somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গুমনামী বাবা: ~ এই সাধু কি আসলেই 'নেতাজী' সুভাষ চন্দ্র বোস ছিলেন?

০৯ ই জুলাই, ২০২৪ দুপুর ২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শুরু করছি গুমনামী বাবাকে লেখা ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবী শ্রী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী'র একটা চিঠি দিয়ে- যে চিঠি সবাইকে চমকে দিয়েছিল!!
জয় যুক্তেষু,
দেশ বিভাগের পর আমি স্থির করিয়াছি, দেশ পরিত্যাগ করিব না। পূর্ব পাকিস্তানেই থাকিব। আমি পূর্ব পাকিস্তানেই আছি।
ব্রহ্মদেশের মান্দালয় জেলে যাহার সহিত একত্র গিয়াছিলাম। জেলে প্রবেশ করার পর যিনি বলিয়াছিলেন ‘মহারাজের সিট আমার পাশে থাকিবে’, আমি যাহার পাশে ছিলাম, একসঙ্গে টেনিস খেলিয়াছি, দুর্গাপূজার জন্য অনশন ধর্মঘট করিয়াছি-আমি তাহার কথা ভুলি নাই, তাহার সঙ্গেই আছি।
দিল্লিতে ১৯৪০ সনে, শঙ্করলালের বাড়িতে যাহার সহিত একত্র ছিলাম, মোটরে ইউ পি ভ্রমণের সময় যাহার পাশে ছিলাম, প্রচণ্ড শীতের রাত্রে আগরার মাঠে রাত্রি ৯টা পর্যন্ত বহু সহস্র লোক যাহার প্রতীক্ষায় ছিল – আমি সাগ্রহে তাহারই প্রতীক্ষায় আছি। পূর্ব পাকিস্তানের নির্যাতিন, নিপীড়িত জনগণ তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া আছে।
শ্রী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী
(ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (১৮৮৯– ৯ আগস্ট, ১৯৭০) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবী।)

~ শ্রী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী

(চক্রবর্তী, ত্রৈলোক্যনাথ (১৮৮৯-১৯৭০) ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী রাজনীতিক ও লেখক। ময়মনসিংহের কাপাসিয়াটিয়ায় ১৮৮৯ সালে তাঁর জন্ম। মহারাজ নামেও তিনি পরিচিত। কৈশোরেই ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। স্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি ১৯০৬ সালে অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন। বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন্য ১৯০৮ সালে তিনি গ্রেফতার হন। ফলে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ সম্ভব হয় নি। ১৯১২ সালে এক হত্যা মামলার আসামি হিসেবে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে যথার্থ প্রমাণের অভাবে পরে তিনি মুক্তি পান। এরপর দু’বছর ধরে রাজশাহী, কুমিল্লা ও মালদহে তিনি গোপন সংগঠন গড়ে তোলেন।

আন্দামান জেল
১৯১৪ সালে পুলিশ তাকে কলকাতায় গ্রেপ্তার করে বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলার আসামিরূপে আন্দামানে সেলুলার জেলে পাঠায়। পুলিনবিহারী দাস এবং তিনি উভয়েই ছিলেন অনুশীলন সমিতির প্রথম যুগের নেতা যারা সেলুলার জেলে বন্দি ছিলেন। ত্রৈলোক্যনাথ ১৯২৪ সালে জেল থেকে মুক্তি পান।
মুক্তির পর দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন দাশের পরামর্শে দক্ষিণ কলকাতা জাতীয় বিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯২৭ সালে গ্রেপ্তার হয়ে বার্মার মান্দালয় জেলে প্রেরিত হন। ১৯২৮ সালে তাকে ভারতে এনে নোয়াখালী হাতিয়া দ্বীপে অন্তরীণ করে রাখা হয়। ঐ বছরই মুক্তি পেয়ে উত্তর ভারতে যান এবং চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখের সংগে হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মিতে যোগ দেন। পরে বিপ্লবী দলের আদেশে বার্মার বিপ্লবীদের সংগে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে বার্মায় যান। ১৯২৯ সালে লাহোর কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৩০ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৩৮ সালে মুক্তি পান।

সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে সংযোগ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
তিনি সেই বছরেই সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করে রামগড় কংগ্রেসে যোগ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহ ঘটাবার চেষ্টায় ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও সুবিধা করতে পারেননি। এ সময়ে চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার হন।
‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সময় ১৯৪২ সালে পুনরায় তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৪৬ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি নোয়াখালিতে সাংগঠনিক তৎপরতায় লিপ্ত হন। দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকায় প্রকাশ্য রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তিনি পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে তার রাজনৈতিক এমনকি সামাজিক কার্যকলাপের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। বাধর্ক্যের শেষ দিনগুলো তিনি গ্রামের বাড়িতে প্রায় স্বেচ্ছা-নির্বাসনে কাটান। তিনি সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক দুটি গ্রন্থ জেলে ত্রিশ বছর ও পাকভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম রচনা করেন। তাঁর অপর গ্রন্থ গীতায় স্বরাজ। ১৯৭০ সালে চিকিৎসার জন্য তিনি কলকাতায় যান। সেসময় চাতরায় 'সংগঠনী'র কর্মীদের সঙ্গে কয়েকদিন কলকাতা কাটান, জাতীয় সংবর্ধনার জন্য সেখান থেকে তাঁকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়। দিল্লীর ভারতের পার্লামেন্টে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দেন,যা আজ এক ঐতিহাসিক দলিল। ওই বছর ৯ আগস্ট এই অগ্নিযুগের মহান বিপ্লবী মৃত্যুবরণ করেন। )
***
গুমনামী বাবার মৃত্যুর পর, তাঁর ঘর থেকে পাওয়া অসংখ্য চিঠির মধ্যে থেকে পাওয়া গিয়েছিল এই চিঠিটিও। ১৯৬৩ সালের এপ্রিলে লেখা। প্রসঙ্গত, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ছিলেন একজন উল্লেখযোগ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে দীর্ঘ ঘনিষ্ঠতা ছিল তাঁর। কিন্তু এই চিঠি গুমনামী বাবাকে কেন লিখতে গেলেন তিনি?
১৯৮৫ সালের ২৫ অক্টোবর, উত্তরপ্রদেশের জনপ্রিয় হিন্দি দৈনিক 'নয়ে লোগ'-এ প্রকাশিত হল একটি শিরোনাম - 'ফইজাদাবাদে অজ্ঞাতবাসে থাকা সুভাষচন্দ্র বোস আর নেই?' মুহূর্তের মধ্যেই যেন সারা ভারতে আলোড়ন ফেলে দিল ওই একটি শিরোনাম। দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল এই সংবাদ। অযোধ্যার ছোট্ট শহর ফইজাবাদ, হঠাৎ করেই হয়ে উঠল সংবাদের উৎসস্থল। এই শহরেই নাকি লোকচক্ষুর অন্তরালে নিজের শেষ জীবনটুকু কাটিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু!
তবে এই সংবাদের সূত্রপাত মাসখানেক আগে। ১৯৮৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, বিকেল বিকেল নাগাদ ভারতের জাতীয় পতাকায় মুড়ে ফইজাবাদের একটি ছোট্ট বাড়ি থেকে বের করে আনা হলো শশ্রুমন্ডিত, বিরলকেশী এক সাধুর মরদেহ। মাত্র ১৩ জন শবযাত্রী নিয়ে সরযূ নদীর তীরে নিয়ে আসা হলো শবযাত্রা। চিতা ততক্ষণে তৈরি। শুরু হলো ওই সাধুবাবার শেষকৃত্য। মাত্র ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে হিন্দু পুরাণের পবিত্র নদী সরযূর জলে মিলিয়ে গেলেন সেই সাধুবাবা, যাকে স্থানীয়রা ডাকতেন 'গুমনামি বাবা' বলে। কিন্তু গুমনামি বাবা আর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর যোগসুত্র কি? তার জন্য আগে জানা দরকার কে এই গুমনামী বাবা?
***
‘গুমনাম’ এর অর্থ হল হারিয়ে যাওয়া লুকিয়ে ফেলা নাম।

নেতাজির (Netaji)অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে এখনও গুঞ্জন রয়েছে বাঙালির মনে। নেতাজির হঠাৎ না থাকাটাকে এখনও মেনে নিতে পারেনি অনেকেই। স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। কোন কিছুর পরোয়া না করে দেশের জন্য লড়ে গেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর এই হঠাৎ অন্তর্ধানের রহস্য আজও অন্তরালেই রয়ে গেছে।
জাপানে বিমান দুর্ঘটনার পর দেশে চরম সংকটের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই ঘটনার বেশ কিছুকাল পরে সকলের সামনে আসেন এক সন্ন্যাসী, যিনি ‘গুমনামি’ বাবা নামে পরিচিত। নেতাজির পরিবার না মানলেও অনেকেই তাঁকে নেতাজি বলে মনে করতেন। নেতাজি সুভাস চন্দ্র বোসের সান্নিধ্যে থাকা কিছু মানুষ গুমনামি বাবার কাছে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝতে পারেন তিনিই সকলের নেতাজি। কিন্তু এই কথা আবার তাঁর বাড়ির কেউই মানতে চান নি।
গুমনামি বাবাই নেতাজি ছিল কিনা, সেই রহস্য আরও একবার দানা বাঁধতে চলেছে। কলকাতার সেন্ট্রাল ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির থেকে আসা একটি আরটিআইএর উত্তরে। দিন দিন এই ধারণা আরও প্রবল হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। আরটিআই-এর সায়ক সেন কলকাতার এই ল্যাবিরেটরির কাছ থেকে জানতে চান, যে তাঁদের কাছে গুমনামি বাবার দাঁতের ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম (Electrophherogram) আছে কিনা। তাঁদের কাছে গুমনামি বাবার দাঁতের ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম নেই বলে জানায় তাঁরা। এই ঘটনার জেরেই রহস্য আরও ঘনীভূত হয়ে উঠছে।
কোন ব্যক্তির দাঁতের ইলেক্ট্রোফেরোগ্রামের সঙ্গে কোন পরিবারের লোকজনের ডিএনএ মিলিয়ে দেখা যায় যে উক্ত ব্যক্তি সেই পরিবারের সদস্য কিনা। কিন্তু এক্ষেত্রে এখন দাঁতের ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম না থাকলে, সেটা করা সম্ভব নয়। কিছুদিন আগে নেতাজির মৃত্যু নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে ‘বিষ্ণু সহায় কমিশন’ ওই একই ল্যাবে জানান নেতাজি এবং গুমনামি বাবা দুজন আলাদা ব্যাক্তি। কিন্তু এই ঘটনার পর সেই রিপোর্ট নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠছে।

কে আসলে এই গুমনামি বাবা?
৬০ এর দশকের গোড়ার দিকের কথা। উত্তরপ্রদেশের নৈমিষারণ্য (নেমিসার) এলাকার অযোধ্যা বস্তি এলাকায় হঠাৎ একদিন আবির্ভাব হলো এক সাধুবাবার। গেরুয়া বসন, দীর্ঘদেহী সুপুরুষের মতো চেহারা। নেমিসারে একটি ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলেন ওই সাধুবাবা। সাধারণ মানুষের মতো সকলের সাথে কথা বলা, মেলামেশা করা নয়, বরং ওই সাধুবাবা থাকতেন সর্বদা পর্দার আড়ালে। কেউ তার দর্শন পেতনা। একান্তই প্রয়োজন হলে কথা বলতে হতো দরজার বাইরে থেকে অথবা পর্দার পিছন থেকে। বাইরে বের হতে হলেও নিজের মুখ ঢেকে রাখতেন সাদা চাদরে। নিজের নাম নিতেন না। কেউ কোনোদিন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, তিনি বহুদিন আগেই মৃত। তার কোন নাম নেই।
সামান্য কয়েকজন বিশ্বাসভাজন মানুষ ছাড়া কেউ তার দেখা পেতেন না। তার মধ্যে ছিলেন নেতাজির ঘনিষ্ঠ অনুগামী লীলা রায় এবং কয়েকজন বাঙালি বিপ্লবী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী। বাড়ির মালিক গুরুবক্স সিং সোধি বার কয়েক তার পরিচয় জানার জন্য তাঁকে সিভিল আদালতের নোটিশ পাঠালেও তা বিফলে যায়। ৬০ এর দশকে উত্তরপ্রদেশের একাধিক জায়গায় ওই সাধু বাবাকে দেখা গিয়েছিল বলেও শোনা যায়। নেমিসার থেকে শুরু করে অযোধ্যা, ফৈজাবাদ, বাস্তি - একাধিক জায়গায় তাকে দেখা গিয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। কখনো মহাকাল, কখনো মহাদেব, এই সমস্ত বলেই দিতেন পরিচয়। যারা তার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন তাদের কাছে তিনি ছিলেন ভগবানজি। আর সিংহভাগ মানুষ যারা তার দেখা পেতেন না, তাদের কাছেই এই ভগবানজি হয়ে উঠলেন 'গুমনামি বাবা'।
ষাটের দশকের পরে তেমন ভাবে ওই সাধুবাবার দেখা না মিললেও ১৯৮২ সালে পুনরায় আবির্ভাব ঘটে গুমনামী বাবার। আর আবির্ভাব আবারও উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে। সেখানেই সিংহ পরিবারের একটি ছোট একতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন গুমনামি বাবা। জানা যায়, মৃত্যু পর্যন্ত নাকি এই বাড়িতেই বসবাস করতেন তিনি।

গুমনামি বাবার অদ্ভুত সংগ্রহ
ওই সাধুটি আচার-আচরণের দিক থেকেও যেমন ছিলেন অদ্ভুত, তেমনি সাধু বাবার সংগ্রহও ছিল বড় অদ্ভুত। প্রায় ২০০০ এর ওপরে আর্টিকেল এবং ২৫টি স্টিলের ট্রাঙ্ক ছিল ওই গুমনামি বাবার সংগ্রহে, যা সাধারণ সাধুবাবা সুলভ তো একেবারেই নয়।

~ গুমনামী বাবার অদ্ভুত সংগ্রহ। যা একজন সাধুর কাছে থাকার কথা নয় মোটেও। এর বেশীরভাগ জিনিস সুভাষ বোসের ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিসের সাথে হুবুহু মিলে যায়।

যে সিংহ পরিবারের বাড়িতে গুমনামি বাবা ভাড়া থাকতেন, সেই পরিবারের সদস্য ছিলেন বিজেপি সাংসদ শক্তি সিংহ, যিনি গুমনামি বাবা রহস্য উন্মোচনে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯৮৫ সালে গুমনামি বাবার মৃত্যুর পর অজ্ঞাতবাসে থাকা ওই গুমনামি বাবার কাহিনি তিনিই সামনে নিয়ে আসেন। শক্তি সিংহ জানাচ্ছেন, তিনি জীবনে কখনো ওই বাবার মুখ দেখতে পাননি। বাবা সবসময় পর্দার আড়ালে থেকেছেন। খুব কম সংখ্যক মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল তার ঘরে। তিনি আরো বলছেন, বাবা নাকি একেবারেই একজন সাধুবাবা সুলভ ছিলেন না। তিনি রোলেক্স ঘড়ি পছন্দ করতেন, দামী সিগারেট খেতেন, এমনকী তার কাছে আনকোরা নোট ছিল, মাটন কিমা এবং বাঙালিরর প্রিয় শুক্তো ছিল তার সবথেকে পছন্দের খাবার। তবে, গুমনামি বাবা যে নেতাজি, এই বিষয়টা তিনি যে সম্পূর্ণ সমর্থন করতেন সে রকম নয়। তিনি অবশ্য জানিয়েছেন, নেতাজির পরিবারের সঙ্গে ওই সাধুবাবার বিশেষ যোগাযোগ ছিল।
নেতাজির ভাইঝি ললিতা বসু ওই সাধু বাবার মৃত্যুর পর দাবি করেছিলেন, সাধুবাবা ছিলেন আদতে নেতাজি। ১৯৮৬ সালে তিনি সুভাষচন্দ্র বসু বিচারমঞ্চকে সঙ্গে নিয়ে আদালতের নির্দেশে কাকার ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখতে ফৈজাবাদের সেই বাড়িতেও এসে পৌঁছেছিলেন। ওই সংগ্রহ দেখে তিনি দাবি করেছিলেন, ওই সমস্ত সংগ্রহ তার কাকা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুরই। ১৯৯৯ সালে আদালতের নির্দেশে যখন নেতাজির মৃত্যু রহস্য নিয়ে মুখার্জি কমিশন বসলো, তখনই ফৈজাবাদের ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল ওই ২৫টি ট্রাঙ্ক। কিন্তু সব থেকে বড় প্রশ্ন কী ছিল ওই ট্রাঙ্কে?

সেই ট্রাঙ্কে কী ছিল?
জেলা ট্রেজারি অফিসাররা বলেন, ওই টিনের বাক্সগুলি খুলে তারা সকলেই রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। এযাবতকালে যত সাধু বাবার হদিশ এবং দর্শন তারা পেয়েছেন তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিলেন ওই গুমনামি বাবা। মৃত্যুর আগে বা পরে মানুষটির একটাও ছবি নেই, কিন্তু তাঁর সংগ্রহে ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পরিবার এবং নেতাজির ব্যক্তিগত বেশ কিছু ছবি। সবথেকে উল্লেখযোগ্য ছবিটি ছিল নেতাজির পিতা জানকীনাথ বসু এবং মাতা প্রভাবতীর, যেটি ছিল একেবারে বাঁধাই করা। এছাড়াও, সেই ট্রাংক থেকে উদ্ধার হয়েছিল ছোটবেলায় নেতাজির বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি। 'হাফ বেন্ট ডাবলিন' ধূমপানের পাইপ থেকে শুরু করে বিদেশি সিগারেট, গোল ফ্রেমের চশমা থেকে রোলেক্স ঘড়ি, বাইনোকুলার, এমনকি একটি টাইপরাইটার এবং একটি ক্যাসেট রেকর্ডার। কি না ছিল গুমনামি বাবার সংগ্রহে। এছাড়াও মিলেছিল সুভাষচন্দ্রের জীবনীমূলক বেশ কিছু বই, এবং বেশ কিছু সংবাদপত্রের কাটিং। এছাড়াও ছিল প্রচুর চিঠিপত্র এবং নথি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ বাহিনীর পরিচিতদের একটি দীর্ঘ তালিকা, যা সাধারণ কোনো সাধুবাবার কাছে কোনভাবেই থাকতে পারে না। এমনকি অনেকে বলেন, ওই সাধু বাবার হাতের লেখার সঙ্গে নাকি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর হাতের লেখার দারুণ মিল ছিল। এই বাক্সের অন্যান্য জিনিসগুলিকে দেখে প্রথমে অনেকে মনে করেছিলেন সাধুবাবা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভক্ত। কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের তালিকাটি সমস্ত হিসাব এলোমেলো করে দেয়।

~ গুমনামী বাবার ট্রাঙ্কে পাওয়া দুটো ছবি এই রহস্যকে আরো ঘনীভূত করেছে; একটা নেতাজীর পারিবারিক ছবি আরেকটা তাঁর বাবা ও মায়ের ছবি।

হস্য আরও ঘনীভূত হয় একটি চিঠির আবির্ভাবে। আর এই চিঠি লিখেছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দ্বিতীয় প্রধান এম এস গোলওয়াকার। ১৯৭২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর গুমনামি বাবাকে লেখা একটি চিঠিতে গোলওয়াকার সাহেব বলছেন, "আপনার ২৫ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে লেখা চিঠি আমি ৬ সেপ্টেম্বর পেয়েছি। আমি আপনার নির্দেশিত এই তিনটি জায়গা সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নিচ্ছি। তবে, আপনি যদি জায়গাগুলোর ব্যাপারে একটু ভালোভাবে উল্লেখ করে দিতেন তাহলে একটু সুবিধা হত।" প্রশ্ন উঠছে, গোলওয়াকারের মত একজন ব্যক্তিত্ব একজন সাধারন সাধুবাবাকে চিঠি লিখবেন কেন? আর চিঠিতে তিনি তাকে পরমপূজ্যপাদ বলে সম্বোধনই বা করলেন কেন?

~ গুমনামী বাবা ও নেতাজীর মৃত্যু রহস্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা নিয়ে সৃজিতের আলোচিত ছবির পোস্টার।

ফুটনোটঃ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)ভারতের একটি ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী, আধাসামরিক ও বেসরকারী স্বেচ্ছা-সেবক সংগঠন। আরএসএস সংঘ পরিবার নামে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর একটি অংশ।
মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকর (১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯০৬ - ৫ জুন ১৯৭৩), গুরুজি নামে পরিচিত ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক ("প্রধান)। গোলওয়ালকরকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী এবং বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি "হিন্দু রাষ্ট্র" নামক একটি সাংস্কৃতিক জাতির ধারণাকে সামনে রেখেছিলেন যা "অখন্ড ভারত তত্ত্ব", ভারতীয়দের জন্য ঐক্যবদ্ধ জাতিগুলির ধারণায় বিকশিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। গোলওয়ালকর ছিলেন ভারতের প্রথম দিকের হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিন্তাবিদদের একজন।
***
প্রথম পর্ব সমাপ্ত।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০২৪ দুপুর ২:২৬
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৯

'পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......
[/সব

আমার এক মামা ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জব করতেন হোটেলের শুরু থেকেই। সেই মামা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে মুখরোচক কেক, পেস্ট্রি ছাড়াও বিভিন্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তার চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না, তবুও

লিখেছেন খাঁজা বাবা, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৩২



শেখ হাসিনার নাকি বায়ক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না। শেখ মুজিবের বেয়ে নাকি দুর্নীতি করতে পারে না। সে এবং তার পরিবার যে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করতে পারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়ে সামু কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৬

ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার দলের পতন ঘটানো হয়। এটা আমাদের একটা জাতীয় গৌরবের দিন। এটা নিয়ে কারও সন্দেও থাকলে মন্তব্যে লিখতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জ্বীনভুতে বিশ্বাসী বাংগালী ও ঢাকায় ৫০ হাজার ভারতীয় একাউন্টটেন্ট

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৩




ব্লগার সাড়ে চুয়াত্তর ব্লগে লিখেছিলেন যে, উনার ভগ্নিপতিকে জ্বীনেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো; ২ সপ্তাহ পরে ভগ্নিপতিকে দিয়ে গিয়েছে; এই লোক, সামুর কাছে আমার বিরুদ্ধে ও অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেছুর নিজস্ব একটি জ্বীন ছিলো!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:২৪



আমাদের গ্রামের খুবই সুশ্রী ১টি কিশোরী মেয়েকে জংগলের মাঝে একা পেয়ে, প্রতিবেশী একটা ছেলে জড়ায়ে ধরেছিলো; মেয়েটি ঘটনাকে সঠিকভাবে সামলায়ে, নিজের মাঝে রেখে দিয়েছিলো, এটি সেই কাহিনী।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×