গতকাল 'বদহজমকারী' এক পোস্ট দিয়ে সেটা ফের মিরোর আপুকে উৎসর্গ দায়ে এক মাসের সাজাপ্রাপ্ত আসামি হবার হাত থেকে বাঁচার প্রয়াসে দ্রুত ড্রাফটে নিয়ে কোন মতে ব্লগ ছেড়ে পালাই!!
আমার পোস্ট দেখে ভীষন বিরক্ত হয়ে তিনি নিজেই 'স্মৃতি জাগানিয়া রান্না' নামে সিরিজের দ্বিতীয় কিস্তিখানা প্রকাশ করে ব্লগে সাড়া ফেলে দেন। ' দাগ থেকে যে মাঝে মধ্যে ভাল কিছু হয় এই তার হাতে-নাতে প্রমাণ।
****
ছাত্র অবস্থায় বিদেশে গিয়েছে কিন্তু রান্না করেনি এমন বাঙ্গালী ছেলে মেয়ে হাতে গোনা। আমার এক বন্ধুতো বিদেশে বসে নিজে নিজে রান্না শিখে এখন বাংলাদেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আমারও রান্না হাতেখড়িটা তেমনি বিদেশে হলেও এর সম্পর্কটা পুরনো।
ছোটয়বেলা থেকেই অন্য ভাইবোনের থেকে আমি একটু বেশী মা ন্যাওটা ছিলাম। মায়ের আশে পাশে বেশী ঘুর ঘুর করতাম- বিশেষ করে মা যখন রান্না করত তখন তার খুব কাছে থেকে লক্ষ্য করতাম আর ফুট ফরমায়েশ খাটতাম। রান্নায় কখনো হাত না লাগালেও তার প্রতি একটা বিশেষ টান বা ঝোঁক অনুভব করতাম। মার রান্নার পুরো স্টাইলটা আমি ফলো করতাম।
***
এবার আসি রাশিয়ার গল্পে; রাশিয়ার খাবারের গল্প নিয়ে আমার বেশ কয়েকটা লেখা আছে। কি এক মরার দেশে গিয়েছিলাম কিচ্ছু মুখে তুলতে পারি না। গন্ধ আর স্বাদ দুটোতেই বমি পায়। আমাদের মধ্যে একমাত্র হুজুর শাহারিয়ার গপাগপ করে খায়। বাকি সবার অবস্থা করুন! রুশ কাপুস্তা খাঁটি বাংলায় যাকে বলা যায় পাতাকপি সিদ্ধ দেখলেই গা গুলায়। ভাতের মাড়ের মধ্যে মাংসের ডেলা ( রাশিয়ান কাটলেট) আর আলু ছ্যানা (পট্যাটো ম্যাশ গুলাইশ) খাইতে গেলে মা মা করে চিৎকার করতে মন চায়- না আছে লবন মশলা না আছে ঝাল। যবের তৈরি কালো রুটিতে কেমন বোটকা গন্ধে নাকে ঝাপটা দেয় -খেতে গেলে টক টক লাগে। বাতন বা সাদা রুটি যদিও খাবার উপোযোগী মাখন আর চিনি মেখে- কিন্তু এই জিভতো ওই স্বাদ নিতে তখন অভ্যাস্ত নয়। সোক বা জুস মানে শুকনো ফল সিদ্ধ করে তার পানি; সে এক মাল মাইরি। চা বলতে যে জিনিস ভারত থেকে যায়; সে এক জিনিস হরি- কফি ও তথৈবচ!
মাইনাস ২৫/৩০ সে. এ কলিজা পর্যন্ত বরফ হয়ে যায়। কোনমতে ধড়াচুড়া পড়ে ক্যান্টিনের খাবারের দুর্গন্ধের ঝাপটা সয়ে ডিম পাউরুটি ওয়েফার আর সোক নিয়ে চলে আসতাম। সিদ্ধ ডিমগুলো সেন্ট্রাল ওয়াটার হিটারের উপরে রাখতাম গরম গরম খাবারের জন্য। সারাদিন ঘ্যাষ ঘ্যাষ করে ওই চাবাইতাম আর মায়ের হাতের হাজারো পদ খাবারের কথা স্মরণ করে রাশিয়ার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে চোখের জল নাকের জলে এক করতাম।
আমার মায়ের হাতের অতি সুস্বাদু রসনা ভার্চুয়ালি আস্বাদনের লোভে চারপাশে ছোটখাট একটা ভীড় হরহামেশাই থাকত। তারা খুটিয়ে খুটিতে প্রতিটা রান্নার তরিকা জিজ্ঞেস করত আর মুল আকর্ষন ছিল স্বাদ কেমন? আমি বলতাম দশগুন বিশগুন বাড়িয়ে- এতে নিজের যেমন তৃপ্তির সাথে আকাঙ্খা বেড়ে যেত বহুগুন ওদের চোখ-মুখের মধ্যেও বিধ্বংসী এক লোভ দেখেতাম। মনে হোত এমন একটা দেশী পদের জন্য দু-দশটা খুন করা মামুলী ব্যাপার!
এভাবে কি চলে? কি করা যায়? এরপরে অংশটুকু আমি আমার আরেক লেখা রুশ কারতুসকা থেকে নিচ্ছি;
চারতলায় রুশ ছেলেমেয়েরা সন্ধে হলেই হল্লা করে রান্না করে আর আমরা উপরে ওঠার সিঁড়ির মুখের দরজা খান দিয়ে জিরাফের মত গলা বাড়িয়ে জুল জুল চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।আহারে আমরা যদি এমন করে রেঁধে খেতে পারতাম? কোথায় বাজার-কোথায় হাট?কিস্যু চিনিনা।এসেছি পনের দিনও হয়নি।হোস্টেল থেকে দু'শ কদম দুরে ভার্সিটি আর দেড়’শ কদম দুরে ক্যান্টিন।আমাদের দৌড় সর্বোচ্চ সামনের ওই রাস্তাখানা পেরিয়ে টেলিফোন একচেঞ্জ পর্যন্ত।মাইনাস তিরিশ ডিগ্রী সেলসিয়াসে এর থেকে বেশিদূর যাওয়াটা দুঃসাহসিক অভিযানের মত ছিল। অবশেষে কয়েকজন তরুণ একদিন পরিকল্পনা করলাম সেই দুঃসাহসিক অভিযানের।
এরপরে যদি চান রাশিয়ায় প্রথম আলু কেনার হৃদয় বিদারক গল্পটুকু পড়ে নিন এখান থেকে;
রুশ 'কারতুসকা'
আমরা বাজারে পেলাম শুধু আলু, মুরগী, বাতন বা সাদা পাউরুটি, মাসালা বা মাখন, লবন, গোল মরিচ আর পেয়াজ। এই দিয়ে রান্না হবে। সেই রান্নার প্রধান শেফ নির্বাচিত হলাম আমি। আমার অপরাধ ; সারাক্ষন সবাইকে দুনিয়ার যত স্বুসাদু বাঙ্গালীয়ানা খাবারের গল্প করে লোভ ধরানো। আমি যতই চিৎকার চেঁচামেচি করে না না করি হোস্টেলের প্রায় সবারই তত ধারনা বদ্ধমুল হচ্ছিল আমি পাঁকা রাধুনী- এমনিতেই বিনয় দেখাচ্ছি। সবার সেদিন সে কি উৎসাহ উদ্দীপনা রান্না নিয়ে- শ্রীলঙ্কান 'দিমিত' পর্যন্ত অকারনে খিল খিল করে হাসছে আর লাফাচ্ছে! আমকে বার বার হেসে হেসে বলছে ' আই নো ইউ আর গুড শেফ'।
সব সরঞ্জাম নিয়ে আমরা প্রায় জনা বিশেক আদম চার তলায় যাবার পরে পুরো হোস্টেলের রুশীয়, কাজাক, তা্জাক জর্জীয়, আজেরী ,আর্মেনীয়, বেলোরুশীয়, উক্রেনীয় ছেলেমেয়েদের মধ্যে হুলস্থুল শুরু হয়ে গেল! বিশাল রান্নাঘর যেন তখন কোন জাদুকরের আখড়া!
****
আজ এইটুকুন থাক- আমার স্মৃতি জাগানিয়া রান্নার বাকি অংশটুকু দিব কালকে। বড় লেখা ব্লগারেরা পড়তে চায় না তাই খন্ডে খন্ডে এভাবেই দিব ভাবছি।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০২৩ সকাল ৯:২৪