আমার দাদার পিতামহের নাম ছিল কালাই শেখ। গায়ের রঙ ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ হবার কারনে সম্ভবত তার নাম কালা শেখ রাখা হয়েছিল। সেই নাম পরে কালাই শেখে রুপান্তরিত হয়। তার গ্রামের বাড়ি দুর্গাপুর! নাম শুনে বোঝা যায় হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। তার পুর্বপুরুষ ধর্মান্তরিত হবার পরে সম্ভবত কিছুদিন কোনঠাসা হয়ে থাকলেও ধীরে ধীরে খানিকটা প্রাভাবশালী হয়ে ওঠে। তাই কালা শেখের নাম ইজ্জতদার হয়ে কালাই শেখ হয়েছে।
শাহ শেখ ফরিদ- জনশ্রুতি আছে এই আউলিয়ায়ার নামানুসারেই ফতেহাবাদ নাম পালটে ফরিদপুর হয়ে যায়। এইসব পীর আউলিয়ারা ধর্মান্তরিত করবার জন্য মুলত টার্গেট করতেন নিন্মবর্ণের শোষিত ও অতি দরিদ্র জনগন। পরবর্তীতে খৃষ্টান পাদ্রীরাও এদেশে ধর্ম প্রচার করতে এসে টার্গেট করে ধর্মান্তরিত এইসব মুসলমান আর পুর্বের মত হিন্দু নিন্মবর্ণের সেইসব মানুষদের।
আমার পিতামহের পিতামহের গাত্রবর্ণের কারনেই আমি ধারনা করি তারা আদি ভারতীয় ও আর্য ব্রাহ্মনদের শোষনের স্বীকার নিন্মবর্ণের হিন্দু ছিল। এরা বংশ পরম্পরায় বারবার ধর্মান্তরিত হয়েছে এবং বহিরাগত আর্যদের দ্বারা শোষিত হয়েছে।
যেহেতু আমার বংশের পদবী শেখ সেহেতু ধরে নিই, আমার পুর্ব পুরুষ শাহ শেখ ফরিদুদ্দিনের হাতে বাইয়্যাত গ্রহন করে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন এব শেখ ফরিদ তার পদবী শেখ তাদের পদবী হিসেবে ব্যাবহার করার অনুমতি দেন । জনশ্রুতি আছে যে, ফরিদপুরের বেশীরভাগ আদি শেখ বংশের উতপত্তি এখান থেকেই- আউলিয়া শেখ ফরিদের হাত ধরে। যাক এই বিতর্কে আর নাই গেলাম।
আমার সপ্তম বা অষ্টম পূর্বপুরুষ ধর্মান্তরিত হয়েছিল ধরে নিলে 'শেখ' উপাধীটা আমাদের খাঁটি হয়ে যাবার কথা এতদিন।
আমার বাবার গাত্রবর্ণ সাত পুরুষের পরিক্রমায় শ্যাওলা ধরাতে পারেনি-আমার দাদী আদর করে তাকে শাম, শ্যাম (কৃষ্ণ) বলে ডাকতেন। সেই নামেই এক সময় তিনি পরিচিত হয়ে যান তার গাও-গেরামে। তবে গাত্রবর্ন নিয়ে তার আক্ষেপ করতে শুনিনি। কিন্তু আফসোস ছিল আমাদের!
হুমায়ুন আহমেদ তার এক নাটকে রস করে বলিয়েছিলেন; পৃথিবীতে তিনটে সেরা বংশ আছে; সৈয়দ, খুনকার আর শ্যাখ।( সম্ভবত এইসব দিনরাত্রি কিংবা বহুব্রীহি’তে)
সৈয়দ তার আদি নাম ধরে রেখেছে। খোন্দকার, খু্নকার(সম্ভবতঃ খুন= রক্ত, কার) হয়েছে কিন্তু এদেশ জুড়ে শেখ হয়েছে কখনো কখনো সেক, কিংবা শেক, শেইক,শায়খ, শাইখ অথবা শ্যাখ!!
আমার মাতুল বংশ কাজী- মা বলে তার পুর্বপুরুষ সুদূর আরব দেশ থেকে এসেছিল। আমার মায়ের বিয়েই নাকি প্রথমবার হয়েছিল তার বংশের বাইরে। অন্য সবার নাকি তাদের মুল ধারার জ্ঞাতি গুষ্টি আত্মীয় পরিজনের সাথে হয়েছে। বাবা মায়ের গাত্রবর্ণের চরম অমিল থাকলেও আমরা বাবাকে খুশী রাখার স্বার্থে তার কৃষ্ণের দলে যোগ দিয়েছি। এ প্রজন্মের গায়ে একটু শ্যাওলা বা ছ্যাতা ধরেছে এই যা- কিন্তু আরবীয় এক আর্য শেখ এমনধারা গায়ের রঙের এই আদমের 'শেখ' পদবী শুনে নাক কুচকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার পরে পদবীটা বেঁচে দেবার ক্লায়েন্ট খুজছিলাম।
বেশ কিছু বছর আগে শেখ, সেক বা শেক পদবী মুছে ফেলার বা গায়েব করে দেবার হিড়িক পড়েছিল- আর শাইখ সাহেবেরা বলেছিলেন; তারা আদি খাঁটি, এদেশের শেখের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। কেউ শরমে, কেউবা পদবীর খাতিরে কখন কোন গজব নেমে আসে সেই ভয়ে বা শঙ্কায়। কিন্তু এখন সে পদবী ফিরিয়ে আনার জোর চেষ্টা তদবীর চালাচ্ছে তাদের অনেকেই।
আমাকে মাঝে মধ্যে কেউ বলে আপনারা আদি গোপালগঞ্জের শেখ। শুধু শেখ উপাধি বা গোপালগঞ্জের নাম ভাঙ্গিয়ে কত লোক কত কিছু করে নিচ্ছে- আর আপনাদের এই ল্যদা প্যাদা অবস্থা কেন?
আমি ভীষন লজ্জা পাই তাদের কথা শুনে। ক্যামনে বলি, আমরা খাটি আর্য শেখ নই, আমরা ঘোর কৃষ্ণ বর্নের আদি বাঙ্গাল! কয়েক হাজার বছরে খাঁটি বাঙ্গালী হতে পারলাম না আর মাত্র পৌনে তিনশ বছরে ক্যামনে খাঁটি শেখ হব!!!!
---------------------------------------------------------------------------------------------------
বেড়াভাঙ্গা সৈয়দের গল্পঃ তখন সৈয়দদের রমরমা অবস্থা! সৈয়দরা নাকি নবীর বংশ এই বয়ান শুনে মুসলিমরাতো বটেই অনেক হিন্দুরাও সৈয়দদের সম্মান করত বিশেষ নজরে দেখত।
কোন এক মুসলিম রাজা এহলান করলেন যে, নবীর বংশ সৈয়দরা ভীষন সম্মানিত এদের দিয়ে কাজ কর্ম করানো গর্হিত অপরাধ! এখন থেকে সৈয়দ বংশের লোকেরা ধর্ম কর্ম আর আরাম আয়েস করে কাটাবে। তাদের দেখভালের দ্বায়িত্ব সব রাজ্যের।
তার এহলানের পরেই সে রাজ্যে হু হু করে সৈয়দদের সংখ্যা বাড়তে লাগল।
প্রতিদিন শত শত এপ্লিকেশন পড়ছে, আমি অমুক সৈয়দ, বাবার নাম তমুক সৈয়দ। আমাকে নিশ্চিন্তে ধর্ম কর্মে মনোনিবেশ করার নিমিত্তে মাসিক ভাতার ব্যাবস্থা করা হোক।
এভাবে সৈয়দদের বাড়তে বাড়তে এক সময় পুরা রাজ্যের সবাই সৈয়দ হয়ে গেল!
পুরো রাজ্যের সব নাগরিক পায়ের উপর পা তুলে খাচ্ছে।
রাজার কপালে চিন্তার ভাঁজ- এভাবে চললে তার রাজ্য লোপাট হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
তিনি বসলেন তার গুটিকতক সভাসদ নিয়ে জরুরী রাজ সভায়। কিভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় এর উপায় জানতে চাইলেন।
প্রধান উজির পরামর্শ দিলেন, বিশাল একটা মাঠে ঘর বানিয়ে সেখানে সব সৈয়দ দের জড়ো করতে হবে। এরপরে সেই ঘরে আগুন ধরিয়ে দিতে হবে। নবীর বংশ সৈয়দদের গায়ে নাকি আগুন স্পর্শ করে না। তাই সত্যিকারে সৈয়দদের খুঁজে বের করতে সহজ হবে।
যেই কথা সেই কাজ- রাজ্যে ঢেড়া পিটিয়ে সব সৈয়দদের জড়ো করা হোল বিশাল মাঠের সেই ঘড়টাতে
যথারীতি সবাই ঢোকার পরে মুল ফটকে তালা লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হোল।
আগুনের ভয়ে দু’চারজন সত্যিকারে সৈয়দ বাদে বাকি সবাই ঘরের বেড়া ভেঙ্গে হুড়মুড় করে দৌড়ে পালাল!
সেই থেকে সৈয়দ হোল দু’ধরনের। একটা খাঁটি আরেকটা- ’বেড়াভাঙ্গা সৈয়দ’!!!- গল্পটা বলেছেনঃ আমার বাবা
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০২১ বিকাল ৫:০৪