আশি ও নব্বুই এর দশকে সারা বিশ্বের অন্যতম জার্মান ব্যান্ড বনি এম- রাসপুতিন শিরোনামে গানটা গাওয়ার পরে সেটা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। দুনিয়াব্যাপী রাসপুতিনকে পরিচিত করার এবং খোদ রাশিয়াতে রাসপুতিনকে পুনরোজ্জীবিত করারা জন্য এই গানের অবদান সর্বাধিক বলে ধারনা করা হয়।
বনি এম. ছিলো একটি ইউরো-ক্যারিবীয় গানের দল। জার্মান রেকর্ড প্রযোজক ফ্র্যাঙ্ক ফারিয়ান দলটি শুরু করেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম জার্মানি ভিত্তিক দলটিতে সদস্য ছিলেন জ্যামাইকার লিজ মিচেল ও মার্সিয়া ব্যারেট, মন্টসারেতে'র মাইজি উইলিয়ামস এবং আরুবার মঞ্চ অভিনয় শিল্পী ববি ফ্যারেল।
১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দলটি ১৯৭০-এর দশকের ডিসকো সঙ্গীতের সময়কালে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৮০-এর দশকের পুরোটা সময়ে দলটি বিভিন্ন সময় ভিন্নি ভিন্ন ব্যক্তির সমন্বিত লাইন-আপ নিয়ে মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশ করে।
ব্যান্ডটি বিশ্বব্যাপী ৮০ মিলিয়ন রেকর্ড বিক্রি করে। তাদের উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে ‘ড্যাডি কুল’,’মা বেকার’,’বেলফাস্ট’,’সানি’,’রাসপুটিন’,’মেরি’স বয় চাইল্ড’ এবং ‘রিভার্স অব ব্যাবিলন’।
বনি এম-এর রাসপুতিন এলবামের কাভার।
প্রতিষ্ঠা
জার্মান সঙ্গীতশিল্পী-গীতিকার ফ্র্যাঙ্ক ফারিয়ান ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে নৃত্য সঙ্গীত "বেবি ডু ইউ ওয়ানা বাম্প" রেকর্ড করেন। গানটি স্টুডিওতে কৃত্রিম চড়া সুর ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। ফ্র্যাঙ্ক রেকর্ডটি তার আসল নাম ব্যবহার করে প্রকাশের পরিবর্তে প্রথমে একক সঙ্গীত হিসেবে তার ছদ্মনাম ‘বনি এম.’ ব্যবহার করে প্রকাশ করেন। ফ্র্যাঙ্ক অস্ট্রেলীয় গোয়েন্দা টেলিভিশন ধারাবাহিক ‘বনি’-এর নাম থেকে তার ছদ্মনামটি নিয়েছিলেন।তিনি নামটি নেওয়া প্রসঙ্গে বলেছিলেন:
একদিন আমি টেলিভিশন দেখছিলাম এবং সেখানে বনি টেলিভিশন ধারাবাহিকটির শেষ পর্ব প্রচার হচ্ছিল যেখানে ‘বনি’ নামটি দেখতে পাই। আমার মনে হয়েছিলো এটি একটি ভালো নাম - বনি, বনি, বনি,....বনি এম., শুনতেও ভালো লাগে। সহজ।
একক গানটি ধীরে ধীরে নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ সময় ফ্র্যাঙ্ক টেলিভিশনে গানটি পরিবেশনের জন্য মঞ্চ অভিনয় শিল্পী ভাড়া করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি প্রথমে মাইজি উইলিয়ামসকে খুঁজে পান। পরে মাইজি নৃত্যশিল্পী ববি ফ্যারেলকে নিয়ে আসেন। মার্সিয়া ব্যারেট এরপর যুক্ত হন যিনি পরবর্তীতে লিজ মিচেলকে নিয়ে আসেন। লিজ এর পূর্বে হামবুর্গভিত্তিক গানের দল ‘লেস হামফ্রিস সিঙ্গারস’ দলের সাথে যুক্ত ছিলেন।
বনি এম এর মাষ্টারমাইন্ড 'ফ্রাঙ্ক ফারিয়ান'
Ra ra Rasputin
Lover of the Russian queen
There was a cat that really was gone
Ra ra Rasputin
Russia's greatest love machine
It was a shame how he carried on
এই গানটা নাকি তিন তিন জন লিরিক্স রাইটার মিলে লিখেছেন- কেন? কারন ছোট্ট একটা গানে পুরো রাসপুতিনকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সত্তুর এর দশকে, বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন- অবরুদ্ধ সোভিয়েতের নিষিদ্ধ কোন এক মানুষের পুরো জীবনি জানার চেষ্টা চাট্টিখানি কথা নয়। তারা প্রায় অসাধ্য সাধন করে ফেলেছিলেন।
ব্রিটিশ কমিক বই নিকোলাই দান্তে তার গল্পের শিরোনামের জন্য একটি গানের উদ্ধৃতি দিয়েছিল ‘রাশিয়ার গ্রেটেস্ট লাভ মেশিন’ নামে ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ১৯৯৭ সংখ্যায়। ওয়াশিংটন, ডিসি-ভিত্তিক নৃত্য/রক ব্যান্ড রা রা রাসপুটিন গান থেকে এর নাম নিয়েছে।
যদিও গানটি ইংরেজিতে রচিত এবং পরিবেশন করা হয়েছিল,একক জার্মান এবং রাশিয়ান শব্দ দিয়ে – ‘কিন্তু যে কাসাতসচোক সে নাচালো সত্যিই ওয়ান্ডারবার(ববি ফ্যারেল)!’
- সোভিয়েত ইউনিয়নে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং সেখানে রাসপুতিনের খ্যাতি পুনরুজ্জীবিত করার কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তবে একসময় বনি এম এর সেই এলবাম থেকে এই গানটা সোভিয়েত সরকার একসময় বাজেয়াপ্ত করে এবং বনি এমকে ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে মস্কোতে তাদের দশটি পারফরম্যান্সের সময় ‘রাসপুতিন’ গানটি পরিবেশন করতে বাধা দেওয়া হয়েছিল।
১৯৭৯ সালে তাদের পোল্যান্ড সফরের সময়, সরকারী কর্মকর্তাদের এই গানটি না করার অনুরোধ করা সত্ত্বেও বন এম গানটি পরিবেশন করে। বনি এম এর রাসপুতিন গানটই তাদের পারফরম্যান্সের বাইরে রেখে সম্পাদনা করে পরের দিন ‘সোপটে’ অনুষ্ঠানটি জাতীয় টিভিতে সম্প্রচারিত হয়েছিল,কিন্তু এটি রেডিওতে সরাসরি এবং সম্পূর্ণভাবে সম্প্রচারিত হয়েছিল।
রাস্পুতিন গানের মুল সুর তুরস্কের বিখ্যাত ‘কাতিবিম’ গান থেকে নেয়া হয়েছিল। আসুন সেই কাতিবিম’ গানটা নিয়ে একটি আলোচনা করি;
আপনি নিশ্চিত কাজী নজরুলের ত্রি ভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ বা শুকনো পাতার নুপুর পায়ে গজলটা গান দুটো শুনেছেন? এখন সেই সুরটা একটু গুন গুন করে দেখেন তো 'রাসপুতিন' সুরের সাথে মেলে কি না??
•কাতিবিম Bayan Marion Erdmann'ın sesinden "katibim" şarkısı. কাতিবিম- (আমার কেরানি মুলত আমার প্রিয়তম), বা Üsküdar'a Gider İken (Usküdar-যাবার সময়) একটি তুর্কি লোক সঙ্গীত যা কারো কেরানি বা সার্বক্ষনিক সঙ্গী (kâtip) সম্পর্কে গল্প করে যখন তারা উস্কুদার ভ্রমণ করে।
সুরটি একটি বিখ্যাত আদি তুর্কি সঙ্গীত ,যা তুরস্কের বাইরে বহু দেশে,বিশেষ করে বলকান অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে।
* বাংলাদেশ: ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ -নামে পরিচিত এই সুরটির বাংলা রূপান্তর এবং -শুকনো পাতার নূপুর পায়ে। ১৯৫০-এর দশকে বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেছিলেন,যাকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
ধারণা করা হয় যে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মধ্যপ্রাচ্যে লড়াই করার সময় সুরটি শিখেছিলেন। এর নামের দ্বারা বোঝা যায়,’ত্রি-ভুবোনার প্রিয় মুহাম্মদ’ নবী মুহাম্মদের জন্য একটি ইসলামিক গানও।
• পাকিস্তান: একটি তুর্কি-উর্দু ম্যাশ-আপ সংস্করণ "ইশক কিনারা - Üsküdar'a গিডার ইকেন" ২০১৩ সালে সুমরু আগিরিউরিয়েন এবং জো ভিকাজির দ্বারা পাকিস্তানি টেলিভিশন প্রোগ্রাম কোক স্টুডিওতে পরিবেশিত হয়েছিল।
• ভারত: ১৯৫৬ সালের ভারতীয় চলচ্চিত্র তাজ-এ হেমন্ত মুখার্জির "ঝুম ঝুম কার চালি আকেলি" শিরোনামের একটি হিন্দি ভাষার গান রয়েছে, যার সাথে কাতিবিমের মিল রয়েছে। ২০১২ সালের ভারতীয় চলচ্চিত্র এজেন্ট বিনোদ-এ "আই উইল ডু দ্য টকিং" শিরোনামের একটি হিন্দি ভাষার গান রয়েছে; গানটি ‘রাসপুটিন’ এর আংশিক প্রসার। এই গানে কাতিবিমে’র মূল সুর সহজেই অনুমান করা যায়।
• সামি ইউসুফের অ্যালবাম বারাকাহ (২০১৬) এর একটি ট্র্যাক রয়েছে যার নাম’I Only Knew Love (Araftul Hawa) এটিও একটি অনুরূপ সুরের উপর ভিত্তি করে তৈরি।
• ফাজিল সেয়ের বেহালা কনসার্টের তৃতীয় মুভমেন্ট ‘১০০১ নাইটস ইন দ্য হেরেমে’ ভারীভাবে সুরটি উদ্ধৃত করে।
• বনি এম এর ১৯৭৮ ইউরো ডিস্কো হিট একক "রাসপুটিন" এর সুরকে 'কাতিবিমে'র সাথে তুলনা করা হয়েছে, কিন্তু ব্যান্ডটি ওই গানের সাথে কোনো মিল অস্বীকার করেছে।
গানের পুরুষ কণ্ঠে ববি ফ্যারেল অনুকরন করেছিলেন, যা ১৯৮০এর দশক পর্যন্ত গোষ্ঠীর জন্য প্রথাগত ছিল - ফারিয়ান আসলে কণ্ঠ দিয়েছিলেন।
ফ্রাঙ্ক ফারিয়ানের আমেরিকান বন্ধু বিল সুইশার, যিনি সেই সময় জার্মানিতে একজন সৈনিক ছিলেন, তিনি সংবাদ পাঠক হিসেবে কথ্য কণ্ঠ প্রদান করতেন।
ববি ফ্যারেল নামক ওই নিগ্রো শিল্পি মুলত মঞ্চে শুধু অভিনয় করতেন আর ভিন্নধর্মী নাচ ও অভিনয়ে সবাইকে মুগ্ধ করতেন।
এটি আরও দাবি করে যে রাসপুটিনের রাজনৈতিক ক্ষমতা "রাজ্যের সমস্ত বিষয়ে" জারের নিজের চেয়ে বড় ছিল। যাইহোক, তার যৌন ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড যখন অনেক দূরে গিয়েছিল, তখন 'উচ্চস্তরের মানুষ' তাকে নীচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে ছিল। যদিও "মহিলারা তাদের কাছে অনুরোধ করেছিল' তা না করার জন্য।
গানটিতে আরও বলে যে ‘সে ছিল একজন বর্বর’,এবং মহিলারা ‘শুধু তার কোলে ঢলে পড়ত’।
গানের শেষ প্যারায় ১৯১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর ফেলিক্স ইউসুপভ, ভ্লাদিমির পুরিশকেভিচ এবং দিমিত্রি পাভলোভিচের পরিচালিত রাসপুটিনের হত্যার গল্প বলে। ।
যদিও গানটি রাসপুটিনের গল্পকে সঠিকভাবে বলার চেষ্টা করা হয়েছে তবে জারিনা আলেকজান্দ্রার সাথে তার সম্পর্ক ছিল এমন কোন সরকারী প্রমাণ নেই। এমনকি এখনো রাশিয়ানরা বিশ্বাস করে যে, এটা নেহায়েত বানোয়াট গল্প।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে, টিক টকে গানটির পুনরুজ্জীবনের জন্য ধন্যবাদ, নর্থ লন্ডনের ডিজে এবং প্রযোজক ম্যাজেস্টিক গানটির একটি নতুন রিমিক্স প্রকাশ করেছেন 'ম্যাজেস্টিক এক্স বনি এম'
এই সংস্করণ - মূলত একটি ভিন্ন বিট সহ সম্পূর্ণ গান - যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অফিসিয়াল চার্টে পৌঁছেছে।
টিকটক চ্যালেঞ্জের জন্য এটিকে আবার জীবন্ত করে তোলা হয়েছে যা ব্যবহারকারীদের পুরো পেশির জন্য তাদের পেশীগুলিকে নমনীয় দেখায়, কারণ ... কেন নয়।
'রাসপুটিন' -এর ৬.৫ মিলিয়ন স্ট্রিম ছিল এবং ২২ এপ্রিল শেষ হওয়া সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৬০০ ডাউনলোড বিক্রি হয়েছিল।
গ্রিগোরি রাসপুটিন একটি বিনয়ী কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু মৃত্যুর আগে তিনি বিংশ শতাব্দীর রাশিয়ায় একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন।
লোকেরা সাধারণত যে বিষয়গুলো নিয়ে মুলত আলোচনা করতে পছন্দ করে - রাসপুতিন তেমনই একজন, যাকে রাশিয়ায় রাজতন্ত্রের পতন/অবসানের পাশাপাশি সোভিয়েত সমাজতন্ত্র কায়েমের মাঠ তৈরি করে দেবার মুল ক্যারিশম্যাটিক চরিত্র হিসেবে ভাবা হয়।
যদি কোন গল্প রাসপুতিনের গল্পের মতো অর্ধেক উন্মাদ এবং খানিকটা অন্তত উন্মাদনা থাকে তবে তা ইতিহাসের ইতিহাসে প্রতিধ্বনিত হবে। এবং রাসপুতিনের ক্ষেত্রে, তিনি শেষ শতাব্দীর অন্যতম চিত্তাকর্ষক, রহস্যময় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন এবং তার নাম পপ সংস্কৃতিতে বারবার উঠে আসে।
এখন বনি এম নিজেই একটি quirky, spunky ব্যান্ড। তাদের ‘মা বেকার' থেকে মিষ্টি 'ব্রাউন গার্ল ইন দ্য রিং'পর্যন্ত চরম জনপ্রিয় হয়েছিল সারা বিশ্ব জুড়ে। উচ্ছৃঙ্খল বিষয় নিয়ে গান গাওয়ার জন্য তাদের পছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নেও তাদের বেশ বড় ভক্ত গ্রুপ ছিল। তারা একসময়ে রাসপুটিন নামক রহস্যময় প্রায় উন্মাদ উচ্ছৃঙ্খল ফের কেউ বলে আধ্যাত্মিক ও সম্মোহনী শক্তির অধিকারী ব্যক্তিত্বকে নিয়ে একটি গান তৈরি করেছিল। গানটি তার অনন্য গল্প বলার সাথে ব্যাপক হিট হয়েছিল।
সারা বিশ্ব চরম আগ্রহী হল 'রাসপুতিন' নামক সেই ব্যক্তিকে জানার জন্য যেই আগ্রহের বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি এখনো।
*এই পর্বটা মুলত আমার নতুন দুটো সিরিজের শুরু বলা যায়। তাঁর একটা ' দুনিয়া কাঁপানো জার্মান ব্যান্ড'-এর গল্প আর 'রাসপুতিন'-কে নিয়ে কল্প-গল্প আর রিয়েল ফ্যাক্ট তুলে ধরার চেষ্টা। ব্লগারদের ভাল লাগলে অবশ্যই আমি সময় সুযোগ করে এই সিরিজগুলো নিয়ে ফিরে আসব।