যস্ত করে দিয়েছে। আমাকেও অনেক ব্যস্ত করে দিয়েছে। সবাই নিজেকে নিয়ে,নিজের ক্যারিয়ার নিয়েই পড়ে আছি শুধু! এসব কথা চিন্তা করতে গিয়ে আমার স্বপ্নদিন হয়তোবা ধীরে ধীরে বিষন্ন দিন হয়ে যাবে! আমার কেন জানি মনে হতে থাকবে আমার এখন স্বপ্নদিনের দরকার নাই,আমার এক্টু ভালবাসা পাওয়া দরকার,আমার মাথায় এক্টা কোমল অথচ তীব্র ভালাবাসার হাত দরকার—যা আমাকে মনে করিয়ে দেবে—তুমি একা ন্ও,তোমার সাথেও মানুষ আছে,মানুষের ভালবাসা আছে! আমার মনে হবে আমার শূন্য বাসায় একজন থাকুক যার বুকে মুখ লুকিয়ে আমি চোখের পানি মুছে ফেলে বল্তে পারি—“আমার খুব একা লাগছিল,আমি যান্ত্রিক জীবনে তাল মেলাতে গিয়ে ভেতরে ভেতরে এক্টু এক্টু করে মরে যাচ্ছিলাম। তাই আমি স্বপ্নদিন কাটাতে গিয়েছিলাম। একা একা স্বপ্নদিন কাটাতে বেশি ভাল লাগে নাই আবার তেমন একটা খারাপও লাগে নাই!” কিন্তু বাসায় একা আমি সে সময় তো কারো সাথে কথা বলতে পারবনা,কোন মানুষের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে পারবনা! তাই-ই হয়ত মানুষের জায়গা আমার প্রিয় বালিশটা নিয়ে নিবে তখন। আমি বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকব আর অভিশাপ দিতে থাকব যন্ত্রমানবদের ভালবাসাহীন যান্ত্রিক জীবন্টাকে!
(উৎর্সগঃ আমার খুব কাছের একজন-যাকে আমরা কোন্দিন বুঝতে পারিনি। যে মেয়েটি আমাদের সবার প্রতি অনেক বেশি অভিমান করে চলে গেছে না ফেরার দেশে)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৪৪